অতি বিকশিত আমলাতন্ত্র এবং নীরব প্রতিবিপ্লব
ঢাকার রাস্তায়, সচিবালয়ের সামনে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের দেয়ালের ভেতরে ও বাইরে চারদিকে হঠাৎ বিভিন্ন রকম আন্দোলনে ভরে গেছে। সবার প্ল্যাকার্ডে বৈষম্য শব্দটি আছে। শব্দটি ব্যবহার মিথ্যা নয়, কেননা স্বৈরাচারের আমলে দুর্বলের শোষণ এবং সবলের তোষণ হয়েছে। সরকারের বাহুশক্তি অত্যন্ত শক্তিশালী হলেও সরকারের ভেতরে ছিল ব্যাপক প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা। নতুন সরকারের ১৫ দিন না যেতেই সচিবালয় ও সরকারি দপ্তর ঘিরে এতো আন্দোলন সংগ্রাম বিগত সরকারের প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার লক্ষণ হিসেবে দেখতে পারি। বিপ্লবী সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরাচার মুক্ত করার লক্ষ্যে সংস্কারের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছে। সেই লক্ষ্য অর্জনে এই প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার সতর্ক বিশ্লেষণের পাশাপাশি ছাত্র-জনতার অর্জিত বিপ্লবের বিপরীতে নীরব প্রতিবিপ্লবের উপাদান অনুসন্ধানের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর গুনে গুনে ঠিক ষষ্ঠ কার্যদিবস অর্থাৎ ১৩ আগস্টে সরকারি একটি প্রজ্ঞাপনে দেখা গেল ১১৭ (সংশোধিত ১১৪) জন প্রশাসনের কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ (আগের কোনো তারিখে কার্যকর) উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ১৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ১৫টি বিসিএসে বাদ পড়া ২৫৯ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দেয় সরকার। ১৮ আগস্ট আরেকটি আদেশে ১৩ আগস্টে পদোন্নতিপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তাসহ ২০১ জন যুগ্ম সচিব হিসেবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির আদেশ জারি হয়। ১৭ আগস্ট ৫ জন কর্মকর্তাকে চুক্তি ভিত্তিক সচিব নিয়োগ দেওয়া হয় এবং একই তারিখের স্মারক প্রতিস্থাপন করে আবার সেই ৫ জনকেই সিনিয়র সচিব করা হয়। পত্রিকায় এমন খবর দেখে মনে হওয়াই স্বাভাবিক পদ ও পদোন্নতির মহা–উৎসব শুরু হয়েছে। যাঁদের দেওয়া হয়েছে, তাঁদের সবাই নিজেদের বঞ্চিত দাবি করছেন। সত্যি, বিগত সরকারের আমলে বিভিন্নভাবে অনেক কর্মকর্তা অনেক বঞ্চিত হয়েছেন। তবে অবশ্যই এখানে অনেকে আছেন যাঁরা বিভিন্ন আর্থিক ও বিবিধ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকতে পারেন। বৈষম্য নিরোধের জোয়ারে সেই সব সুযোগসন্ধানী যে এর মধ্য নাই, তা এই স্বল্পতম সময়ে নিশ্চিত করা হয়েছে কি না, সন্দেহের অবকাশ আছে।
একই সময় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ অথবা মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের কোনো পদোন্নতির আদেশ আমরা দেখি নাই। ২১ আগস্ট ডাক ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন অভিযোগ করেছে, ‘অন্যান্য ক্যাডারের ৩৭তম ব্যাচ ২০১৯ সালে নবম গ্রেডে যোগদানের পর ফিডার পদে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২০২৪ সালে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পেয়েছে। অপর দিকে ডাক ক্যাডারের ৩৩তম ব্যাচ ২০১৪ সালে যোগদান করে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে (ষষ্ঠ) পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও ১০ বছরের অধিক সময় ধরে নবম গ্রেডেই কর্মরত আছেন। এ রকম আরও অনেকই রয়েছেন।’
সচিবালয়ের আশপাশে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন রাস্তায় বেশির ভাগ আন্দোলনই চাকরিকেন্দ্রিক। বিগত সরকারের আমলে বঞ্চিত ব্যক্তিরা বিভিন্ন তদবিরে ছোটখাটো ফোঁসফাঁস করলেও প্রতিপত্তিশালীদের ভয়ে কেউই তেমন আন্দোলন সংগ্রাম করার সাহস করতেন না। সরকার পতনের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংস্কার বিষয়ে কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের আন্দোলন করতে দেখা গেছে। যেমন, পুলিশ ও এনবিআর। কিন্তু উপসচিবদের এমন এলাহি পদোন্নতির আদেশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চাকরিতে অথবা চাকরিপ্রাপ্তিতে বঞ্চিতদের আন্দোলনে সব সরকারি দপ্তর–প্রতিষ্ঠান উত্তাল হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ জনপ্রশাসনের পদোন্নতির আদেশগুলোর সঙ্গে এসব আন্দোলন সংগ্রামের সম্পর্ক অনুমান করে নেওয়া যায়। বিপ্লবী সরকারের মাত্র ১৫ দিন হলো, সব সমস্যার সমাধান তারা এত অল্প সময়ে করতে পারবে না। কিন্তু জনপ্রশাসনে যদি এত অল্প সময়ে এত বঞ্চনা, বৈষম্য ও অবিচারের সমাধান হওয়া সম্ভব হয়, তাহলে অন্যদের বেলায়ও কেন সম্ভব হবে না?
