রিমির জ্বরঠোসা

জ্বরঠোসা
ছবি: সংগৃহীত

রিমি পরিবারের সবার ছোট না হলেও বোনদের মধ্যে ছোট। ওর ছোট আরও দুই ভাই আছে। কিন্তু কেন যেন বাসার সবাই রিমিকেই সবচেয়ে ছোট ভাবে। আর এ কারণে রিমি একটু বেশি আদুরি। রিমিরা চার বোন ও তিন ভাই। সবার বড় সিমি আপা। বড়দা খোকন সিমি আপার ছোট।

এরপর দুই বোন—মিমি আর ঝিমি। মিমি, ঝিমি ও রিমি পিঠাপিঠি। শিপন, রিপন ওদের ছোট দুই ভাই। মা-বাবাসহ নয়জনের এক জমজমাট পরিবার ওদের। ওরা যে পাড়ায় থাকত, সেখানে থাকতেন ওর এক মামা, খালা, খালাতো বোনসহ বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। রিমিদের বাসায় সব সময় তাই লেগে ছিল হইহুল্লোড়; একটা উৎসব উৎসব ভাব।

রিমি ছোটবেলা থেকেই বেশ ফুটফুটে। মাথাভর্তি চুল, মায়াভরা চোখ, আর লক্ষণীয় ছিল ওর ভুবনভোলানো মিষ্টি হাসি। যে কেউ ওকে দেখলে কোলে নিতে চাইত। কারও যেন মন্দ নজর না লাগে, সে কারণে ‘মা’ ওর কপালে ছোটবেলায় কাজল পারতেন। বড় বোন সিমি অপার কাছে ও ছিল একটা খেলার পুতুল। ওর প্রতি ছিল বিশেষ খেয়াল, সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতেন সব সময়।

মিমি আর ঝিমি, রিমির পিঠাপিঠি হলেও ওরাও রিমিকে আদর করত ছোট্ট বাবু মনে করে। তবে, অতি আদরে রিমি কখনো বিগড়ে যায়নি, বিরক্তির কারণও হয়নি কারও কাছে। বরং ওর বিনয়ী আর মিষ্টি আচরণের কারণে সবার কাছে ছিল ভীষণ প্রিয়।

মায়ের কাছে শোনা—ওর বয়স যখন দশ বছর, বেশ ঠান্ডা লেগেছিল, তার সঙ্গে প্রচণ্ড জ্বর। মা খেয়াল করলেন, রিমির ওষ্ঠের ঠিক মাঝখান বরাবর একটা লাল দাগ দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওটা ফুসকুড়ির মতো হয়ে গেল আর ঠোঁটটা ফুলে হয়ে গেল ঢোল। সবাই, বিশেষ করে মা, বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। দেরি না করে পাড়ার পরিচিত ডাক্তার রহমান কাকার চেম্বারে নিয়ে যান। ডা. রহমান এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয় এবং ছেলে–বুড়ো সবার কাকা তিনি। দারুণ হাতযশ, চিকিৎসক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূরদূরান্তে।

নামীদামি ডাক্তার-কবিরাজ, পীর-ফকির দেখিয়ে ব্যর্থ অসংখ্য রোগী ডা. রহমানের চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছেন। তাঁর কাছে গেলেই রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যেতেন তাঁর সৌম্য ব্যক্তিত্ব, অমায়িক আর আন্তরিক ব্যবহার দেখে। সব সময় হেসে হেসে কথা বলতেন আর সেই হাসি সংক্রমিত করতেন ওনার সংস্পর্শে আসা লোকেদের মাঝে।

রিমির মাকে চেম্বারে দেখে ডা. রহমান তাঁর স্বভাবসুলভ আন্তরিকতায় স্বাগত জানালেন। জানতে চাইলেন, কী হয়েছে মেয়ের? মা সবিস্তার বললেন। রিমিকে বেশ নিবিড়ভাবে দেখলেন তিনি। তারপর ডা. সাহেব তাঁর বিখ্যাত সেই হাসি দিয়ে বললেন, এমন কিছুই হয়নি, চিন্তার কোনো কারণ নেই।

মায়ের মন; ডাক্তারের নিশ্চয়তার পরেও আশ্বস্ত হতে চায় না। জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এমনটা হলো? ডা. রহমান বেশ সময় নিয়ে মাকে বোঝালেন। তিনি বললেন, রিমির ঠোঁটে ফুসকুড়ির মতো যেটা দেখা যাচ্ছে, প্রচলিত ভাষায় একে বলে জ্বরঠোসা আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম ফিভার ব্লিস্টার বা কোল্ড সোর। হারপিস সিমপ্লেক্স টাইপ-১ নামের একধরনের ভাইরাস এর জন্য দায়ী। শরীরে কোনো কারণে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলে, যেমন কোনো সংক্রমণ বা জ্বরের পর এমন সমস্যা সাধারণত বেশি হয়।

