খাদ্যসংকটে মূল্যস্ফীতি: কারণ ও করণীয়
‘কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি।’
বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭) তাঁর বিখ্যাত ‘হে মহাজীবন’ কবিতায় এই পঙ্ক্তিটি ব্যবহার করেছিলেন। মাত্র ২১ বছরের আয়ুষ্কালের এই কবি বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘খাদ্য’ মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। মানুষ যখন ভীষণ ক্ষুধার্ত থাকে, তখন অন্য সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়। এমনকি চাঁদকে দেখেও প্রেয়সীর কথা মনে পড়ে না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় দূর আকাশের গোলাকার চাঁদকেও তখন রুটির মতো লাগে।
কবি সুকান্ত যথার্থই বলেছিলেন। জীবন বাঁচাতে খাদ্য এক অবধারিত উপাদান। খাদ্যের জন্যই পৃথিবীতে কত সংকট! প্রতিদিন তিনবেলার পাশাপাশি অন্যান্য সময়েও মানুষ খাবার খায়। কিন্তু অতিরিক্ত দামের কারণে এই খাবার কিনতেই নাভিশ্বাস ওঠে। তথ্য বলছে, বিশ্বে যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হয়, তার এক–তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়। বাংলাদেশে খাদ্যশস্য, যেমন চাল, ডাল, গম, ভুট্টা, শাক, সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিমসহ নানা খাদ্যপণ্য উৎপাদনের সময় প্রতিবছর ১২ থেকে ৩২ শতাংশ নষ্ট হয়। এটি পূরণ করতে বিদেশ থেকে খাদ্য কিনে আনতে হয়। আমদানি পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় বাজারে মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন) তথ্যমতে, বাংলাদেশ বিশ্বের উর্বর দেশগুলোর অন্যতম, যারা বছরে প্রায় ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন কৃষিপণ্য উৎপাদন করে। এর বিপরীতে আমদানি করে ১ কোটি ২৫ লাখ টন খাদ্য। সহজ করে বললে, দেশের মানুষ বছরে সাড়ে ১০ কোটি টনের বেশি খাবার খায়। এর মধ্যে সাড়ে ৯ কোটির বেশি নিজেরা তৈরি করে আর বাকি দেড় কোটি টনের মতো বিদেশ থেকে আনে।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ৩৭তম এশিয়া ও প্যাসিফিক সম্মেলনে ‘খাদ্য ও পানি সংরক্ষণ এবং খাদ্য অপচয়রোধ’ শীর্ষক সেশনে বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ বলেন, ‘বাংলাদেশে ফসল সংগ্রহের পর বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ৩০ শতাংশ ফসল ও খাদ্য নষ্ট এবং অপচয় হয়।’
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, প্রতিবছর যে পরিমাণ খাদ্যপণ্য ‘নষ্ট’ ও ‘অপচয়’ হয়, তা দিয়ে এই দেশের মানুষের আরও তিন মাসের খাবারের জোগান দেওয়া সম্ভব। যেসব কারণে এই খাদ্য নষ্ট ও অপচয় হয়, তার সমাধান করা গেলে এই অপচয় অনেকটাই কমবে। এতে চাহিদা কমার পাশাপাশি জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে।
কীভাবে ‘নষ্ট’ হয়
উৎপাদন, বিতরণ, বিপণন ও সরবরাহের সময় প্রধান যেসব খাদ্যশস্য ‘নষ্ট’ ও ‘অপচয়’ হয়, তার মধ্যে চাল, গম, ভুট্টা, শাক, সবজি, ফল, মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম অন্যতম। দেশের বেশির ভাগ কৃষক সনাতন পদ্ধতিতে ফসল ফলান ও প্রক্রিয়াজাত করেন। এ সময় খুব কমসংখ্যক কৃষক আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন। ফলে ফসল কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দীর সময় অনেক ফসল নষ্ট হয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ২০২১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোহা. কামরুল হাছানের নেতৃত্বে একটি গবেষণা হয়। এর শিরোনাম ‘Estimation of Overall Food Losses and Waste at all Levels of the Food Chain’। এ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ধান, গম, ডাল, শাক, সবজি, ফল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিমসহ ভোগ্যপণ্য উৎপাদন থেকে পাইকারি বিক্রি পর্যন্ত শতকরা ১২ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩২ শতাংশ নষ্ট হয় আম। টমেটো নষ্ট ও পচে যায় ২৮ ভাগ। উৎপাদনের ২২ শতাংশ আলু নষ্ট হয়। আর ধান ও গম নষ্ট হয় যথাক্রমে ১৭.৮ ও ১৭.৬ শতাংশ।
