প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দরকার শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে

ঘাসের মাঝে কী পেয়েছে ওরা! বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে এভাবে ক্যামেরাবন্দী হয় দুই শিশু শিক্ষার্থী। ছবিটি সম্প্রতি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা থেকে তোলাছবি: সোয়েল রানা

বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৯৯। প্রতিবছর লাখো কোমলমতি শিক্ষার্থী ভর্তি উপযোগী হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য। এরই মধ্যে বর্তমান সময়ে বৃহৎ একটা অংশ ভর্তি হচ্ছে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন কিংবা প্রাইভেট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। আরও সহজভাবে বললে যেসব পরিবারগুলো আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তারাও চায় তাদের সন্তানেরা কিন্ডারগার্টেন কিংবা অন্য কোনো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পড়ুক।

কিন্তু তথ্য–উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায়, গত ১০ বছরের প্রাইমারি স্কুলের চিত্র এমনটি ছিল না। ১০ বছর আগে এত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ছিল না। তবে কেন দিন দিন এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সবখানে। কেন তাদের এ বাণিজ্য দিন দিন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে? কেন অভিভাবকেরা বর্তমান সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না আগের মতো?

বর্তমানে যা একটু বেশি শিক্ষার্থী দেখা যায় শহুরে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয়। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের যত প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। প্রচুর প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, যেখানে একেক ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই থেকে চার কিংবা ছয়। এমনকি কোথাও কোথাও বিভিন্ন ক্লাসে থাকেও না। অথচ একই এলাকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। এমনকি অন্য এলাকা থেকে এসেও শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে।

কিন্তু এর রহস্য কোথায়? কেন সবাই ছুটে চলছে কিন্ডারগার্টেন কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে? এর কারণ যদি খোঁজা হয়, তবে প্রথমে দেখা যায় এখানে সঠিকভাবে পড়াশোনা হচ্ছে না।

শিক্ষার্থীদের সঠিক দেখভাল হচ্ছে না। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের ওপর খুব মনোযোগ দিচ্ছেন না।

ক্লাসগুলো ঠিকই অতিক্রম হয়ে যায়, অথচ রিডিং পড়তে পারে না। যোগ–বিয়োগে সমস্যা থেকেই যায়।

ইংরেজির উচ্চারণ, রিডিং কিছুই ভালোভাবে শেখা হয় না, শিক্ষকদের বাইরের কোনো পেশায় মনোযোগের আগ্রহ সর্বোচ্চ। শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের পড়ানোর তুলনায় ক্লাসের বাইরের গল্পটাই বেশি হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রকট আকার ধারণ করছে।

আর এই সুযোগ কিন্ডারগার্টেন নিয়ে চেষ্টা করছে তাদের প্রচেষ্টা বাড়িয়ে দিতে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে। এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত পড়াশোনা দিচ্ছে ও নিচ্ছে। কোনো শিক্ষার্থী নিয়মিত স্কুলে না এলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ও সন্তানের জন্য উপযোগী মনে করে অতিরিক্ত খরচ হওয়া সত্ত্বেও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছেন অভিভাবকেরা। তাঁরা চাচ্ছেন, তাঁদের সন্তান সঠিক শিক্ষাটা পাক সঠিক সময়ে ও সঠিক পরিবেশে।

যেখানে শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার। সারা বাংলাদেশে এত প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এত সুন্দর অবকাঠামো, খেলার মাঠ, আনুষঙ্গিক সুযোগ–সুবিধা, আর্থিক সহযোগিতা সত্ত্বেও কেন অভিভাবকেরা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে দৌড়াচ্ছেন? তাঁদের (প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের) যোগ্যতা কি আদৌ সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের থেকে বেশি? মোটেই নয়; বরং দেখা যায় এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষক কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের উচ্চমাধ্যমিক অথবা অনার্সের শিক্ষার্থী। তবুও কেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন অভিভাবকেরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে? খোদ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সন্তানেরাও পড়ছে বিভিন্ন প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এই সংকট নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এখনই এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে না ভাবলে, সঠিক পদক্ষেপ না নিলে এর ফলাফল নিঃসন্দেহে আমাদের অপ্রত্যাশিত হবে।

সমস্যা হচ্ছে সিস্টেমের এবং যথাযথ দেখভালের অভাব। পাঁচ থেকে সাত বছর আগেও দেখা যেত অভিভাবকদের নিয়ে মাঝেমধ্যে স্কুলগুলোয় মিটিং হচ্ছে, তাঁদের সন্তানের অতীত ও বর্তমান ফলাফল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, মাঝেমধ্যেই হুট করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসতেন স্কুল তদারকির জন্য। থাকত অভিভাবকদের কমিটি। যারা নিয়মিত খোঁজখবর রাখত এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন পরামর্শ দিতে পারত।

স্কুল কমিটির সভাপতি ছিলেন সবচেয়ে যোগ্য, শিক্ষিত ও একজন শিক্ষানুরাগী। অথচ বর্তমানে এসবের ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। অভিভাবকদের মতামত জানানোর খুব একটা সুযোগ নেই বললেই চলে।

স্কুলগুলোর কমিটিতে থাকেন রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের নেতা–কর্মীরা। যাঁদের অধিকাংশই শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কোনো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এবং রাজনৈতিক অঙ্গনেই সব সময় ব্যস্ত। এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। ভাবনার বিষয়, এই সভাপতি বছরে একবার আদৌ স্কুলে গিয়ে খোঁজখবর রাখেন? তবে কেন পদগুলো দখল করে রেখে জাতির এমন সর্বনাশ করে বেড়াচ্ছেন?

