এক সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়

১৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যা আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। কারণ, এ সন্ধ্যায় ভারতের একজন খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী বৈশাখী সেনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। অনেক দিন ধরেই তাঁর সঙ্গে দেখা পাওয়া, তাকে কাছে থেকে দেখার এবং তাঁর কথা শোনার জন্য দিবস–রজনী অতন্দ্র প্রতীক্ষায় ছিলাম। অবশেষে সেই প্রতীক্ষার অবসান হয়েছিল ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়।

বৈশাখী সেন এসেছিলেন আমাদের মধ্যে আমাদের মতো হয়ে, খুবই সাধারণ বেশে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘অনাত্মীয়কে আমরা ঢাকঢোল পিটিয়ে সাদরে গ্রহণ করি; কিন্তু বন্ধুকে হৃদয় দিয়ে এবং হৃদয়ের হাসি দিয়ে বরণ করি।’ প্রিয় শিল্পী বৈশাখী সেনকেও আমরা শুধু হৃদয় দিয়ে এবং হৃদয়ের হাসি দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলাম। ছিল না কোনো আড়ম্বর আনুষ্ঠানিকতা, ছিল না কোনো বড় আয়োজন কিংবা সাজসজ্জা। ছিল শুধু হৃদয় দিয়ে হৃদয় পাওয়া আর অসীম ভালোবাসা। সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোহনা জাহ্নবীর উদ্যোগে ও আয়োজনে বসেছিল এই সাহিত্য আড্ডা। যারা বৈশাখীর শিল্পসত্তাকে ভালোবাসে, বৈশাখীকে ভালোবাসে, তাদের জন্যই ছিল এই আয়োজন।

আমি মনে মনে ভাবছিলাম, সুচিত্রা সেনকে দেখিনি, কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনকে দেখিনি কিন্তু আমি বৈশাখী সেনকে দেখেছি। বৈশাখী সেনকে দেখা মানে হাজার ফুলকে দেখা, তার কথা শোনা মানে ঝর্ণার পাশে বসে থাকা, নির্জনে বসে পাখির গান শোনা। অনিন্দ্যসুন্দর তাঁর মুখের গড়ন যেন বিধাতা নিজ হাতে নিখুঁতভাবে যত্নœকরে গড়ে তুলেছেন, তাঁর মোহনীয় মিষ্টি হাসি সত্যি বর্ণণাতীত। সুচিত্রা সেনকে দেখেছি মুভিতে। তাঁর অভিনয় ও রূপ-সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। বনলতা সেনকে দেখেছি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। কবি জীবনানন্দ দাশের বর্ণনায় বনলতা সেনের সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ ও অভিভূত। আর বৈশাখী সেনের রূপ-লাবণ্য, সৌন্দর্য, মৃদু হাসি, তার মুখের মিষ্টি হাসি, মিষ্টি কথা, গালের টোল ও কপালের একটা ছোট্ট টিপ সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তাঁর কথা বার্তা, চালচলন সবাইকে বিমোহিত করে।

