প্রেম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চণ্ডিপুর গ্রাম। এখানে ভালোবাসা সব সময় নিয়মের বেষ্টনীতে বন্দী। জাত–পাত আর সামাজিক ভেদাভেদের কঠোর শৃঙ্খলে মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছাগুলো প্রায়ই চাপা পড়ে যায়। এই গ্রামেই রয়েছে দুটি পরিবার। মজিদবাড়ি আর চৌধুরীবাড়ি। মজিদবাড়ি নিম্নবর্ণের কৃষকের পরিবার, আর চৌধুরীবাড়ি জমিদার বংশের। দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই বৈরী। জমি, পানি আর ক্ষমতা নিয়ে বহু পুরনো শত্রুতা তাদের মধ্যে। এমন সময় এই দুই পরিবারের ছেলে-মেয়ের মধ্যে জন্ম নেয় এমন একটি সম্পর্ক, যা সমাজের চোখে একেবারেই নিষিদ্ধ। ব্যাপারটা হলো রহিম আর ঋতুকে নিয়ে।

ঘটনার সূচনাটা ছিল এমন। রহিম মজিদবাড়ির ছোট ছেলে। তার বাবা একজন সাধারণ কৃষক, যিনি নিজের ১০ বিঘা জমি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, কিন্তু সততা আর কঠোর পরিশ্রমে তারা টিকে আছে।

গ্রামের মানুষ রহিমকে ভালোবাসে। তার আচরণ, সততা, আর অন্যের বিপদে ছুটে যাওয়ার সহজাত গুণ তার পরিবারের কাছে ভালো না লাগলেও তাকে সবার কাছে প্রিয় করে তুলেছে। রহিম খুব সহজ-সরল, কিন্তু তার গভীর দৃষ্টিভঙ্গি এবং আত্মবিশ্বাস ও সুচিন্তা সবাইকে আকর্ষণ করে। রহিমের একটি আলাদা গুণ হলো, সে স্বপ্ন দেখতে জানে। সে মনে করে, মানুষ ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম দিয়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। মজিদের ছেলে হলেও সে অন্য দশটা সাধারণ ছেলের মতো নয়। মাদক, নেশা কিংবা ধূমপানের মতো কোনো কিছুতে তার মধ্যে নেই। সে খুব কর্মঠ, পিতার সঙ্গে চাষাবাদের কাজ করে আর গ্রামের সমস্যা সমাধান ও মানুষের কাজে লেগে থাকে। পুকুরের ঘাট সংস্কার হোক, কিংবা অসুস্থ কারও হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা, রহিম সব কাজেই এগিয়ে আসে।

এ গল্পগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল চৌধুরীবাড়িতেও। ঋতু, যাকে সব সময় বিলাসিতার খাঁচায় বন্দী থাকতে হয়েছে, শুনেছিল এই রহিমের গল্প। তার সরলতা, সাহস আর মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা শুনে মনের গভীরে রহিমের প্রতি অজানা এক টান অনুভব করেছিল।

একদিন বিকেলে গ্রামের এক পুকুর পাড়ে পঞ্চায়েতের মিটিং চলছিল। সেখানে গ্রামের একটা সমস্যার সমাধানে সবাই তর্ক-বিতর্ক করছিল। রহিম তখন শান্ত গলায় একটি সমাধান প্রস্তাব করল। তার কথা এতটাই যুক্তিযুক্ত ছিল যে উপস্থিত সবাই তার প্রশংসা করল। চৌধুরী সাহেবও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। যদিও তিনি মিটিংয়ে তাকে ডাকতে চাননি। কিন্তু সবার আস্থা ও ভালোবাসার পাত্র বনে যাওয়ার কারণে মিটিংয়ে ডাকতে বাধ্য হন।

মিটিং শেষ হয়। ঋতু পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে রহিমকে প্রথমবার সামনে থেকে দেখল। আগে কেবল তার কথা শুনেছিল। কিন্তু আজ দেখল সেই দৃঢ়চিত্ত, আত্মবিশ্বাসী মানুষটিকে। তার কাঁধে ছিল কঠোর পরিশ্রমের ছাপ, কিন্তু মুখে ছিল একধরনের শান্ত হাসি।

রহিম পুকুরের ঘাট দিয়ে হাঁটছিল। তার দৃষ্টি সামনে, কিন্তু ঋতুর উপস্থিতি অনুভব করল। প্রথমে সে অবাক হলো, চৌধুরীবাড়ির মেয়ে এখানে কী করছে?

