সিলেটে আকস্মিক বন্যা কি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে

সিলেটের বন্যাফাইল ছবি

কয়েক মাস আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভারী বৃষ্টিপাতে বন্যা দেখা দেয়। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বমতে, সেখানকার রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের মতে, রেকর্ড বৃষ্টিপাতের প্রধান কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। বায়ুমণ্ডল স্বাভাবিকের থেকে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হলে তা ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে, যা ভারী বৃষ্টিপাতের প্রধান কারণ। লন্ডনের গ্রান্থাম ইনস্টিটিউটের ফ্রেডেরিক অটো বলেন, ক্রমাগত জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে অনেক অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার ঘটনা আরও বৃদ্ধি পাবে।

সাগর কিংবা মহাসাগরের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ হয়ে উঠলে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যেতে পারে। যার ফলে হতে পারে আকস্মিক বন্যা। আকস্মিক বন্যা হলো তীব্র এবং হঠাৎ বন্যা, যা অল্প সময়ের মধ্যে প্রবল ও ভারী বৃষ্টিপাত ঘটে থাকে। গত মে মাসে সিলেটে কয়েক দিন ভারী বর্ষণ অব্যাহত ছিল। বৃষ্টির পাশাপাশি উজানের ঢলে নেমে আসা পানিতে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বন্যা দেখা দেয়। ৮ জুন রাতে আবার টানা বর্ষণ শুরু হয়। একটানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে সিলেট শহর প্লাবিত হয়ে শহরের কোথাও হাঁটুসমান পানি দেখা দেয়। সুরমা নদীর পানি কোনো কোনো স্থানে বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হয়েছিল। সিলেটে ২০২২ সালে প্রলয়ংকরী বন্যার ক্ষত এখনো রয়ে গেছে। গত বছরও ভারী বর্ষণ এবং উজানের ঢলের কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার আশঙ্কা ছিল। মূলত কয়েক বছর ধরে সিলেটে এমন ভারী বৃষ্টিপাত দেখা দিচ্ছে। আগে যেমন বর্ষাকালজুড়ে হালকা বা মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিপাত হতো, এখন আর তা হয় না। এখন দীর্ঘ সময় বৃষ্টিহীন থাকার পর একসঙ্গে ভারী বর্ষণ হয়, যা সিলেটে কয়েক বছর ধরে ঘটছে। দেখা যায়, এই বুঝি পানি নেমে গেল, আবার বৃষ্টির কারণে তা বেড়ে যাচ্ছে। এর বিভিন্ন কারণও রয়েছে, তবে মানবসৃষ্ট কারণ কম নয়।

গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে সারা বিশ্বে গড় বৃষ্টিপাত বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার বৃষ্টিপাতের ধরনে বিরূপ প্রভাব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ভবিষ্যতে এ বৃষ্টিপাত আরও প্রবল হবে বলেও আশঙ্কা করছেন। ভারত ও বাংলাদেশের ওপর এক গবেষণায় দেখা যায়, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এক দিনের ভারী বৃষ্টিপাতের পরিমাণ গত চার দশকে চার গুণ বেড়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ভারতের মেঘালয়, আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়, ২০৫০ থেকে ২০৭৯ সাল পর্যন্ত এক দিনের ভারী বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে।’

তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে স্বভাবত ভারত মহাসাগর বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তাই মৌসুমি বায়ু বেশি শক্তিশালী হয়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে। ফলে বিশ্বের প্রধান নদী অববাহিকা, তীরবর্তী দেশ ও অঞ্চলগুলোতে বাড়ছে বন্যা। এ ছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিমবাহের গলন বৃদ্ধি পায়। তাই হিমালয়ের নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভারত ও বাংলাদেশের যথাক্রমে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে দ্রুত প্লাবিত হয়। অল্প জায়গায় অতিরিক্ত বৃষ্টির জন্য বন্যার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে বন্যার তীব্রতা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মূলত বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত প্রাক্‌–বর্ষার ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। ‘স্টেট অব দ্য ক্লাইমেট ইন এশিয়া’ নামক ডব্লিউএমওর ওই রিপোর্টের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে ৭৯টি জলসংক্রান্ত বিপর্যয় ঘটে, যার সিংহভাগই ছিল বন্যা এবং ঝড়ের ঘটনা। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটেরোলোজির জলবায়ু গবেষক রক্সি ম্যাথিউ কোল বলেন, গত কয়েক দশক ধরেই মৌসুমি বাতাসের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। এ কারণে বর্ষাকালজুড়ে হালকা বা মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিপাতের পরিবর্তে দীর্ঘ সময় বৃষ্টিহীন থাকার পর একসঙ্গে ভারী বর্ষণ হয়। এমন অঘটনের জন্য প্রাকৃতিক পরিবর্তন যতটুকু দায়ী, মানুষের কাজকর্মের দায়ভার তার চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। পুকুর, জলাশয়, নদ-নদী  ভরাট করে গড়ে তুলেছে কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি। ফলে অতিবৃষ্টিতে জল যখন বাড়ছে, তখন নির্ধারিত গণ্ডি ছাপিয়ে জলে ভেসে যাচ্ছে আশপাশের এলাকা। ভূপ্রাকৃতিকভাবে স্পর্শকাতর এলাকা যেমন টিলা কিংবা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে মানুষের চলাচলের রাস্তা বিস্তৃত করা হয়েছে। তাতে উপযুক্ত ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ নেই। তাই বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেলে সৃষ্টি হয় বিরাট ভূমিধসের। ফলে পানির গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতপ্রবণ এলাকা ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি। তার পাশেই সিলেট জেলা সীমান্ত। তাই মেঘালয় কিংবা আসামে প্রবল বৃষ্টি বা বন্যা হলে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে সহজেই সিলেট এবং সুনামগঞ্জ প্লাবিত হয়ে যায়। উজান থেকে নেমে আসা পানিকে উজান ঢল বলে, যা ভারত থেকে নদী দিয়ে প্রবল স্রোতে সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীতে এসে মিশে হঠাৎ করে নদীর পানি বেড়ে যায়। ফলে সুরমা নদী উপচে নদী তীরবর্তী জনপদ প্লাবিত হয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জ বন্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া প্রাকৃতিক জলধারা যেমন নদী, খাল, ছড়া ও হাওর পলিমাটিতে ভরাট হয়ে যায়। ফলে সিলেট ও সুনামগঞ্জে প্রায় প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যা লেগেই থাকে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সমুদ্র উপকূলের মতো এই অঞ্চলের মানুষেরও ক্লাইমেট রিফিউজি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

রয়্যাল মেটিওরোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত সমীক্ষা অনুযায়ী, এক দিনের ভারী বৃষ্টিপাতের ঘটনা মাঝারি থেকে দীর্ঘ মেয়াদে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলে চরম বৃষ্টিপাতের সবচেয়ে খারাপ ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটতে শুরু করেছে। অদূর ভবিষ্যতে কার্বন নিঃসরণ কমে গেলেও আগের জলবায়ুগত পরিস্থিতিতে ফিরে আসা চ্যালেঞ্জিং হবে। অথচ কার্বন নিঃসরণ কিংবা জীবাশ্ম জ্বালানি তো কমছেই না; বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে।

আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খরার প্রকোপও বাড়বে। উষ্ণতার জন্য জল আরও বেশি করে বাষ্প হবে, তাই মাটিতে জলের অংশ কমবে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ৪ ডিগ্রিতে পৌঁছালে পৃথিবীর স্থলভাগের প্রায় অর্ধেক তীব্র খরায় আক্রান্ত হবে। এমনকি উষ্ণতা যদি দেড় থেকে দুই ডিগ্রিতে স্থিতিশীল থাকে, তাহলেও দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার একটা বড় অংশ খরা দেখা দেবে। পাশাপাশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং খরা পরিস্থিতির সঙ্গে দাবানলের আশঙ্কাও বাড়বে।

আইপিসিসির ষষ্ঠ মূল্যায়ন রিপোর্টে বলা হয়, ভূপৃষ্ঠের বর্তমান উষ্ণতা, তা শিল্পবিপ্লবের আগের উষ্ণতার চেয়ে ১ দশমিক শূন্য ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এর মধ্যে মানুষের অবদান ১ দশিমক শূন্য ৭ ডিগ্র্রি সেলসিয়াস। উষ্ণতার সঙ্গে বাড়ছে আর্দ্রতাও। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়বে ১ থেকে ৩ শতাংশ। এর ফলে বৃষ্টির পরিমাণও বাড়বে এবং ঘনঘন বৃষ্টি হবে।

যেখানে প্রকৃতির প্রাধান্য সেখানে মানুষেরা বরাবর প্রকৃতির নিয়মে থেকেছে। কারণ-অকারণে বনজঙ্গল, জলধারার কোথাও বৃহৎ কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। উন্নয়নের নামে গাছ, নদী, জল কিংবা পাহাড়ের স্থিতি বিনষ্ট করেনি। কিন্তু প্রকৃতির ওপর আমাদের বিরূপ আচরণ দিন দিন বাড়ছে। তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সে জন্য বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস ও জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ কমাতে হবে। তাতে বৃষ্টিপাতের ধরনে বিরূপ প্রভাব কিছুটা হলেও কমে আসবে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম বৃষ্টিপাতের সবচেয়ে খারাপ ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে এ নিঃসরণ কমে এলেও পূর্ববর্তী জলবায়ুগত পরিস্থিতিতে ফিরে আসা চ্যালেঞ্জিং।’

লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট

*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]