শ্রমজীবী মানুষের অস্বস্তি দূর করার দায়িত্ব কার?
কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে সকালের সূর্য। সন্ধ্যা নামলেই অনুভূত হচ্ছে শীত। পাতলা কাঁথায় মানছে না শীত। গ্রাম-শহরগুলোতে প্রকৃতির নিয়ম এমনই হয়। প্রকৃতির এই পরিবর্তন জানিয়ে দিচ্ছে শীত আসছে। শীতের জন্য উপযোগী হচ্ছে সবাই। শীতের আগমনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুরের তাঁতপল্লি। খটখট শব্দে মুখর যেন তাঁতপল্লি। ব্যস্ত হয়ে পড়েছে গামছা, তোয়ালে, চাদর ও কম্বল তৈরির কাজে। যদিও প্রাচীনকাল থেকে এ জেলার মানুষ গর্ব করে বলতে পারত, ‘আমাদের আছে তাঁতশিল্প’। কিন্তু আজ পুঁজি আর মুনাফার কারণেই ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প আজ বিলুপ্তের পথে। সুতা ও কাঁচামাল, পুঁজির অভাব এবং আধুনিক কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা টিকতে না পেরে সারা দেশের মতো এ জেলায়ও একের পর এক তাঁতশিল্প বন্ধ হয়ে গেছে।
তবে পূর্বপুরুষের ব্যবসার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন হস্তচালিত তাঁতশিল্পীরা। এ শিল্পে তাঁতিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। ব্যস্তময় জগতে ব্যস্ত থাকে শহরের মানুষ। সবাই শুধু নিজ কাজে ব্যস্ত থাকে নিজেকে নিয়ে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মানুষ সমাজের অন্য দশজনের কথা চিন্তা করার সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বাইরে নয় স্বাধীনতার ৫১ বছরের বাংলাদেশ।
গর্বের সঙ্গে আমরা বলতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে শাসক ও শোষকদের উচ্ছেদ করেছিলেন বাংলার বীর সূর্যসন্তানেরা। আজ খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে আবার শোষণযন্ত্রের জাঁতাকলে সাধারণ মানুষ পিষ্ট হয়। ভাবনার জায়গা তৈরি হয়েছে, ছিন্নমূল শ্রেণি আজ কেমন আছে? সবুজ-শ্যামল সোনার দেশের শ্রমজীবী মানুষ কেমন আছে? প্রশ্নগুলো উত্তর সংক্ষিপ্ত আর সংকটগুলো প্রকট। দুশ্চিন্তা নিয়ে জয়পুরহাট গ্রামীণ শহরে টগবগে যুবক রিকশা চালাল দুলাল হোসেন।
দুলাল হোসেনের জীবনের চাকা ঘুরছে না। তিনি দিন আনেন দিন খান। তাঁর রিকশার চাকা ঘুরলেও সংসার চলে না। তাই চিন্তায় আকুল মানুষটি বসে আছেন পৌর শহরের পাঁচুর মোড়ে। অপেক্ষা তাঁর যাত্রীর। তীক্ষ্ণ চোখে দেখছেন কে তাঁর যাত্রী হবেন। নানা বয়সী মানুষের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁরা রিকশায় চড়েন কি না। আশা তাঁর ভাঙে না। পাঁচুর মোড় থেকে বাটার মোড় খালি রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোনো যাত্রী পাচ্ছেন না। আজ কত হতে পারে আয়রোজগার, তিনি জানেন না। তাই তো ভাগ্যের ওপর ছেড়েছেন। আশা তাঁর খুব, খরচ দিয়ে বাজার নিয়ে কাল দিনটি চালাতে পারবেন। কটি পয়সাও থাকবে।