এখানেই প্রশ্ন জাগে মনে, বর্তমান বিপ্লবী সরকারের সুবিবেচনা ও অনুমোদনে কী এসব পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে?
শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীর সঙ্গে সম আচরণ করতে হবে। তার সততা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও অর্জনকে আবশ্যিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
চাকরি ক্ষেত্রে শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের সঙ্গে আমাদের দেশের অতি বিকশিত এবং শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এই আমলাতন্ত্রের মধ্যে বিশেষত প্রশাসন ক্যাডারসংখ্যা ও শক্তিতে বিশেষভাবে অতি বিকশিত। মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন। তাঁদের দাপটে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ক্যাডারেরা অথবা নিজস্ব কর্মকর্তা কর্মচারীকে তটস্থ থাকতে হয়। খুব কম প্রতিষ্ঠানেই সময়মতো পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। বদলিসহ বিভিন্ন ক্ষমতা ব্যবহার করে সবাইকে তটস্থ রাখা হয়। প্রতিটি দপ্তর ও সংস্থায় প্রশাসন ক্যাডার হতে প্রেষণে আসা কর্মকর্তাগণ একটি আলাদা কমিউনিটি। যাঁদের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত। কিন্তু ন্যায়বিচার হল সবার প্রতি আইন ও বিধান অনুযায়ী সম আচরণ।
এই ন্যায়বিচার গত সরকারগুলোর আমলে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। বিগত সরকারগুলোর আমলে প্রশাসন ক্যাডার ও পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা পদ না থাকলেও সুপার নিউমেরি পদে নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর–সংস্থায় অধিকাংশ উচ্চ পদগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের সুবিধার্থে সেই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা করেছেন। ক্ষমতা ও দুর্নীতির সুবিধার বিনিময়ে স্বৈরাচার সরকারের হাতকে শক্তিশালী করেছেন। হাজারো কোটি টাকার যে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো তাঁদের দস্তখতেই হয়েছে। কারণ, তাঁরাই ছিলেন প্রায় সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ, দপ্তর এবং সংস্থার দায়িত্বে। স্মরণ করতে পারি, দুর্নীতি খুঁজতে যাওয়ার অপরাধে প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনাকে অপদস্থ ও জেলে পাঠিয়েছেন ক্যাডার কর্মকর্তারা। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪–সহ সব সাজানো নির্বাচন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বাস্তবায়ন করেন নাই। সাজানো নির্বাচন হয়েছে নির্বাচনের দায়িত্ব থাকা জেলা ও উপজেলায় কর্মরত প্রশাসন ক্যাডারের রিটার্নিং অফিসার, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ডিসি) ও ম্যাজিস্ট্রেসির দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনারদের মাধ্যমে। সাজানো নির্বাচন সংবিধানিক অপরাধ। সাজানো নির্বাচনে প্রশাসন কর্মকর্তাদের ভূমিকা অস্বীকার ও গোপন করার কোনো সুযোগ নাই। সংবিধানের প্রতি আনুগত্যকারী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী রাজনৈতিক চাপে এবং পেটের দায়ে সাংবিধান ভঙ্গ ও বেআইনি কাজ করেছেন এমন অজুহাত স্থূল ও অগ্রহণযোগ্য। অভিযোগ আছে অনেক ডিসি আওয়ামী লীগের নির্বাচন সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৪ সালের অনেক ডিসি এখন সচিব, অতিরিক্ত সচিব অথবা যুগ্ম সচিব। সারা দেশের আন্দোলন দমনের নামে হত্যায় দায় পুলিশের একার নয়। আন্দোলন দমন ও হত্যায় সাদা শার্ট পরিহিত প্রশাসনের কর্মকর্তাগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। এখন শুধু নয়, ১৯৭১ সালেও ঠিক একইভাবে আমলারা স্বধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী উভয় সময়ের সুবিধাভোগী ছিলেন।
ছাত্রদের এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই, সেই সাদা শার্ট পরিহিত প্রশাসন ক্যাডারের অনেক বঞ্চিত কর্মকর্তারা ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যখন জনপ্রশাসনে এমন আদেশ হচ্ছে, তখন দেশের স্কুল কলেজের ছেলেমেয়ে রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছেন, ট্রাফিক সামলাচ্ছে এবং পিলারে রং করছেন। আহত ছাত্র জনতা হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। এ অবস্থায় কোনো কোনো গণকর্মচারীর বঞ্চনা থেকে মুক্তির এমন মিষ্টি বিতরণ ও অভিনন্দন কেমন ভব্য দেখায় তা বোঝার চেষ্টা করার প্রয়োজন আছে। আমরা যদি ভাবি, এমন ঘটনা আসলে সরকার পতন ও নতুন সরকারের দায়িত্বগ্রহণের স্পর্শকাতর সময়ের সুযোগ নেওয়া হয়েছে, তাহলে কী খুব ভুল হবে?