বেশি পাকা অবস্থায় কাটার সময় অনেক ধান পড়ে যায়, শিষ কেটে বা ভেঙে যায়। লেদা পোকা ও পাখির আক্রমণে ধান, গম ও ভুট্টা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে পণ্য পরিবহনের সময় ভ্যান, ট্রাক, পিকআপ ও জাহাজে মালামাল লোড-আনলোডের সময় অনেক পণ্য নষ্ট হয়। আম বেশি নষ্ট হওয়ার কারণ হলো পোকা, সংরক্ষণের অভাব, পচে যাওয়া, রোগবালাই, হিমাগার না থাকা এবং অবিক্রীত থাকা।
ফল, শাক ও সবজি দ্রুত পচনশীল। মাঠ থেকে সংগ্রহের পর অল্প কয়েক দিনের মধ্যে না খেলে পচে যায়। যেসব কারণে ফল ও শাক-সবজি দ্রুত নষ্ট হয় ও পচে যায়, তা হলো পরিবহনজনিত, বাছাইজনিত ত্রুটি, অপরিপক্বতা, পানির পরিমাণ কমে যাওয়া, শ্বাসনজনিত প্রক্রিয়ায় মান কমে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া, ফল পাকাতে ইথিলিনের ব্যবহার, অতিরিক্ত পেকে ও পচে নষ্ট হওয়া, রোগজীবাণু ও পোকার আক্রমণ এবং সংরক্ষণজনিত ত্রুটি।
খাদ্য নষ্ট হলে ক্ষতি কী
যে পরিমাণ খাদ্যশস্য, শাক, সবজি, ফল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিমসহ বিভিন্ন পণ্য নষ্ট হয়, তা দেশজ মোট উৎপাদনের প্রায় এক–চতুর্থাংশ। নষ্টের পরিমাণ বেশি হলে তা পুষিয়ে নিতে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর প্রভাব পড়ে খুচরা বাজারে। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে।
আমরা কেন খাদ্যপণ্য আমদানি করি
দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল, গম আর ভুট্টা। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক বার্ষিক পরিসংখ্যান পুস্তিকা-২০২৩ এর তথ্যমতে, বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ খাদ্য আমদানিকারক দেশ, যারা আমদানি করে ১.২৫ কোটি টন। এ তালিকায় প্রথম চীন আর দ্বিতীয় ফিলিপাইন। বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ টন চাল উৎপাদন করে। বিপরীতে আমদানি ১০ থেকে ১২ লাখ টন।
প্রাণিখাদ্য তৈরিতে ভুট্টার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। দেশে ধানের পরে দ্বিতীয় শীর্ষ আবাদ করা শস্য ভুট্টার চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৪ লাখ ২২ হাজার টন উৎপাদন হয়েছে। বাকি ভুট্টা বিদেশ থেকে কিনতে হয়েছে।
আমাদের চিনির চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ টন। উৎপাদনের হার কমতে কমতে এখন ২১ হাজার ৩১৩ টনে ঠেকেছে (২০২২-২৩ অর্থবছরে)। সরকারি ১৫টি চিনিকলগুলোর মধ্যে চালু ৯টি, বাকি ৬টি বন্ধ। বিশাল পরিমাণে আমদানি করতে হয় বলে মানুষ বেশি দামে চিনি খায়।
এদিকে দেশে আলুর চাহিদা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৯৫ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার টনের কথা বলা হলেও কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের দাবি ৮৫ লাখ টন উৎপাদিত হয়েছে। আলু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও বাজার কারসাজিতে অনেক বেশি দামে আলু বিক্রি হচ্ছে। আমাদের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য গমের চাহিদা ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর উৎপাদন ১১ লাখ ৭০ হাজার টনের বিপরীতে আমদানি ৬৫ লাখ টন। ইউক্রেন-রাশিয়ার বিরক্তিকর যুদ্ধের কারণে গমজাত পণ্য বেশি দামে কিনে খাচ্ছে।
দাম কেন বাড়ে
নিত্যপণ্যের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম ও প্রচুর পরিমাণে নষ্টের কারণে বাজারে সংকট তৈরি হয়। ফলে বিদেশ থেকে আমদানি করায় দাম বাড়ে। এদিকে উৎপাদনের পর মাঠ থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে পণ্য পরিবহনে অনেকবার চাঁদা দিতে হয়। এতবার চাঁদা দিয়ে বাজারে আনার পর দাম বহুগুণ বেড়ে যায়।
করণীয় কী
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খানের মতে, খাদ্যশস্য নষ্ট হওয়ার পরিমাণ কমাতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। অপচয় কমাতে ‘খাদ্য অপচয় প্রতিরোধ আইন’ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে; চীন ২০২১ সাল থেকে এটি করছে। এ ছাড়া যা করতে হবে তা হলো:
১.
কৃষি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা আধুনিক করতে হবে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে ‘কম্বাইন হারভেস্টিং’-এর ব্যবহার বাড়াতে হবে।
২.
দেশের ভেতরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনের কারখানা তৈরির উদ্যোগে নিতে হবে।
৩.
পণ্যের বিক্রয়মূল্য সাশ্রয়ী রাখা।
৪.
কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে সুদের হার কমানো।
৫.
পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে হবে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি। এটি কমাতে উৎপাদন খরচের সঙ্গে সংগতি রেখে পণ্য আমদানি করতে হবে।
৬.
চাল আমদানিতে শুল্ক কমাতে হবে।
৭.
নীতি সুদহার বাড়িয়ে বাজারে অর্থ সরবরাহ সংকোচন করতে হবে। মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে না আনা পর্যন্ত নীতি সুদহার বাড়িয়ে যেতে হবে।
৮.
বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। যারা পেঁয়াজ, আলু, চাল, ডাল, চিনি, আদা, রসুন, দুধ, ডিমসহ জরুরি নিত্যপণ্য গুদামে¯স্টক করে সুযোগ মতো দাম বাড়ায়, তাদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
৯.
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি বাড়াতে হবে। মোট উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশ খাদ্যশস্য মজুত রাখতে হবে, যাতে সংকটকালে বাজারে পণ্য সরবরাহ করা যায়।
১০.
টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করতে হবে। সরকার ১ কোটি নিম্ন¤œ আয়ের মানুষের কাছে খাদ্য সরবরাহ করছে; এটি বাড়িয়ে কমপক্ষে ২ কোটি করতে হবে।
১১.
টিসিবি, ওএমএসসহ খাদ্যবান্ধব নানা কর্মসূচিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। এটি বন্ধ করতে বিতরণপদ্ধতি সহজ করতে হবে। প্রকৃত অভাবী মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছে দিতে হবে।
১২.
অতিদরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে নগদ অর্থসহায়তা দিতে হবে। স্বচ্ছতার জন্য তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অথবা মোবাইলে টাকা পাঠাতে হবে।
১৩.
খাদ্যপণ্যের নিয়মিত পরিসংখ্যান সরকারকে জানাতে হবে। কোথায় কত পরিমাণে উৎপাদন হচ্ছে, চাহিদা কত, জোগান কত, গোডাউনে কত আছে তার হালনাগাদ তথ্য জানাতে হবে।
১৪.
খাদ্যশস্য বিতরণে জড়িত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
১৫.
খাদ্য বিপণনসংক্রান্ত সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ‘ট্রেড লাইসেন্স’ বাধ্যতামূলক করতে হবে। ক্রয়, বিক্রয়, বিপণন ও মজুত—সবকিছুই ডিজিটাল সিস্টেমে আনতে হবে; যাতে পণ্য স্টক করার ব্যাপারে কেউ তথ্য গোপন করতে না পারে।
১৬.
ডিজিটাল পদ্ধতিতে ‘সাপ্লাই চেইন’ (উৎপাদন থেকে বিক্রয় পর্যন্ত সঠিক তথ্য) তৈরি করলে খাদ্যের অপচয় কমবে এবং কৃষক প্রকৃত দাম পাবে। এ জন্য ‘ভ্যালু চেইন’ গড়ে তুলতে হবে। বৈজ্ঞানিকভাবে খাদ্যশস্য ফল, শাক, সবজি, দুধ, ডিমসহ কৃষিপণ্যের মজুত নিশ্চিত করতে হবে। সরকারিভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে ‘কোল্ড স্টোরেজ’ বানাতে হবে।
১৭.
ধানের ক্ষেত্রে ‘কাটা’ থেকে ‘মাড়াই’ পর্যন্ত ‘অটোমেশন’ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।
১৮.
ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মডেল থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে বিতরণ মডেলে গেলে পণ্য সরবরাহব্যবস্থায় নগদ অর্থের প্রবাহ নিশ্চিত করা সম্ভব।
১৯.
উৎপাদকের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় বিতরণব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ আনতে পারলে পণ্যের দামের ওঠা-নামা নিয়ন্ত্রণে আসবে। এতে ক্রেতারা দামের অরাজকতা থেকে মুক্তি পাবে এবং নিশ্চিত হবে সহজ প্রাপ্তি। এভাবে উদ্যোগ নিলে যে পরিমাণে খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়, তা কমবে।
এদিকে গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসা সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে খাদ্যের অপচয় অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহা. কামরুল হাছান। তাঁর মতে, খাদ্য নষ্ট ও অপচয় পুরোপুরি বন্ধ করা কখনোই সম্ভব না। তবে, নিয়ন্ত্রণে আনতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। শতকরা ৫০ ভাগ লোকসান কমাতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া অন্যান্য যা করতে হবে, তা হলো:
১.
খাদ্য নষ্ট এবং অপচয় কমাতে জাতীয় কর্মকৌশল ঠিক করা।
২.
উত্তম কৃষিচর্চার অনুশীলন করা (২০ শতাংশ কমলেও অনেক সাশ্রয় হবে)
৩.
খাদ্যশস্য, ফল, শাক, সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিমসহ অন্যান্য পণ্য নষ্টের হাত থেকে রক্ষা করতে কৃষক, উৎপাদক ও বিপণনকারীদের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৪.
‘কোল্ড চেইন ম্যানেজমেন্ট’ সিস্টেম বাড়াতে হবে। এটি পাবলিক ও প্রাইভেট পার্টনারশিপে করতে হবে।
৫.
পণ্যের প্যাকেট মোড়কজাত সঠিকভাবে করতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৬.
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত স্থানে পণ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
৭.
‘ফুড প্রসেসিং’ সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে।
৮.
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (ক্যাব) শক্তিশালী করতে হবে।
৯.
‘ফুড ব্যাংকিং’–এর মাধ্যমে ‘ফুড রিসোর্স’ বাড়াতে হবে। ভারতে এটি চালু আছে। এই পদ্ধতিতে রেস্টুরেন্ট ও কমিউনিটি সেন্টারের অব্যবহৃত ও অল্প ব্যবহৃত খাবার সংগ্রহ করে হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
১০.
‘ওয়েস্ট রিসাইক্লিং সিস্টেম’ চালু করতে হবে। নষ্ট হওয়া, পচে যাওয়া ও অব্যবহৃত খাদ্যশস্য, শাক, সবজি, ফল, দুধ, ডিমসহ অন্যান্য খাবার সঠিকভাবে রিসাইক্লিং করে সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে।
পরিশেষ
খাদ্যপণ্য নষ্ট হওয়া চিরতরে বন্ধ করা সম্ভব না। কিছুটা ‘সিস্টেম লস’ থাকবে, তবে সেটিকে সর্বনিম্ন রাখতে প্রচেষ্টা থাকতে হবে। পণ্য নষ্টের পরিমাণ কমাতে পারলে বাজারে চাহিদার অনুপাতে জোগান বাড়বে।
এতে আমদানিনির্ভরতা কমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো উৎপাদিত খাদ্য ও নিত্যপণ্যের পরিমাণ বাড়াতে সুশৃঙ্খল, গণতান্ত্রিক ও কেন্দ্রীয় বিতরণব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। এতে স্থানীয় উৎপাদক ও প্রস্তুতকারক সমানভাবে বাজারে ঢুকতে পারবে। তখন অল্প কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এ উদ্যোগ শুধু সংকট থেকেই রক্ষা করবে না, এটি আমাদের উর্বর ভূমির দক্ষতা ও কারখানার উৎপাদনে গতি আনবে। কেন্দ্রীয়ভাবে বিতরণ মডেলে পণ্য সরবরাহ করার পদ্ধতি চালু করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর উচিত নতুন ও প্রযুক্তিবান্ধব কোম্পানিগুলোকে উৎসাহ দেওয়া। নিত্যপণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ‘বিতরণ নেটওয়ার্ক’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘সুষম খাদ্য’ ব্যবস্থাপনার শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে আপামর জনগণের বিরাট উপকারে আসবে!
লেখক: বায়েজিদ আহমেদ, সাংবাদিক
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]