শিক্ষকের অনৈতিক সহযোগিতা, জাতির জন্য অশনিসংকেত

প্রতীকী ছবি

জাতি গড়ার কারিগর বলে আমরা শিক্ষকেরা যে তকমা লাগাই, মাঝেমধ্যেই পত্রিকার শিরোনাম দেখে হতাশ হই! মনে প্রশ্ন জাগে, ক্লাসে আমরা কী শিক্ষা দিই? গতকাল দেশের সর্বাধিক পাঠকপ্রিয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোয় ‘কুড়িগ্রামে এসএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে কেন্দ্র সচিবসহ ৩ শিক্ষক গ্রেপ্তার’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যা শিক্ষক জাতির জন্য কলঙ্কের! নৈতিকতার কথা ক্লাসে বলেন না—এ রকম শিক্ষক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু ক্লাসে নৈতিকতার কথা বলে পরে যখন অনৈতিক কাজ করি, তখন কি আমাদের বিবেকে লাগে না? অথবা আমরা যে শিক্ষার্থীকে নকলে সহযোগিতা করছি, তার মনে কি শিক্ষক সম্পর্কে বিরূপ ধারণা জন্ম নেবে না? আমরা এত অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছি কেন?

এর একটি প্রধান কারণ আমার কাছে মনে হয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা। যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে ভালো ফল নিয়ে প্রতিযোগিতা করার কথা, সেখানে প্রতিযোগিতা হচ্ছে এক প্রতিষ্ঠান অন্য এক প্রতিষ্ঠান থেকে কীভাবে ভালো ফল করবে, সেটা নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা অবশ্যই অনেক ভালো বিষয়।

কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পড়াশোনায় এগিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা না করে ভালো ফল করার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আশ্রয় নেয় অনৈতিকতার। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান প্রশ্নপত্র ফাঁস করা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর বলে দেওয়ার মতো গুরুতর অপরাধে লিপ্ত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকার ফল ভালো হলেও ওই এলাকা বাস্তবিকপক্ষে মেধাশূন্য জাতিতেই পরিণত হচ্ছে। আবার সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ভাবসাব এমন যে এগুলো যেন কোনো অপরাধই নয়! অনৈতিকতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উপকারের নামে অপকার করা নিয়ে সবাই মহাব্যস্ত! অথচ একজন শিক্ষার্থী যখন আপাদমস্তক বুঝতে শিখবে, তখন অনৈতিক সহযোগিতা করার জন্য ওই শিক্ষককে মন থেকে ঠিকই ঘৃণা করবে। এটা কি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তথা শিক্ষক জাতির জন্য শোভনীয় হবে?

আরও পড়ুন

এর জন্য অবশ্য আমাদের একশ্রেণির অভিভাবক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্তৃপক্ষও অনেকাংশে দায়ী বললে ভুল হবে না। কিছু কিছু অভিভাবক এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের যোগসাজশেও ক্ষেত্রবিশেষে এ রকম হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চান, যে করেই হোক ভালো ফল চাই! কিন্তু এই ভালো ফল সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর জন্য কতটুকু ক্ষতির কারণ হতে পারে, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? পড়াশোনা ছাড়াই যখন কোনো শিক্ষার্থী ভালো ফল করে, তখন তার মনের মধ্যে পরবর্তী সব পরীক্ষায় একই নিয়মে ভালো করার একটি অনুভূতি সৃষ্টি হয়। কিন্তু জায়গামতো গিয়ে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ১০ শতাংশের নিচে পাস করাও এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তা ছাড়া চাকরির পরীক্ষায়ও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় সবচেয়ে বেশি।

এবারের এইচএসসি প্রথম বর্ষের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অভিজ্ঞতার ষোলোকলা পূর্ণ হলো মনে হচ্ছে। ফল তৈরির পর দেখলাম অমুক স্কুল, তমুক স্কুল থেকে জিপিএ ৩.৫০, ৪.০০, ৪.৫০, ক্ষেত্রবিশেষে ৫.০০ পয়েন্ট নিয়ে পাস করেও কলেজের চতুর্থ বিষয়সহ সাত বিষয়েই ফলে করছে! ভাবলাম, কারণ কী? এ সবকিছুই অনৈতিকতার ফল। এ চিত্র শুধু আমার কলেজের নয়, এটি সারা বাংলাদেশের চিত্র। শিক্ষক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে সারা দেশের প্রাপ্ত তথ্য থেকেই বলছি। কিন্তু এর মাধ্যমে বাস্তবে আমরা জাতি গড়ার কারিগরেরা কি জাতিকে ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দিচ্ছি না?

*লেখক: মো. শরীফ উদ্দিন আহমেদ, সহকারী অধ্যাপক, বিশ্বনাথ সরকারি কলেজ, সিলেট