ঋতু সাহস করে তার দিকে এগিয়ে গেলে রহিম কিছুটা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি এখানে?’

ঋতু হেসে বলল, ‘তোমার কথা অনেক শুনেছি। আজ প্রথমবার দেখলাম। সবাই তোমার খুব প্রশংসা করে। জানো, তোমার মতো ছেলে আজকাল পাওয়া যায় না।’

রহিম একটু লজ্জায় পড়ে বলল, ‘মানুষের জন্য যা করি, তা দায়িত্ব মনে করেই করি। এতে প্রশংসার কিছু নেই।’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ঋতু তার সরলতা দেখে মুগ্ধ হলো। তার হৃদয় ধীরে ধীরে ভরে উঠল সেই রহিমের জন্য, যার সম্পর্কে আগে শুধু গল্প শুনেছিল। এবার তার নিজের চোখে দেখা হলো। সেদিনের পর থেকে, পুকুর পাড়ের সেই প্রথম কথোপকথন যেন ঋতুর মনে ভালোবাসার একটা অদৃশ্য বীজ বুনে দিয়েছিল। রহিমের চরিত্রের বিশুদ্ধতা আর গুণাবলীর বাস্তব রূপ দেখে সে নিজেকে সেই ভালোবাসার হাতছানিতে আটকে ফেলল।

গোধূলির আকাশ। পুকুরপাড়ের পানিতে সূর্যের শেষ আলোর প্রতিফলন ঝিলমিল করছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, মাঝেমধ্যে ঝিঁঝি পোকাদের ডাক। রহিম কাঁধে একটি জাল নিয়ে পুকুরের ঘাটে বসে ছিল। আজ মাছ ধরতে এসেও তার মন অশান্ত। বাবার কথায় যেন ভেসে আসছিল কঠোর বাস্তবতা, ‘এই ১০ বিঘা জমি দিয়ে আর কতদিন?’

ঠিক তখন, তার দৃষ্টি আটকে যায় একটি দৃশ্যে। পুকুরের উল্টোদিকে এক অচেনা মেয়ে হাঁটছে, অচেনা নয় সবারই পরিচিত সাদেক চৌধুরীর ছোট মেয়ে ঋতু। এই সন্ধ্যায় প্রকৃতির লবণ্য মৃতপ্রায় হলেও তার লাবণ্য যেন সজীব ও জাগরুক। নতুন রূপ, লাবণ্যে তাকে অচেনা লাগছে। গায়ে আকাশি রঙের থ্রি পিস, পরনে সাদা-নীল সালোয়ার। চুলগুলো খোলা। পায়ে হালকা আলতা। মেয়েটির হাঁটার ভঙ্গি আর মুখের অভিব্যক্তি সবকিছুতে রহিম বিমোহিত। রহিম নিজের অজান্তেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি ধীরে ধীরে ঘাটের দিকে এগিয়ে আসে। পানির ধারে এসে দাঁড়িয়ে হঠাৎ থেমে যায়, যেন কোনো কিছু গভীরভাবে ভাবছে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর মেয়েটি হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে রাহিমের দিকে তাকায়। চোখে বিস্ময় আর কিছুটা সতর্কতা। রহিম হতচকিত হয়ে পড়ে। দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়, কিন্তু মেয়েটি আর চোখ সরায় না।

ঋতু মৃদু হেসে বলে, ‘তুমি কি সব সময় এত চুপচাপ? গ্রামের অনেক ছেলেপেলে আমার আশপাশে ঘুরঘুর করে, কথা বলতে চায়।’

রহিম শান্তভাবে বলে, ‘আমি অনেক কিছু বলি না। তবে মনের কথা বলতে পারলে ভালো লাগত।’

‘তাহলে বলো না, কী ভাবছো?’