১২ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা তার বিশেষ সহকারী হিসেবে আলী ইমাম মজুমদারকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ১৬ আগস্ট তাকে উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তিনি শপথ নেন। আলী ইমাম মজুমদার বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তাঁর অনেক নামডাক আছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনিও প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে বিশেষ সহায়তা করবেন। তিনি আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার সিন্ডিকেট ভাঙতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করবেন, সেই বিষয়ে আশা করাই যায়।
সরকারের পতনের পর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। এমন অভিযোগের পর, বিশেষ পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ এবং প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে রেখে পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশনের আইন সংশোধনের আলাদা আলাদা অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। তারপর ১৯ আগস্ট হতে বিভিন্ন আদেশে ৮৯৮ জন জেলা, উপজেলা, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধি অপসারণ করে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নিয়োগ প্রদান করা হয়। আমাদের প্রশ্ন করা উচিত, যাঁদের অপসারণ করা হয়েছে, তাঁদের নির্বাচিত করার সাজানো নির্বাচনের সময় কারা দায়িত্বে ছিলেন? আমরাই উত্তর দিতে পারি, প্রশাসক নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিই অপসারিত ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার সময় দায়িত্বে ছিলেন।
একই সময় ২০ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সব বেসরকারি স্কুল ও কলেজের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিদের অপসারণ করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদের নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, ইউএনওরা। তবে সভাপতি অপসারণ হলেও কমিটির অন্যান্য সদস্য অপরিবর্তিত থাকবেন।
এই দুইটি ঘটনায় একটি বিশেষ দিক হল দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ওপর আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্ভরশীলতা বেড়ে গেল। আমাদের এই নির্ভরশীলতা তাঁদের আরও ক্ষমতাশালী করল। এ প্রসঙ্গে আমরা সেই ঐতিহাসিক প্রশ্নটি করতে পারি, বিকল্প কী আর করার ছিল? শেখ হাসিনার বিকল্প কে বা কারা হতে পারে, শিক্ষার্থীরা তার জবাব ইতিমধ্যে দিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় সরকার পরিষদগুলোতে নির্বাচিত (সাজানো) প্রতিনিধি যদি উৎপাটনের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে অনেকগুলো বিকল্পই ছিল। যেমন, পরিষদগুলোতে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া স্থানীয় ছাত্রদের দিয়েই একটি অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠন করা যেত। অথবা, স্থানীয় গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ও ছাত্র সমন্বয়ে একটি অন্তর্বর্তী পরিষদ গঠন করা যেত। অথবা, বর্তমান পরিষদের উপস্থিত ব্যক্তিকে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করা যেত। অথবা…আরও আছে। আবারও প্রশ্ন করতে পারি, বাচ্চা বাচ্চা ছাত্ররা কী পারবে? উত্তর হল, ছাত্ররা এখন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন, তাই, স্থানীয় সরকারেও তাঁরা দায়িত্ব পালন করতে পারতেন।
একই ভাবে, স্কুলের সভাপতিকে বরখাস্ত না করে তাঁদের নিজেদেরই পুনর্গঠন করার প্রজ্ঞাপন জারি করা যেত। অথবা, অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য জেলার শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষক, শিক্ষা অফিসার, শিক্ষা পরিদর্শককে দায়িত্ব প্রদান করা যেত।
সর্বোপরি জনপ্রতিনিধি অপসারণ এবং স্কুল কমিটির সভাপতি অপসারণ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নাগরিক ও রাজনৈতিক সংলাপের আয়োজন করতে পারতেন। এত তাড়াহুড়া করে এমন বিষয়গুলোতে কেন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে? এভাবেই কী ভবিষ্যৎ সিন্ধান্তগুলো নেওয়া হবে?
