সরকারি মাধ্যমিকের ‘সহকারী শিক্ষক’ পদটিকে কেন শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত করা দরকার
বাংলাদেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কয়েক দিন ধরে চার দফা দাবির ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন করছেন। এই চার দফার শীর্ষ দাবিটি হচ্ছে, ‘সহকারী শিক্ষক’ পদটিকে এন্ট্রি পদ ধরে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গেজেট প্রকাশ করা। মাধ্যমিক শিক্ষকদের এই দাবি গণমাধ্যমে আসার পর এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা-সমালোচনা এবং তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, মাধ্যমিকের শিক্ষকেরা কীভাবে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত হতে হলে বিসিএস পরীক্ষায় পাস করতে হয় ইত্যাদি। অন্যদিকে, সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকগণ বলছেন, ‘BCS (General Education) Composition and Cadre Rules of 1980’ অনুযায়ী সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ‘সহকারী শিক্ষক’ পদটি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জোরালো দাবি রাখে।
এই ‘BCS (General Education) Composition and Cadre Rules of 1980’ অনুযায়ী বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমটি ‘College Branch’ এবং দ্বিতীয় হচ্ছে ‘School and Inspection Branch’। ‘College Branch’–এর এন্ট্রি পদ ‘Lecturer’ হতে শুরু করে শিক্ষক এবং প্রশাসকদের সব পদ ক্যাডারভুক্ত। অন্যদিকে, ‘School and Inspection Branch’–এর অধীন মাধ্যমিকের সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিদর্শক, সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসার ইত্যাদি পদগুলো ক্যাডারভুক্ত। কিন্তু এখানকার ‘সহকারী শিক্ষক’ নামক প্রবেশ পদটি ক্যাডারভুক্ত নয়। এটি ১০ম গ্রেডের (দ্বিতীয় শ্রেণি) নন-ক্যাডার পদ। বিধি অনুযায়ী ‘সহকারী শিক্ষক’ পদ থেকে অন্যূন পাঁচ বছরের চাকরিকাল অতিক্রম করে ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’ হিসেবে পদোন্নতি হওয়ার কথা এবং পদোন্নতির এই সংস্কৃতি নিয়মিত চলে আসার কথা। ‘সহকারী শিক্ষক’ পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’ হলেই সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ‘BCS (General Education) Composition and Cadre Rules of 1980’ অনুযায়ী বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।
কিন্তু ‘College Branch’–এর কর্তাব্যক্তিদের এখানেই যত আপত্তি। তাঁদের যুক্তি, বিসিএস থেকে সরাসরি না এসে সরকারি মাধ্যমিকের একজন ‘সহকারী শিক্ষক’ কোনোভাবেই পাঁচ বছরের নামসর্বস্ব অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের আলোকে তথাকথিত পদোন্নতির নামে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত হতে পারেন না। বিসিএস ক্যাডারভুক্ত হতে হলে অবশ্যই তাঁদের বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে আসতে হবে ইত্যাদি। ‘College Branch’ কর্তাব্যক্তিদের ঠিক এমন রোষানলের কারণেই সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকগণ পূর্ণাঙ্গ চাকরিকালেও ‘সহকারী শিক্ষক’ থেকে ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’ পদে পদোন্নতি পান না। এভাবে পদোন্নতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে বিধি অনুযায়ী তাঁরা বিসিএস ক্যাডারভুক্ত হয়ে যাবেন, এই ভয়েই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা, যাঁদের সবাই ‘BCS (General Education) Composition and Cadre Rules of 1980’ অনুযায়ী গঠিত হওয়া ‘College Branch’ হতে আসা, বিভিন্ন ছলচাতুরী করে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকগণের পদোন্নতি আটকে রাখেন। উদ্দেশ্য একটাই, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকগণ যাতে কোনোভাবেই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত হতে না পারেন।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