রহিম লজ্জা পায়। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, ‘তোমাকে দেখে মনে হলো, তুমি এখানে একা আসোনি। তোমার চোখে অনেক প্রশ্ন, অনেক গল্প লুকানো। অনেক স্মেহ, মায়া লুকানো।’

ঋতু কিছুক্ষণ চুপ থাকে। লজ্জা পায়। বুক ফেটে যায় কিন্তু মুখ ফুটে না তার। তারপর বলে, ‘তুমি একদম ঠিক বলেছ। এখানে আমি একা আসতে পারিনি । আমার সাথে এসেছে একরাশ ইচ্ছে, অভিলাষ, প্রেম, ভালোবাসা ও মায়া ।’

‘আচ্ছা, তুমি কি কিছু বুঝ না! তুমি কি কিছু বলবে না রহিম? রহিম ঋতুর কথাগুলো বুঝতে পারে, বুঝতে পারে তার প্রতি ঋতুর ভালোবাসা। কিন্তু কী করে সে তাকে বুঝাবে যে সেও তাকে ভালোবাসে। তাকে দেখলে সে ভুলে যায় নিজের সত্তাকে। কিন্তু প্রতিবার মনে পড়ে, তার গায়ের মাটির গন্ধ হয়তো ঋতুর শহুরে স্বপ্নের সঙ্গে মেলে না। তবুও তাকে না দেখার ব্যথা আরও বেশি।’

কীভাবে তাকে সে বুঝাবে?! রহিম নিশ্চুপ। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ঋতু জানে যে রহিম সবকিছু বুঝতে পারছে, কিন্তু সমাজের এই নিষ্ঠুর আচরণের সামনে সে নিরুপায়।

ঋতু বিদ্রোহী কন্ঠে বলে, ‘আমার বাবা বলেন, সম্মান মানে টাকা আর পদমর্যাদা। কিন্তু আমার কাছে সম্মান হলো এমন কাউকে ভালোবাসা, যে আমাকে বুঝতে পারে। আমাকে ও আমার মতামতকে সম্মান করে। তোমার চোখে আমি সত্যিকারের ‘আমি’কে খুঁজে পাই।’

‘আমি জানি, আমরা ভুল করছি।’

রহিম নিচু গলায় বলল।

ঋতু তাকিয়ে রইল তার দিকে।

‘ভুল কিসে? তোমাকে ভালোবাসায়, নাকি এই সমাজের শিকল ভাঙতে চাওয়ায়?’

রহিম বলে, ‘তুমি জানো, তারা আমাদের মেরে ফেলবে।’

‘তাহলে মরার আগে, আমাদের স্বপ্নগুলোকে বাঁচতে দাও।’

ঋতুর গলায় দৃঢ়তা।

২.

রহিম আর ঋতুর গোপন দেখা-সাক্ষাতের খবর ধীরে ধীরে বাতাসে ভেসে চৌধুরীবাড়ি আর মজিদবাড়ি উভয় বাড়িতেই পৌঁছে গেল। ঋতুর মা প্রথমে সন্দেহ করল। তার মেয়ে সন্ধ্যার পর বাইরে বের হয়, কিন্তু কোথায় যায় এ নিয়ে তিনি চিন্তিত।

একদিন সকালে চৌধুরী সাহেব ঋতুর ঘরে এসে বললেন, ‘তোর এত রাত করে বাইরে যাওয়ার কারণ কী? তোর মা বলছে, তুই পুকুরপাড়ে ঘোরাঘুরি করিস। এটা ঠিক নয়।’

ঋতু শান্ত গলায় বলল, ‘বাবা, আমি শুধু একটু নিশ্বাস নিতে যাই। এই গ্রাম, এই বাড়ির কঠোর শাসন আমাকে হাঁপিয়ে তোলে।’

কিন্তু চৌধুরী সাহেব সহজে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি পুকুরপাড়ে লোক লাগিয়ে দিলেন তার মেয়ে কার সঙ্গে দেখা করে তা জানার জন্য।

অন্যদিকে, মজিদবাড়ির লোকজনও রহিমের পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল। সে আগের মতো প্রাণবন্ত থাকত না। গভীর রাতে তার মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফেরা দেখে মা একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর কিছু হয়েছে রে, বাপ? এভাবে মন খারাপ কেন?’

রহিম কিছু না বলে মাটির দিকে চেয়ে থাকল। তার ভাই বলল, ‘মা, শোন না গ্রামের লোক বলাবলি করছে যে ভাইয়া চৌধুরী সাহেবের মেয়ের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে।’

মজিদ সাহেব তখনই কড়া গলায় বলে উঠলেন, ‘আমার ছেলে কখনো এমন ভুল করবে না। ও জানে আমাদের অবস্থান কোথায়।’ রহিম চুপচাপ উঠে চলে গেল।

পুকুরপাড়ে এক সন্ধ্যায় তারা দেখা করল। ঋতুর চোখে ভয় আর বেদনার ছাপ ছিল।

‘তুমি জানো, আমাদের কথা পুরো গ্রাম জেনে গেছে?’ ঋতু বলল।

‘হ্যাঁ।’ রহিম শান্ত গলায় বলল।

‘আমার পরিবারও জানে।’

‘তাহলে কী করবে তুমি? তোমার পরিবার হয়তো তোমাকে ত্যাজ্য করবে। আমার বাবা তো আমাকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না।’

রহিম চুপ করে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘আমরা এই গ্রামে থাকতে পারব না। আমাদের পালিয়ে যেতে হবে।’

‘তুমি কি জানো, এটা কতটা বিপজ্জনক? আমাদের খুঁজে পেলে মেরে ফেলবে।’

ঋতু সতর্ক করল।

‘জানি।’ রহিম দৃঢ় গলায় বলল।

‘কিন্তু তোমাকে হারানোর ভয় তার চেয়েও বেশি।’

সেই রাতেই তারা সিদ্ধান্ত নিল, গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাবে। সেখানে তাদের নতুন জীবন শুরু হবে। রহিম কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে সামান্য কিছু টাকা ধার করল। ঋতু নিজের কিছু গয়না গোপনে সঙ্গে রাখল।

পরের রাতে তারা পুকুরপাড়ে দেখা করল। সবকিছু প্রস্তুত। কিন্তু তারা জানত না যে চৌধুরী সাহেবের লোকজন তাদের অনুসরণ করছিল।

ঠিক যখন তারা গ্রাম ছাড়ার জন্য রওনা দিচ্ছিল, তখনই কয়েকজন অস্ত্রধারী লোক তাদের ঘিরে ফেলল।

‘তুই চৌধুরী সাহেবের মেয়ে নিয়ে পালাবি?’ এক লোক চিৎকার করে বলল।

‘তোর সাহস হয় কীভাবে?’

রহিম কিছু বলার আগেই একজন তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল।

‘ওকে ছাড়ো!’ ঋতু চিৎকার করে বলল।

লোকগুলো তার কথা কানে তুলল না। তারা রহিমকে মারতে শুরু করল।

হঠাৎ ঋতু চিল্লিয়ে বলল, ‘যদি আজ এই ছেলেটিকে তোমরা মারো, তাহলে আমিও বাঁচব না।’

সবাই থেমে গেল।

‘আমি তার সঙ্গে থাকতে চাই। তাকে ভালোবাসি। তোমরা যতই শাসন করো, আমি তোমাদের ইচ্ছায় আর বাঁচব না।’

তার এই কথা শুনে চৌধুরী সাহেব ঘটনাস্থলে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখ রাগে লাল।

‘তুই আমার মানসম্মান নষ্ট করবি? এই ছেলের সঙ্গে তুই কীভাবে সম্পর্ক করতে পারলি?’