দুলাল হোসেন সদরের রাঘবপুরের ছেলে। সাতসকালে রিকশা নিয়ে শহরে এসেছিলেন। তাঁর বাড়িতে মোটে ছয়জন। তা-ও তাঁর চলে না সংসার। তবে দুলালের জীবনটি যেন প্যাডেলের মতোই বদলে ফেলছেন। দুটি শিশুসন্তান তাঁর। পড়ছে মাদ্রাসায়। বড় হয়ে হাফেজ কী মাওলানা হবে। বাবার মতো রিকশা নিয়ে নয়, ওয়াজ নিয়ে বেরুবে নানা পথেঘাটে। আয় করবে অনেক, হবে বড় ইসলামি আলেম। আরও কতশত আশা উঁকি মারছে তাঁর জীবনের এই ক্ষণেও। বাড়িতে থাকেন বয়স্ক মা-বাবাও। তাঁরাও ছেলের আয়ে চলেন।
দুলাল তাঁর জীবনটি বারবার বদলাতে নেমেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের আক্রমণের আগে অনেক বুদ্ধি করে বাঁশ ও গাছের ব্যবসা করবেন বলে গ্রামীণ ব্যাংক ও আশা নামের দেশের সুবিখ্যাত দুটি এনজিও থেকে ক্ষুদ্রঋণ করেছেন মোট ৫০ হাজার। সারা বিশ্ব যখন করোনাভাইরাসে নাজেহাল, তখন আমাদের দেশেও দফায় দফায় করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়, এ কারণে ব্যবসা শুরু করতে পারেননি ভাগ্যের ফেরে। করোনাভাইরাসের প্রকোপে সারা বিশ্ব থমকে গেল। দুলাল তো কোন ছাড়, লকডাউনের ফেরে তাঁর ব্যবসায় বাঁশের বাড়ি পড়ল। তবে থমকে গেলেন না। জীবনযুদ্ধে আবার নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন নিজেও পরিবারের লোকদের দুমুঠো জোগাড় করতে।
দুলাল হোসেনের এ সংকটে আত্মীয়স্বজন পাশে দাঁড়ালেন। একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনে দিলেন দুলালকে। নিজেরও সামান্য ছিল। এর পর থেকে দুলাল হোসেন হয়ে গেলেন পথের রাজা। পুরো জয়পুরহাট পৌর শহরটি তিনি রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়ান। গায়ের শক্তি খরচ হয় না খুব। কারণ, তাঁর ব্যাটারিচালিত রিকশা। তবে প্রতি মাসে রিকশার ব্যাটারিতে চার্জ ও বাড়ির বিদ্যুৎ বিল যেন তাঁকে হাঁপিয়ে তোলে। উপায় নেই, বিদ্যুৎ বিল তাঁকে দিতেই হয়।
প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা রোজগার। সংসার চলে অভাব-অনটনে। ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়েও চিন্তিত। কারণ, সারা দেশে অধিকাংশ জায়গায়; অর্থাৎ মাদ্রাসায় শিশুরা নিরাপদ নয়। শিশু নির্যাতন আর শিশু ধর্ষণের কান্নার শব্দে যেন আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে। এ নিয়েও তাঁর উদ্বিগ্নতার শেষ নেই। তাঁর মধ্যে মাথাব্যথা হলো স্ত্রীর চিকিৎসা, বাড়তি খরচ দিয়ে থাকে না কিছু। ফলে চিন্তা ও বেদনা যেন তাঁর পিছু ছাড়ে না।
দুলাল হোসেন ভালো থাকেন না। কত দিন আগে মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছেন, তা মনে করতে পারেন না। সামান্য শাক, আলু আর ডালভাত তার নিত্যসঙ্গী। গ্রামের বাজারেও দাম বাড়তি। গরিবের জন্য সবকিছু অধরাই থাকে। এক কেজি চাল কিনতে গেলে পয়সা ফুরায়। তেলের দামও অনেক। তাতে দুলালের সংসারে ভর্তা, শাক চলে খুব। ছেলেমেয়েরা অনুযোগ করে। সামান্য ছোট মাছ, এটা-সেটা তাঁর সংসারের খাবারের জোগান দেয়। কী কিনে ফিরবেন, সেটিই দুলালের বাজারের ফর্দ।