‘কথা ও কবিতায় বৈশাখী’ নামে একটি ফেসবুক পেজ আছে, সেখানে গিয়ে খোঁজ নিলেই বৈশাখীর আবৃত্তি করা অনেক কবিতার ভিডিও দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া ইউটিউব চ্যানেলে গিয়ে খোঁজ নিলেও তাঁর আবৃত্তি করা অনেকগুলো কবিতা পাবেন। তাঁর আবৃত্তি করা অনেক কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো—‘পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করা যায় না, ছাড়তে জানতে হয়, সব কথা বলতে নেই, সে মানুষটা আমার না হোক’ প্রভৃতি। তার মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের কবিতা হলো ‘সে মানুষটা আমার না হোক’ কবিতাটি। এই কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে তাঁর আবৃত্তিশৈলী, প্রকাশ, বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ, মেকআপ—সবকিছুই এককথায় অসাধারণ লেগেছে। অনেক দিন ধরেই তাঁকে দেখার ইচ্ছা পোষণ করছিলাম। যদি তাঁকে একটিবার দেখতে পেতাম! যদি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কাঁটাতার না থাকত! যদি আমাদের মধ্যে দূরত্ব না থাকত! আসলে তাঁকে কোনো দিন মুখোমুখি দেখতে পাব কল্পনাও করিনি। তবে সেই অসাধ্য কাজটিই মোহনা করে দিয়েছিল। দূরত্ব যতই হোক, ইচ্ছা থাকলে দেখা হবেই। মোহনা যখন দেখা করার একটা সময় ও দিনক্ষণ ঠিক করে দিল, তখন আমি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, আমার হাতে সময় ছিল না। ওই দিনক্ষণ অনুসারে দেখা করার কোনো সুযোগই ছিল না আমার। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আমার সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা ছিল এবং রাতে এক ক্লাসমেটের বিবাহ অনুষ্ঠান ছিল। আবার আমি এই সুযোগটাও হাতছাড়া করতে চাইছিলাম না। এই সুযোগ একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে আর তাঁকে আর পাব না। সারা জীবন আফসোস করে, না পাওয়ার বেদনায় ছটফট করতে হবে। সে যা–ই হোক, সিদ্ধান্ত নিলাম পরীক্ষা দেব না। বেঁচে থাকলে পরেও পরীক্ষা দেওয়া যাবে। কিন্তু তাঁকে তো আর পাব না। আবার কবে সে বাংলাদেশে আসবে বা আদৌ আসবেন কি না, তা জানি না। তাই হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট স্যারের সঙ্গে পরীক্ষা নিয়ে আলাপ করলাম। তিনি আমাকে পরে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দিলেন। আমি বৈশাখীর জন্য পরীক্ষা ক্যানসেল করলাম। কেবল বৈশাখীর জন্য এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিলাম।

বিকেল থেকেই মোহনাসহ আমরা কয়েকজন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিউলিতলায় বসে বৈশাখীর অপেক্ষায় রইলাম। ফোন করে জানতে পারলাম তাঁর আসতে দেরি হবে। পরে আমরা মুক্তমঞ্চে গিয়ে বসলাম। সন্ধ্যায় তাঁর আগমনের বার্তা পেলাম। অপেক্ষার ফল যে মিষ্টি হয়, তা–ও জানলাম। তাকে পেয়ে আমরা সবাই আবেগের আতিশয্যে আপ্লুত হয়ে গেলাম। তাঁর আগমনকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ কেক নিয়ে এসেছে, কেউবা এনেছেন বাঙালির বাহারি ধরনের খাবার, কেউবা নানা উপহার। আমি তাঁকে দিয়েছিলাম গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক দকমান্দা ও উত্তরীয়। জানি হয়তো এটা তাঁর কোনো কাজে লাগবে না, হয়তো ব্যবহার করবেনও না কোনো দিন। তবু স্মৃতিটুকু বেঁচে থাক, সেটাই আমার কাম্য। সেই সন্ধ্যা কবিতা আবৃত্তি, গল্প আর গানে খুব আনন্দে কেটেছে।

বৈশাখী সেন দু–একটা কবিতা আবৃত্তি করে আমাদের শুনিয়েছে। কি চমৎকার আবৃত্তি! কি মিষ্টি কণ্ঠ! আর আমার বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায় একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।’ দেখতে দেখতে আজ আমাদের শুভ সাক্ষাতের এক বছর হতে চলল। আমাদের আর দেখা হবে কি না জানি না। তবে আমি বলতে পারি, আমার জীবনে অনেক সন্ধ্যা পার করেছি, হয়তো আরও অনেক সন্ধ্যা আসবে কিন্তু এই সন্ধ্যা কোনো দিন ভুলতে পারব না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সন্ধ্যা হয়ে থাকবে ১৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যা। আজ বারবার মনে হচ্ছে, ‘জানি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম/ এমন ধন আর নাহি যে তোমা সম/ তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোড়া/ ফেলিয়া দিতে পারি না যে।’

লেখক: ক্যাথলিক যাজক, নটর ডেম কলেজ, ২ আরামবাগ, মতিঝিল, ঢাকা