ঋতুর চোখে তখন জল। কিন্তু তার কণ্ঠে সাহসের কমতি নেই।

‘বাবা, এই সমাজের নিয়ম ভাঙা আমার ভুল হতে পারে। কিন্তু আমি তাকে ভালোবেসেছি। আর ভালোবাসা কোনো ভুল নয়।

চৌধুরী সাহেব সব বুঝে ও তার মেয়ের সামনে কিছুই বলেননি। তিনি রহিমের ও মসজিদ পরিবারের প্রতিশোধ নিবেন বলে মনস্থির করেন। তিনি মনে মনে বললেন মজিদকে আমার সম্মান ক্ষুণ্ন করার প্রায়শ্চিত্ত দিতে হবে।

৩.

চৌধুরী সাহেব চাইলে বিষয়টাকে তখনই সমাধান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি করেননি। বরং চৌধুরীবাড়ি ও মজিদবাড়ির লোকদের মধ্যে সংঘর্ষের আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর চৌধুরীবাড়ি ও মজিদবাড়ির লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল পুকুরপাড়ে। লাঠি, দা, কাঁচি হাতে উভয় পক্ষের মানুষ একে অপরের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। চারপাশে চিৎকার, হাহাকার। গ্রাম যেন এক রণক্ষেত্র।

রহিম মাটিতে পড়ে ছিল, মুখে রক্ত। ঋতু তাকে আগলে ধরে কাঁদছিল। তাঁর কণ্ঠ ফেটে যাচ্ছিল, ‘থামো! তোমরা সবাই থামো! তোমরা কি জানো, এই লড়াই আমাদের ধ্বংস করছে?’

কিন্তু তার চিৎকারে কেউ থামল না। গ্রামে সর্বজনশ্রদ্ধেয় বৃদ্ধ হারুন মিয়া সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে লাঠির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। রক্তাক্ত মুখে তিনি বললেন, ‘তোমরা কী করছ? নিজেদের ভাইদের রক্ত ঝরাচ্ছ। কী পাবে এতে?’

হারুন মিয়ার এই ঘটনা উভয় পক্ষকেই থামিয়ে দিল। চারপাশে হঠাৎ নীরবতা নেমে এল। সবাই থমকে গেল, যেন নিজেদের প্রতিচ্ছবি তারা এই বৃদ্ধের রক্তে দেখতে পেল। হারুন মিয়া কষ্ট করে উঠে বললেন, ‘তোমরা কী নিয়ে লড়ছ? জাত নিয়ে? বংশ নিয়ে? অথচ দেখো, আমাদের মাটির রং কি আলাদা? আমাদের রক্ত কি ভিন্ন? আমি কি চৌধুরীবাড়ির মানুষ নাকি মজিদ বাড়ির মানুষ? আমি শুধু এই গ্রামের মানুষ।’

চৌধুরী সাহেব ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু হারুন মিয়ার কথা তার ভেতরেও কাঁপন ধরাল।

‘তোমরা যখন এই গ্রামে এসেছিলে, তখন কি জমিদার বা কৃষক ছিলে? তোমাদের পূর্বপুরুষরা কি একসঙ্গে এই মাটিতে শিকড় গেড়েছিল না? আজ বংশ মর্যাদা, জাত-পাতের নামে তোমরা নিজেদের শেষ করে দিতে চাও?’

মজিদ সাহেব, যিনি এতক্ষণ চুপ ছিলেন—তার চোখে জল চলে এলো। তিনি শান্ত গলায় বললেন, ‘আমরা কী পেলাম এত জাতপাত ধরে রেখে? নিজের সন্তানদের জীবন শেষ করার ভয়?’