প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষই এ ভাইরাসে আক্রান্ত থাকেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং ১০ বছর বয়সে প্রথম প্রকাশ পায়। প্রথমবার হওয়া এ জ্বরঠোসা সেরে যাওয়ার পর এ ভাইরাস স্নায়ুকোষে লুকিয়ে থাকে এবং বাকি জীবনে বারবার এর প্রকাশ ঘটতে পারে।

সাধারণত ৭ থেকে ১৪ দিন এ রোগের উপসর্গ থাকে, তবে ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যে জ্বরঠোসা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। ১৪ দিনের মধ্যে জ্বরঠোসা সেরে না গেলে এবং ব্যথা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। রিমিকে দেখে ডা. সাহেব বললেন, আপাতত কোনো ওষুধের দরকার নেই।

আক্রান্ত স্থানে বরফ লাগালে ও কিছুটা আরাম পাবে। আর খেয়াল রাখতে হবে, জ্বরঠোসায় যেন কোনোভাবেই নখ না লাগায়। এক সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি সেরে না গেলে একটা অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম ব্যবহার করার কথা বললেন তিনি। ভিটামিন সি জ্বরঠোসা প্রতিরোধে ভীষণ কার্যকর, তাই তিনি রিমিকে নিয়মিত লেবু ও আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ানোর পরামর্শ দিলেন।

রিমির বেলায় হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস অনেকবারই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যখনই ও একটু তীব্রভাবে জ্বর-ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়েছে, এর পরপরই জ্বরঠোসা এসে বাসা বেঁধেছে। যদ্দিন মায়ের কাছে ছিল রিমি, যা করার মা–ই করতেন—বরফ লাগিয়ে দেওয়া অথবা ক্রিম। সেই ছোটবেলায় রিমির জ্বরঠোসা হলে ওর অন্য ভাইবোনেরা বেশ খুনসুটি করত এটা নিয়ে, কেননা রিমি তখন ওর সৌন্দর্য নিয়ে বেশ সচেতন ছিল আর এ রকম পরিস্থিতিতে ও নিজেকে আড়াল করতে চাইত। এ রকম বেশ কয়েকবার হয়েছে, জ্বরঠোসা হওয়ার পরে রিমি দু-তিন দিন ঘর থেকেই বের হয়নি। আর ওর দুষ্ট ভাইবোনগুলোর কাজ ছিল একটু পরপর ওকে খোঁচানো।

অনেক দিন আগের এক ঘটনা। রিমি তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এই প্রথম তার সহশিক্ষার অভিজ্ঞতা। এর আগে স্কুলে কিংবা কলেজে তার সহপাঠীরা ছিল সব মেয়ে।

রিমি বুঝতে পারে তার প্রতি অনেক ছেলেদের আগ্রহ; কেউবা দূর থেকে অনুসরণ করে ওকে, কেউ আবার ওকে ইমপ্রেস করার জন্য চালিয়ে যায় নিরলস প্রচেষ্টা। বিষয়গুলো রিমি বেশ উপভোগ করে। কিছুদিনের মধ্যে ইনকোর্স পরীক্ষার তারিখ পড়ে। আর ওই সময় কিনা তার ঠোঁটে জেঁকে বসে বেরসিক জ্বরঠোসা। রিমি কাঁদতে কাঁদতে অস্থির।

কিছুতেই এই চেহারা নিয়ে সে পরীক্ষা দিতে যাবে না। ওর মা আর বোন মিমি অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে ওকে রাজি করায়। মিমি বেশ কায়দা করে মেকওভার করে জ্বরঠোসায় আক্রান্ত ঠোঁটের ওই স্থান ঢেকে দিতে সক্ষম হয়।

আস্তে আস্তে সময় গড়িয়েছে, রিমির নিজের সংসার হয়েছে। এখন জ্বরঠোসা হলে নিজের যত্ন নিজেরই নিতে হয়। তখন মায়ের কথা খুব করে মনে পড়ে। শারীরিক যন্ত্রণা সে রকম না হলেও এ সময়ে ভীষণ বিরক্ত থাকে রিমি। কেননা, ও জানে ওর সুন্দর মুখশ্রী কেমন পাংশু দেখায় এই কারণে। মনে হয়, এটা যেন চাঁদের কলঙ্ক!

লেখক: সাজ্জাদুল হাসান। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত।