শিক্ষক কর্মবিরতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় অচলাবস্থা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে এক গভীর ও জটিল সংকটের মুখোমুখি। সারা দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘস্থায়ী কর্মবিরতি পুরো জাতীয় শিক্ষাপঞ্জিকে অচল করে দিয়েছে। এই আন্দোলন কেবল একটি পেশাগত দাবিদাওয়ার লড়াই নয়; বরং এটি সরাসরি প্রভাব ফেলেছে দেশের কোটি কোটি শিশুর শিক্ষাগত ভবিষ্যৎ, তাদের মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতা এবং একটি জাতির জ্ঞানভিত্তিক ভিতের ওপর। সংবেদনশীল বার্ষিক ও নির্বাচনী পরীক্ষার মৌসুমে এই কর্মবিরতি শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসনকে এক অদৃশ্য অনিশ্চয়তা ও হতাশার গহ্বরে ঠেলে দিয়েছে।
দেশজুড়ে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চলমান ধর্মঘটের কারণে জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মোট ৬৫ হাজার ৫৬৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত প্রায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার প্রধান শিক্ষক এবং বাকিরা সহকারী শিক্ষক। দেশের প্রাথমিক স্তরের মোট ১ কোটি ৯৭ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ শিক্ষার্থী এই সরকারি বিদ্যালয়গুলোয় অধ্যয়ন করে, যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৫৫.৭৩ শতাংশ। একইভাবে, দেশের ৭২১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট ৫ লাখ ৭১ হাজার ৬৮১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরের শিক্ষকদের পৃথক ৩ ও ৪ দফা দাবি নিয়ে অব্যাহত ধর্মঘটের কারণে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব পরীক্ষার সময়সূচি এলোমেলো হয়ে গেছে। এই দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থা পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষাবর্ষকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তবে আশার কথা, কর্মবিরতি থেকে মাধ্যমিকের শিক্ষাকেরা বিরতি নিয়েছেন। আজ থেকে পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
শিক্ষকদের এই আন্দোলনের মূল দাবিগুলো গভীর কাঠামোগত সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে। প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’–এর তিনটি প্রধান দাবির মধ্যে রয়েছে বেতন স্কেল ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণ, যা পেশাগত মর্যাদার সঙ্গে জড়িত; চাকরির ১০ ও ১৬ বছর পর উচ্চতর গ্রেডপ্রাপ্তির জটিলতা ও আমলাতান্ত্রিক বাধার অবসান, যা তাঁদের ক্যারিয়ারের গতিশীলতা কেড়ে নেয়; এবং সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি নিশ্চিতকরণ, যাতে বাহ্যিক নিয়োগ তাঁদের উন্নতির পথ রোধ না করে। মাধ্যমিক শিক্ষকদের দাবিও একই রকম কাঠামোগত ও আর্থিক স্বীকৃতির সংগ্রামের প্রতিফলন। এই দাবি আদায়ের লড়াইয়ে সরাসরি বলী হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া বার্ষিক পরীক্ষাগুলো ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার মুখে পড়েছে। সহকারী শিক্ষকদের ব্যাপক অনুপস্থিতিতে প্রধান শিক্ষকেরা এককভাবে পুরো পরীক্ষা পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন। তত্ত্বাবধায়কের অভাব অনেক পরীক্ষাকেন্দ্রে শৃঙ্খলাহীনতার জন্ম দিয়েছে, যেখানে উত্তর নকল, খাতা ছেঁড়া এবং অনিয়ন্ত্রিত আচরণ সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক স্কুল পরীক্ষাই স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হতাশ অভিভাবক বা স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তাদের দ্বারা পরীক্ষা নেওয়ার মতো অনিয়মিত ও অস্থায়ী ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এই হতাশা ও বিশৃঙ্খলার প্রভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুব্ধ অভিভাবকদের হাতে অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষকের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
মজার বিষয় হলো, শিক্ষক সম্প্রদায় নিজেরাই এই সংকটে সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ নন। ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’ তাদের দাবি পুরোপুরি মেনে নেওয়া না পর্যন্ত কঠোর কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। অন্যদিকে ‘প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদ’ নামে আরেকটি গ্রুপ শিক্ষার্থীদের ‘জিম্মি’ না করার নীতি গ্রহণ করেছে। তারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নিয়মিত পরীক্ষা পরিচালনায় অংশ নিচ্ছেন। কারণ, তাঁরা বিশ্বাস করেন যে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করে আন্দোলন সঠিক নয়। অনেকের ধারণা, সরকারের প্রতিক্রিয়া মূলত কর্তৃত্বপরায়ণ ও হুমকিমূলক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দপ্তরগুলো সব স্কুলকে পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময়েই নেওয়ার কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। তারা পরীক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষকদের উপস্থিতির তথ্য জরুরিভাবে তলব করেছে এবং অনুপস্থিতি বা অবহেলার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যদিও সরকারও বুঝতে পারছে যে এই আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে এসএসসি পরীক্ষা ও পুরো শিক্ষাবর্ষই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
এই পুরো সংকটে সবচেয়ে বেশি হতাশ ও আতঙ্কিত হচ্ছেন অভিভাবকেরা। তাঁদের যুক্তি খুবই সরল ও যৌক্তিক: শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি থাকতেই পারে, কিন্তু সারা বছর কঠোর পরিশ্রমী শিশুদের মূল্যায়নের মাধ্যম বার্ষিক পরীক্ষাকে সেই দাবি আদায়ের হাতিয়ার বানানো উচিত নয়। এই অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলা শিশুর মনে গভীর হতাশা, উদ্বেগ ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার জন্ম দিতে পারে। তাঁরা সরকার ও শিক্ষক–নেতাদের জরুরি আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধানে আসার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছেন। কারণ, সময়ক্ষেপণ একটি প্রজন্মের শিক্ষাজীবনকে পিছিয়ে দিতে পারে।এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন তাত্ক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি—উভয় পদক্ষেপ। তাৎক্ষণিকভাবে একটি জরুরি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের (সরকার, শিক্ষক নেতারা ও শিক্ষাবিশেষজ্ঞ) মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সমাধান বের করে পরীক্ষা কার্যক্রম আবার চালু করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাহত পরীক্ষার সময়সূচি পুনর্বিন্যাস ও ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বিবেচনার প্রয়োজন। দীর্ঘ মেয়াদে, শিক্ষকদের বেতন স্কেল, পদোন্নতি নীতি এবং ক্যারিয়ার পথ স্বচ্ছ ও ন্যায্য করতে গভীর কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। শিক্ষকদের দাবি নিয়ে নিয়মিত আলোচনার জন্য একটি স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম তৈরি এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা আইন পর্যালোচনা করে শিক্ষকদের অধিকার স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা জরুরি।
সার্বিকভাবে, বর্তমান শিক্ষক কর্মবিরতি একটি জটিল সামাজিক-অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক সংকটের বহিঃপ্রকাশ। এটি শুধু বেতন বৃদ্ধির দাবি নয়; বরং শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা, ক্যারিয়ার নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার জন্য একটি সংগ্রাম। অন্যদিকে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর বর্তমান শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ এই সংঘর্ষের মাঝে ঝুলে আছে। সরকারের দমনমূলক মনোভাব এবং শিক্ষক–নেতাদের অনমনীয়তার মধ্যে পড়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন অচল। সরকার, শিক্ষক প্রতিনিধি এবং সুশীল সমাজের জরুরি, গঠনমূলক ও দূরদর্শী হস্তক্ষেপই কেবল এই সংকট থেকে উত্তরণ এবং একটি টেকসই ও ন্যায্য শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের পথ দেখাতে পারে। সময়ের অপচয় এই মুহূর্তে জাতির ভবিষ্যতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
লেখক: ফয়সাল হাবিব, প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাঞ্ছারামপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