গ্রামের সবাই লাঠি-সোঁটা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। পুকুরপাড়ের মাটি তখন রক্তাক্ত। দুই গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রোধের আগুন জ্বলছিল। ঠিক তখনই ঋতু সবার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। তার চোখ লাল, গাল বেয়ে নেমে আসা অশ্রু তার কথার ভার বহন করছিল।

সে কাঁপা গলায় বলতে শুরু করল, ‘তোমরা সবাই কি জানো, এ মুহূর্তে তোমরা কী হারাচ্ছ? আমি তোমাদের বলছি, এই লড়াই শুধু রক্ত ঝরাবে, আর কিছুই দেবে না। আমাদের জন্ম কোথায়, কী বংশে, এসব নিয়ে এত গর্ব করো, কিন্তু তোমাদের গর্ব কি আমাদের শান্তি দিতে পেরেছে?

তোমাদের মধ্যে অনেকেই বলবে, আমি ভুল করছি। বলবে, ভালোবাসা জাতপাত মানে না। এটা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি তোমাদের বলি, মানুষ কি জন্মের আগে তার জাতপাত ঠিক করে আসে? তোমরা কি নিজের সন্তানকে এভাবে ঘৃণা করতে চেয়েছিলে?

আজ আমি, জমিদারের মেয়ে, একজন কৃষকের ছেলেকে ভালোবেসেছি। এর জন্য যদি আমার বিচার করতে চাও, তাহলে করো। কিন্তু আমার একটি কথা শোনো, এই পৃথিবী যদি জন্মের আগে আমাদের জাত ঠিক না করে, তাহলে তোমাদের এত অহংকার কেন?

আমি ভালোবাসি তাকে; কারণ, সে আমাকে বোঝে। সে আমাকে সম্মান করে। আর ভালোবাসা তো এমনই হওয়া উচিত। তাতে কোনো ধনী-গরিব, জমিদার-কৃষকের পার্থক্য নেই। আমি জানি, এই সম্পর্ক তোমাদের চোখে নিষিদ্ধ। কিন্তু যদি এই ভালোবাসার জন্য আমাকে ত্যাগ করতে হয়, আমি করব। কারণ, এই সম্পর্ক নিষিদ্ধ নয় তোমাদের দৃষ্টি ভ্রান্ত।’

ঋতুর কণ্ঠে দৃঢ়তা বাড়তে থাকে। সে বলে, ‘তোমরা বলবে, আমার এভাবে কথা বলা ভুল। সমাজের নিয়ম মানা উচিত। কিন্তু আমি তোমাদের জিজ্ঞাসা করি, এই সমাজ কে বানিয়েছে? আমরা সবাই মিলে। আর আজ এই সমাজ আমাদের ভালোবাসা কেড়ে নিতে চাইছে। তাহলে তোমরা কী চাও, আমরা মেনে নিই যে আমাদের বেঁচে থাকা কেবলই জাতের জন্য? তবে কেন জন্মেছি? মানুষ হয়ে জন্মেছি; কারণ, আমাদের মধ্যে ভালোবাসার শক্তি আছে। যদি সেই শক্তি কেউ কেড়ে নিতে চায়, তাহলে সেই সমাজ মানুষ নয়, বরং তারা মানুষ নামে পশু।’

ঋতুর চোখের জল থামছিল না। তার কণ্ঠ আরও ভারী হলো, ‘আমার মা আমাকে শিখিয়েছিলেন, ভালোবাসা মানে ত্যাগ। বাবাকে দেখেছি, সম্মান মানে সততা। তবে আজ তোমাদের দেখে মনে হয়, তোমরা নিজেদের ভালোবাসা আর সম্মানকে ভুলে গেছ। আজ তোমাদের কাছে ভালোবাসা মানে জাত, আর সম্মান মানে ক্ষমতা। এটাই যদি সত্যি হয়, তবে এই সমাজের সামনে আমি মাথা নত করব না। তোমাদের বলছি, আমি ভালোবাসার জন্য লড়ব। কারণ, ভালোবাসা কোনো দিন মানুষকে ছোট করে না, বরং বড় করে। আর আজ যদি আমি চুপ করে থাকি, তবে আমার সন্তানদের মুখে আমি কী শিখিয়ে যাব? কী রেখে যাব তাদের জন্য?’