এ যে সঠিক দেখভালের অভাব এবং গ্রামের শিক্ষার্থীদের মা–বাবার বৃহৎ একটা অংশ নিয়মিত স্কুলে গিয়ে খোঁজখবর রাখে না এবং তাঁদের রাখার সুযোগও নেই, তাঁরা ওইভাবে সচেতনও নন। এই সুযোগ নিয়ে শিক্ষকেরাও গা ভাসিয়ে চলেন। কোনোমতে নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে আসেন আর যান। যে বিষয়টা সম্ভব হয়ে ওঠে না একদম শহর পর্যায়ের স্কুলগুলোয়। কেননা, সেখানে অভিভাবকেরা খুব সচেতন থাকেন। তাঁরা স্কুলের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতে চান। পরীক্ষার রিপোর্টগুলো দেখেন ইত্যাদি।

তবে শুধু তো শহরকে কেন্দ্র করে পড়াশোনা হলেই হবে না। এই মৌলিক শিক্ষা তো প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন শিক্ষার্থীর জন্যও সমান অধিকার।

একটা শিশুর সবচেয়ে মূল্যবান সময় প্রাইমারিতে থাকাকালে। অথচ এ সময়টা যদি হেলেদুলে চলে যায়, তবে ওই শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। সরকারি সব কাঠামো থাকতেও কর্তৃপক্ষের যথাযথ দায়িত্ব পালনের অভাবে যদি এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন মানুষের আস্থার জায়গা হারিয়ে ফেলে, তবে এর ভবিষ্যৎ ভালো হবে না নিশ্চয়ই। একটা সময়ে প্রাইমারি স্কুলের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা যদি প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাননির্ভর হয়ে যায়, তবে বৃহৎ একটা জনগোষ্ঠী তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। যার প্রভাব একটা জাতির জন্য সুদূরপ্রসারী অপ্রত্যাশিত হবে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে সেদিন বেশি দূরে নয় বলেই মনে হচ্ছে।

অনেকেই একটা বিষয় বলে, যেখানে-সেখানে প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই যে অভিযোগ, এটা একান্তই চিন্তাভাবনার অদূরদর্শিতার পরিচয়। কেননা, প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউই ফ্রি পড়ছে না। সবাই টাকার বিনিময়ে পড়ছে এবং প্রাইমারি স্কুলের তুলনায় অনেক সুযোগ–সুবিধা কম পাওয়া সত্ত্বেও অভিভাবক সেদিকে ছুটছেন। তবে কেন যাচ্ছে সেখানে? শতভাগ নিশ্চয়তা নিয়েই যাচ্ছে যে এখানে পড়াশোনার মান প্রাইমারি স্কুলগুলোর তুলনায় ভালো।

এই অব্যবস্থাপনার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন প্রত্যেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঠিকভাবে স্কুলগুলো তদারকি করা। শিক্ষকদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা এবং প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনে সর্বদা সচেষ্ট থাকা, এর সঙ্গে জবাবদিহিতা বাড়ানো। শিক্ষকদের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেতন বৃদ্ধি করা, অবকাঠামো উন্নয়ন অপেক্ষা শিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া, প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মুক্ত করা, শিক্ষকের সংকট থাকলে দ্রুততার সঙ্গে সেগুলো পূরণ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো। যেহেতু বর্তমানে পিএসসি পরীক্ষা নেই, ওইভাবে ফলাফল দিয়ে মূল্যায়ন করার সুযোগও নেই। তাই নিয়মিত দেখাশোনা ও পর্যবেক্ষণ করার কোনো বিকল্প নেই এবং এ জন্য অভিভাবকদেরও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। মাঝেমধ্যে স্কুলে আসা, শিক্ষকদের কাছ থেকে সন্তানের খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে।

পাশাপাশি প্রতিটি স্কুলের কমিটির দায়িত্বশীল যাঁরা আছেন, তাঁদের আরও সৎ হতে হবে। যে কাউকে নামসর্বস্ব কমিটির সভাপতি করে দিলেই হবে না। এ জন্য প্রয়োজন সচ্ছতা ও একজন দায়িত্বশীল প্রকৃত শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি। যিনি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সব সময় বদ্ধপরিকর থাকবেন। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমাদের সম্মানিত শিক্ষকদের এ বিষয়ে সদা আন্তরিক থাকতে হবে। স্কুলের সুনাম তৈরি, স্কুলের প্রতি আস্থা বৃদ্ধিতে তাঁদের পরিশ্রম করে দেখাতে হবে। তাঁদের আন্তরিকতা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাই পারে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর পুরোনো সেই ঐতিহ্য, সুনাম ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে।

  • লেখক: মো. সায়েদ আফ্রিদী, সাবেক শিক্ষার্থী: ঢাকা কলেজ

নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]