বাবা-মায়ের ওষুধও আছে। ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় ভর্তি করে বিপদে পড়েছেন। তার চেয়ে স্কুল ভালো ছিল। কিন্তু স্কুলে ভর্তি করে দিলেই তো কাজ শেষ হয়ে যায় না। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পণ্যমুখী। গরিবের জন্য এক রকম শিক্ষাব্যবস্থা আর আলালের ঘরে দুলালদের জন্য আরেক রকম শিক্ষাব্যবস্থা। বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় ধরেছে প্রশ্নপত্র ফাঁস নামের ভূত। এতে দিনবদলে প্রবেশ করছে সাম্প্রদায়িক শিক্ষা। প্রগতিশীল চিন্তার লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের লেখা বাদ যাচ্ছে পাঠ্যপুস্তক থেকে। এতে এ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে শঙ্কিত সচেতন সমাজ।
আর অপর দিকে মানুষের জীবনের উন্নতি দুলালকে ছোঁয় না। তাতে তাঁর জীবন আগায় না। রিকশাটিই আগায়। কষ্টে আছেন তাঁরা খুব। শুধু দুলাল হোসেন নন, রিকশাওয়ালাদের জীবনের দিনলিপি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁদের জীবন অস্বস্তিতে আছে। ফিচার নিউজ সংগ্রহে যেতে হয় জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন মোড়ে।
এর মধ্যে বড় মাঝিপাড়া গ্রামের ৬০ বছরের খায়রুল ইসলাম, বয়স তাঁকে পক্বতা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা কষ্টের সাগরে ডুবে আছি।’ তাঁকে কিছু প্রশ্ন করাতেই পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আমাদের কষ্টের কথা লিখে কী করবেন? ভাগ্যের তো কোনো পরিবর্তন হবে না। আমাদের কষ্ট দেখারও তো কেউ নেই। দিনে ৩০০ টাকা আয়। খরচ দিয়ে সংসার চলে?’ তাঁর সঙ্গী হলেন রেজাউল করিম। থাকেন কুটিবাড়ি ব্রিজের ধারে। বলেছেন হতাশ মুখে, ‘আমার সাতজনের সংসার। শহরের অলিগলিতে রোজ গড়ে ২০০ টাকা। এই সামান্য টাকায় সংসার কী চলে?’ তাঁদের প্রশ্নগুলোর উত্তর রাষ্ট্র কি দিতে পারবে, তা আমার জানা নেই।
আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙেছে। মানুষের ন্যূনতম বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, সেই ক্রয়ক্ষমতাও তার নাগালের বাইরে চলে গেছে। জনগণ আর উন্নয়ন চায় না, তারা চায় ভাত ও ভোটের অধিকার। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সঠিক সিদ্ধান্তে এগিয়ে আসতে হবে, বিদেশি প্রভু ও পুঁজিবাদী ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার নয়, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে কাজ করতে হবে। দুর্নীতি, লুটপাট, ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। টাকা পাচার আর মেগা প্রজেক্ট দেশকে যে সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
বিদ্যুৎ-পানিসংকট নিরসন করতে হবে। আর্সেনিক দূষণ, ডেঙ্গু মহামারি ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে প্রতিকারের পথ খুঁজতে হবে। শ্রমিকদের রুটিরুজির মাধ্যম রিকশা আটক করে জরিমানার নামে শ্রমিকের কষ্টে অর্জিত অর্থ লুটে নেওয়া বন্ধ করতে হবে। পুলিশি জুলুম নির্যাতন ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। ইজিবাইক, রিকশাসহ ব্যাটারিচালিত যানবাহন আধুনিকায়ন করতে হবে। শোষণমূলক রাষ্ট্র নয়, বৈষম্যহীন দেশ নির্মাণ করতে হবে।
লেখক: রাশেদুজ্জামান রাশেদ