ঋতু গভীর নিশ্বাস নিয়ে বলল, ‘তোমরা নিজের সন্তানদের দিকে তাকাও। তাদের চোখে কি ভালোবাসা নেই? তারা কি একদিন মাটি আর আকাশকে এক করে দেখবে না? আমি চাই, এই গ্রামে এমন একটি দিন আসুক, যেদিন আর কোনো মেয়ে বা ছেলে জাত আর বংশের কারণে নিজেদের ভালোবাসা বিসর্জন দেবে না। তোমরা বলো, ভালোবাসা ভুল। কিন্তু আমি বলি, ভুল এই শাসন, ভুল এই অহংকার। আর যদি আমার কথা মিথ্যা মনে হয়, তাহলে আমাকে এখানে শেষ করে দাও। তবে জানবে, ভালোবাসা কোনো দিন মরবে না। কারণ, ভালোবাসা হলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ শক্তি।’

তার এই কথাগুলো শুধু কথাই ছিল না, যেন আগুনের মতো সবার হৃদয়কে পুড়িয়ে দিচ্ছিল। এমনকি চৌধুরী সাহেব, যিনি এতক্ষণ রাগে কাঁপছিলেন, তিনিও চুপ হয়ে গেলেন। তার চোখে জল। তিনি আস্তে করে বললেন, ‘আমার মেয়ে ভুল বলে মনে হয় না। আমরা ভুল করেছি। ভালোবাসাকে আটকানো যায় না।’

গ্রামের মানুষও ধীরে ধীরে একে একে নিজেদের ভুল স্বীকার করতে শুরু করল। চৌধুরী সাহেবের চোখ ভিজে উঠল। তিনি নিজের মেয়ে আর গ্রামের লোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি, আমাদের এই জাত আর ক্ষমতার অহংকার শুধু বিভেদ তৈরি করেছে। আজ আমি নিজেই আমার মেয়েকে হারাতে বসেছি।’

রহিম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার শরীর ক্লান্ত, কিন্তু তার কণ্ঠে দৃঢ়তা।

‘চাচা, আমি জানি, আমি আপনার মেয়ের যোগ্য নই। আমি ধনী নই, আমি জমিদার নই। কিন্তু আমি মানুষ। আর ভালোবাসা তো মানুষের জন্য, বংশের জন্য নয়। আমি যদি তাকে সুখী করতে পারি, তবে আপনি কীভাবে এই ভালোবাসাকে নিষিদ্ধ করতে পারেন?’

চৌধুরী সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না। তার চোখে লজ্জার ছাপ পড়ল।

এমন সময় গ্রামের একজন মাঝবয়সী নারী উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, মজিদ সাহেব, তোমরা দুজনই ভুল করেছো। জাতপাত ধরে রেখে আমরা শুধু নিজেদের বিভক্ত করেছি। অথচ এই মাটি আমাদের সবার। তোমাদের এই শত্রুতা দেখে আমাদের সন্তানরাও শিখবে একে অপরকে ঘৃণা করতে।’

গ্রামের আরও অনেকে একে একে উঠে এসে একই কথা বলতে শুরু করল। তারা বলতে লাগল, ‘আমাদের সন্তানরা ভালোবাসতে শিখুক। আমাদের বিভেদ একসময় শেষ করতেই হবে।’

কিংকর্তব্যবিমূঢ় চৌধুরী সাহেব বললেন, তোমরা থাম, সবাই কথা বন্ধ কর। চারোদিকে নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। এমনকি পাতা পড়ার আওয়াজটাও শোনা যাচ্ছিল তখন। সকলের দৃষ্টি চৌধুরী সাহেবের দিকে। গ্রামের চূড়ান্ত ভাগ্য তিনিই নির্ধারণ করবেন। এই ঝগড়া-বিবাদ কি তিনি জিইয়ে রাখবেন নাকি চির সমাধান করবেন?