শোষণ–বঞ্চনার পাশাপাশি, সরকারের সার্বিক অদক্ষতার জন্য অতি বিকশিত আমলাদের ভূমিকা রয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা বদলি ও প্রেষণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও সংস্থায় নেতৃত্ব দিতে যান। নতুন প্রতিষ্ঠানের কাজে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে তাঁরা মন্ত্রণালয়ের কাজের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও), ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও), আর কম্পিউটার অপারেটসহ (সিও) বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। কোনো নথিতে নাই কিন্তু কথিত আছে এও, পিও আর সিওরাই মন্ত্রণালয় চালান। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞগণের মতামত তাঁরা প্রকৃত অর্থে বুঝতে পারেন না। তবে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, তাঁদের পাশে থাকা স্বল্প দক্ষ চাটুকারদের সহজ কথাগুলো সহজে বোঝা যায়। ফলে চাটুকারেরা অধিক সুবিধা পান। এ ক্ষেত্রে, দেশের জন্য দুঃখজনক হলো মন্ত্রণালয়গুলোতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সংশ্লিষ্ট ক্যাডার এবং পেশাজীবীরা থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিতে পারেন না। মন্ত্রণালয় বা বিভাগ হলো সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সরকারে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান। এখানে যদি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সবচে ভালো কর্মকর্তা নীতিনির্ধারণী নেতৃত্ব দিতে না পারেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সরকারের অবস্থা হাতুড়ে ডাক্তারের মতো হয়। প্রশাসনের ক্যাডারেরা পিএসসি পরীক্ষায় প্রথম দিকের রেজাল্টধারী হওয়ার দাবি করলেও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের জ্ঞান ও কর্ম অভিজ্ঞতায় অর্জিত বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সঙ্গে তা গুলিয়ে ফেলা যাবে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিকিৎসককে স্বাস্থ্য বিভাগ চালাতে দিতে হবে। শিক্ষার মানুষজনকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চালাতে দিতে হবে। বিশেষায়িত ক্যাডার ও বিশেষায়িত কর্মচারী গড়ে তুলতে হবে। বিধিবিধান মেনে সব সরকারি চাকরেকে সময়মতো পদোন্নতি দিতে হবে। তাহলে একদিকে যেমন সরকারের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দক্ষতা বাড়বে অন্যদিকে কোনো একটি ক্যাডার কমিউনিটি অতি বিকশিত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কমে যাবে।
আমাদের ভয় হলো, আমরা ৭১–এর পর ভেবেছিলাম, স্বাধীন হয়েছি কিন্তু ক্রমেই সরকারব্যবস্থা একনায়কতান্ত্রিক হয়ে গেছে। ১৯৯০–তে ভাবলাম দেশে গণতন্ত্র ফিরে এল, কিন্তু কয়েকটি নির্বাচন ঠিকমতো হলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি আমরা পাইনি। ২০২৪ সালে ভয়ংকর পরাক্রমশীল স্বৈরাচারী সরকারকে হাজার ছাত্র জনতার আত্মত্যাগের বিনিময়ে উৎখাত করার পর, আমরা, আবার কী সেই পুরোনো চক্রে ফিরে যাবে? এ জন্য, শুধু রাজনৈতিক দলের দিকে আঙুল দিলে আমাদের ভুল হবে। যারা রাজনৈতিক সরকারকে বারবার স্বৈরতান্ত্রিক হওয়ার সুযোগ করে সুবিধা নিচ্ছে ঐতিহাসিক কাল ধরে, তাদের দিকে আমাদের সাহস করে আঙুল তুলতে হবে। বিপ্লব হলে প্রতিবিপ্লবও হতে পারে। স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গিরা বিপ্লবী সরকারের চেয়ে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠা প্রতিবিপ্লবের একটি আশু লক্ষণ বলে বোধ হয়।
লেখক: মো. জাহিদুল ইসলাম
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]