লাইব্রেরিতে কেন বিসিএসের জন্য পড়েন শিক্ষার্থীরা
বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বিসিএস প্রস্তুতি নেওয়া নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লাইব্রেরিগুলোতে চাকরিসংক্রান্ত পড়াশোনা করা যাবে না, এমন একটি ঘোষণার কথা গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা যাচ্ছে। লাইব্রেরি হলো গবেষণা বা একাডেমিক পড়াশোনার ক্ষেত্র; চাকরির প্রস্তুতি গ্রহণের স্থান নয়। চাকরি প্রার্থীদের কাছে সরকারি চাকরির প্রস্তুতির মধ্যে বিসিএস পছন্দের শীর্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিসিএস পরীক্ষা তথা চাকরির প্রস্তুতিসংক্রান্ত পড়াশোনা করার জন্য কেন্দ্রীয় ও বিজ্ঞান শাখার লাইব্রেরি ব্যবহার করেন।
লাইব্রেরিগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় বা শিক্ষার্থী অনুপাতে সিট সংখ্যার তীব্র সংকট থাকায় ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কখনো–বা ভোরের আলো ফোটার আগেই লাইব্রেরিতে প্রবেশের লাইনে দাঁড়াতে হয়। নয়তো সারা দিন পড়াশোনার জন্য একটা সিট ব্যবস্থা করা যায় না। অর্থাৎ সারা দিনের পড়াশোনা শিকেয় উঠার শঙ্কা তৈরি হয়। ঢাকা শহরে স্থায়ী বাসিন্দা বা নিজস্ব বাসা থেকে লাইব্রেরিতে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের পরিমাণ নেহাত অল্প। লাইব্রেরিগুলোতে তাহলে কারা পড়তে আসেন? বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আসেন আবাসিক হলগুলো থেকে। হল ছাড়াও ঢাকা শহরের বিভিন্ন মেস ও হোস্টেল থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে পড়াশোনার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই।
স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষে সরকারি চাকরি কিংবা বিসিএস নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটার অনেক কারণ রয়েছে। যার মধ্যে চাকরির স্থায়িত্ব, সামাজিক মর্যাদা, পদোন্নতির সুযোগসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রধান। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষমতার চর্চা, সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে হয়রানি দূর করার মানসিকতাও তরুণ চাকরি প্রার্থীদের আকৃষ্ট করে। চাকরির অনিশ্চয়তা, কম ক্যারিয়ার গ্রোথ কিংবা কম সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বেসরকারি চাকরির প্রতি শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহী করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সমস্যা যেমন আবাসন–সংকট, ক্যাম্পাসে ছিনতাই, ভবঘুরে মাতাল লোকের অবাধ বিচরণ, যানজট, হলে ছাত্র নির্যাতন, মাদকের অবাধ ব্যবহার, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, যৌন নিপীড়ন, শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে জালিয়াতি অবলম্বন, র্যাঙ্কিং যথাযথ স্থান অর্জন করতে না পারা ইত্যাদি রয়েছে। কর্তৃপক্ষের ধারণা, অনেক সমস্যার মধ্যে এইটাও একটা সমস্যা যে ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি বিসিএস প্রস্তুতির জন্য ব্যবহার করছেন। কর্তৃপক্ষ সব সমস্যা সমাধানে হয়তো উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গাছের মূল কেটে পাতায় কীটনাশক ছিটানোর মতো অবস্থা তৈরি করতে চাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছেন। এ জন্য তাঁদের আবার চাকরির জন্য পড়াশোনা করতে হচ্ছে। কিছুটা অস্বস্তি বোধ হয়তো তাঁরা এখন করছেন যে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনা তাঁদের বাস্তব জীবনে কোনো কাজে দিচ্ছে না। শুধু কাগজের সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরিতে আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছে। শ্রেণি কক্ষে কেন একজন শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জন কিংবা দক্ষতা অর্জনের মানসিকতা সৃষ্টি হয়নি। পড়াশোনার নাজেহাল অবস্থার জন্য দায়ী কি শুধু শিক্ষার্থীরা? বিশ্ববিদ্যালয়ের কি এতে কোনো দায়বদ্ধতা নেই?