চৌধুরী সাহেব আর মজিদ সাহেব একে অপরের দিকে তাকালেন। তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে হাত মেলালেন।

‘আজ থেকে এই বিভেদ শেষ,’ চৌধুরী সাহেব বললেন। ‘আমাদের ভুল বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু আজ থেকে আমরা এই গ্রামকে এক করে গড়ে তুলব।’

গ্রামের লোকেরা এই দৃশ্য দেখে হাততালি দিয়ে উঠল।

ঠিক তখন, রহিম রক্তমাখা মুখ তুলে তাকাল। ঋতু তার পাশে বসে ছিল। তার চোখে জল, কিন্তু মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। যেন দীর্ঘ এক লড়াইয়ের পর অবশেষে তাদের ভালোবাসা একটি আলোকিত ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে।

রহিম ঋতুর দিকে তাকাল। দুজনের চোখে তখন হাজারো অনুভূতি, কষ্ট, লড়াইয়ের স্মৃতি, আর একে অপরের প্রতি গভীর মমতা।

ঋতুর চোখ ভিজে ছিল, কিন্তু সেই চোখে একধরনের দৃষ্টান্ত ছিল। যেন সে বলতে চাইছিল, ‘দেখো, আমরা পেরেছি। আমাদের ভালোবাসা শুধু আমাদের জন্য নয়, বরং এই গ্রামকেও নতুন করে শিখিয়েছে।’

রহিম কষ্ট করে একটু হাসল। সে নিজের ক্ষতবিক্ষত শরীর আর ভাঙা স্বপ্নের ভার ভুলে শুধু একবার বলল, ‘তুমি জানো, তোমার এই সাহস না থাকলে আমি হেরে যেতাম? তুমি আমার শক্তি।’

ঋতু নরম কণ্ঠে বলল, ‘আর তুমি আমার পথ। তোমার ভালোবাসাই আমাকে এই সাহস দিয়েছে।’

তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন সময় থেমে গেছে। চারপাশের লোকজনের উপস্থিতি তখন তাদের কাছে গুরুত্বহীন। পুকুরপাড়ের বাতাসে তাদের চোখের ভাষা কথা বলছিল।

পুকুরের ঢেউ যেন মৃদু সুর তুলছিল। আকাশে গোধূলির আলো সোনালি আভা হয়ে নেমে আসছিল তাদের ওপর। কাশবনের দোলায় হাওয়া যেন তাদের ভালোবাসার সাক্ষী ছিল।

একসময় রহিম তার হাত বাড়িয়ে দিল। ঋতু ধীরে ধীরে সেই হাত ধরল। তার মুখে শান্তির হাসি ফুটে উঠল।

‘এবার তো আমাদের কেউ থামাতে পারবে না,’ বলল ঋতু।

রহিম চোখ মুছে বলল, ‘না। আর কোনো বাধা নেই। আমরা একসঙ্গে আছি। আর এই গ্রামও আমাদের পথ দেখেছে।’

চারপাশের মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। চৌধুরী সাহেব আর মজিদ সাহেবের মিলন দেখে গ্রামে যে পরিবর্তন এসেছে, তার কেন্দ্রে ছিল এই দুই প্রাণ। রহিম আর ঋতু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারা পুকুরপাড়ে একসঙ্গে দাঁড়াল, যেন এই মুহূর্তে তাদের ভালোবাসা একটি নতুন দিক পেয়েছে। তাদের চোখে তখন শুধু একে অপরের প্রতি ভালোবাসা নয়, বরং ভবিষ্যতের এক নতুন গল্প রচনার প্রতিজ্ঞা ছিল।

*লেখক: হোসাইন মোহাম্মদ, চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।