তাঁদের কারণে বলি হয়ে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ‘সহকারী শিক্ষক’ পদ থেকে ২০২১ সালে পদোন্নতি পেয়ে ‘সিনিয়র শিক্ষক’ হওয়া একদল শিক্ষক জটিল গ্যাঁড়াকলে আটকে গেছেন। বিধি অনুযায়ী, তাঁরা আর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’ পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন না! কারণ, ‘BCS (General Education) Composition and Cadre Rules of 1980’ অনুযায়ী ‘School and Inspection Branch’–এ কর্মরত শিক্ষকদের জন্য ‘সিনিয়র শিক্ষক’ নামে কোনো পদের উল্লেখ নেই। সরকারি মাধ্যমিকের পদোন্নতিবঞ্চিত বহু শিক্ষকের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রশমনে ছলচাতুরী করে সান্ত্বনাস্বরূপ তাঁদের জন্য ‘সিনিয়র শিক্ষক’ নামক কাল্পনিক এই পদ সৃজন করেছেন। এর মাধ্যমে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে বিধিমালা লঙ্ঘন করে ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’ পদের পরিবর্তে ছলচাতুরী করে তাঁদের ‘সিনিয়র শিক্ষক’ হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে কেবল তাঁদের বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত হওয়া ঠেকাতে। কারণ, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ‘সিনিয়র শিক্ষক’ নামক কোনো পদ বিসিএস ক্যাডারভুক্ত নয়।
এভাবে সারা দেশের মোট ৭২১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিংহভাগই ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে চালানো হচ্ছে। উদ্দেশ্য সেই একই, সরকারি মাধ্যমিকের কোনো শিক্ষকই যেন কোনোভাবেই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত হতে না পারেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, সরকার তাহলে ঠিক কী কারণে ১৯৮০ সালে প্রণীত ‘BCS (General Education) Composition and Cadre Rules’ এ সরকারি মাধ্যমিকের ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’, ‘প্রধান শিক্ষক’, বিদ্যালয় পরিদর্শক, সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসার পদগুলোকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত করেছিল? সরকার কি সে সময় যথেষ্ট চিন্তাভাবনা না করেই ভুলবশত এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? নাকি সরকার কর্তৃক জেনেবুঝে নেওয়া একটা সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সেটিকে অবজ্ঞা করে আসা হচ্ছে?
এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর হচ্ছে সরকার সে সময় জেনেবুঝেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কোনোভাবেই সরকারের এই সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল না। কারণ, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকতা পেশা একটি ভিন্ন ও জটিল প্রকৃতির কাজ। এ খাতের ওপর নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ ও সরাসরি কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়া বাইরে থেকে অধিকতর মেধাবী কেউ এসেও মাধ্যমিকের সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিদর্শকের মতো পদগুলো সফলতার সহিত সামলাতে পারবেন না। ঠিক এ কারণেই দীর্ঘদিন ধরে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্যাডারভুক্ত এই পদগুলোর দিকে ‘College Branch’–এর কর্মকর্তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদানের সরাসরি অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ না থাকায় তাঁরা তাঁদের শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাগণকে এ পদগুলোতে পদায়ন করতে পারছেন না।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের যুক্তি হচ্ছে, বিধিগত কারণে মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদানের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে যেহেতু ‘College Branch’–এর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারগণকে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিদর্শক, সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসার ইত্যাদি ক্যাডারভুক্ত পদগুলোতে পদায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না, আবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের সদিচ্ছার অভাবে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকগণকে পদোন্নতির মাধ্যমে উক্ত ক্যাডারভুক্ত পদগুলোতে পদোন্নতিও দেওয়া হচ্ছে না, সেহেতু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা না রেখে কিংবা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিয়ে না চালিয়ে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ‘সহকারী শিক্ষক’ নামক প্রবেশ পদটিকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত করে দেওয়া হোক। তাহলে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিদর্শক, সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে শিক্ষকদের পদোন্নতি দেওয়ার জটিলতা কেটে যাবে এবং পরবর্তী সময় এই পদগুলোতে সবার জন্য সরাসরি বিসিএসের মাধ্যমে আসার সুযোগ উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
* লেখক-রেজাউল ইসলাম, লেখক ও শিক্ষক