লাইব্রেরিতে বিসিএস প্রস্তুতির জন্য প্রবেশের আগে শিক্ষার্থীরা কতগুলো প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। দেশে গবেষণায় সফল ছাত্রছাত্রীদের চাকরির নিশ্চয়তা কতটুকু? রাষ্ট্র কি বিষয়ভিত্তিক দক্ষ প্রার্থীদের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে চাকরির ব্যবস্থা করছে? গবেষণাসংক্রান্ত কাজ করে কি পরিবারের হাল ধরা যাবে? বেকারত্ব দূর করা যাবে? তিনবেলা খাবারের খরচ জোগাতে হিমশিম খাওয়া শিক্ষার্থী কিংবা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অতিষ্ঠ সংসারের আশার আলো সাধারণ শিক্ষার্থীর পক্ষে গবেষণাকর্মে মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাকরির ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড কিংবা তোষামোদির তুলনায় গবেষণাকে কতটা মূল্যায়ন করা হয়, তা গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসী জ্ঞাত আছে। এ ছাড়া সরকারি চাকরির পরীক্ষায় জালিয়াতি, ডিভাইসের ব্যবহার চাকরি প্রার্থীদের অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক গৃহীত বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের শতভাগ আস্থা রয়েছে।
সামাজিক মর্যাদা, বেতন-ভাতা, পদোন্নতি সার্বিক বিবেচনায় একজন শিক্ষার্থী পেশা হিসেবে ক্যাডার সার্ভিসকে বেছে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তাঁদের অধিকাংশই ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করতে পারেন না কিংবা সম্ভব হয় না। কিন্তু বেশির ভাগই যেকোনো চাকরির ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন। যার জন্য প্রয়োজন হয় নিবিড় পড়াশোনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম তো শিক্ষার্থীদের এমন দক্ষতাসম্পন্ন করতে পারে, যাতে পড়াশোনা ছাড়াই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়া যায়।
বিষয়ভিত্তিক দক্ষতাসম্পন্ন প্রার্থীদের চাকরির নিশ্চয়তাও বিদ্যমান সিস্টেমে পাওয়া যায় না। তাই ছাত্রছাত্রীরা বাধ্য হয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে কিংবা শেষ করার আগেই চাকরির প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেন। লাইব্রেরিতে যদি সুযোগ প্রদান করা না হয়, তবে প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে উঠে আসা একজন শিক্ষার্থী, যার ঢাকা শহরে মাথা গোজার ঠাঁই নেই, সে পড়াশোনাটা করবে কোথায়। সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে পড়াশোনাটা করতে চাওয়া তো কোনো অপরাধ নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশের একজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। তিনি আফসোস করে বলেন, তিনি তাঁর নিজস্ব বৈজ্ঞানিক কর্ম না করে যদি উক্ত বিষয়ে কবিতা লিখতেন, তাহলে তিনি বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য হতেন কিন্তু এখন তাঁকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে ভাবা হচ্ছে না। অর্থাৎ তাঁর গবেষণা কর্মকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৩ লাখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একজন শিক্ষার্থীর একটি চাকরির ব্যবস্থা করতে তিন থেকে চার বছর সময় ব্যয় হয়।
গবেষণাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে ছাত্রছাত্রীদের লাইব্রেরিতে গবেষণাকর্ম করতে আগ্রহী করার প্রয়াস কর্তৃপক্ষের অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত সব শিক্ষার্থীর চাহিদার কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। প্রকৃতপক্ষেই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে স্থানের সংকুলান হচ্ছে না; তাই বলে চাকরিসংক্রান্ত পড়াশোনা যাতে জ্ঞানও অর্জিত হয়, তা বন্ধ করা উচিত হবে না। পড়াশোনায় বাধা না দিয়ে লাইব্রেরির পরিধি বৃদ্ধি কিংবা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনুরোধ জ্ঞাপন করছেন।
লেখক: এম এম উজ্জ্বল, সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মেটা ও এক্সসার্প্ট: নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]