ডোরাকাটা গরু

রোদেলা সকালে হাটে এসে রোহান দেখল হাজার মানুষের পা জোড়া ছাড়া গরুর পা দেখা মুশকিল হয়ে পড়েছে। এত মানুষ সে জীবনে এই প্রথম দেখল। তার বাবা কবির সাহেব বেশ শক্ত করে ছেলের হাত ধরে রইলেন, পাছে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে না যায়। ছেলের বয়স হলেও বুদ্ধিশুদ্ধি মোটেও নেই।

-রোহান, এদিকে তাকাও, বাবা। দেখো তো এই গরুটা পছন্দ হয় কি না।

কবির সাহেব খুব কড়া নজরে গরুর মাথা থেকে পা, লেজ দেখছিলেন।
-বাহ! কী সুন্দর গরু বাবা। আমি এটা নেব। এবার কোরবানিতে দাদির জন্য উপহার দেব।
রোহান খুব খুশি। লাল টকটকে গরুটির রং।
-রোহান, তোমার দাদি কি এবার আমাদের সঙ্গে কোরবানি দেবে বলেছে তোমাকে? এত আশা কোরো না, বাবা। তোমার দাদি আমাদের ওপর বেজায় রেগে আছেন অনেক দিন।
-না, তবে দাদির সঙ্গে কথা বলে বুঝি, তিনি আর আগের মতো নেই। মাথা অনেক ঠান্ডা। তোমার জন্য খুব কাঁদেন।
-কী বলছ, আমি ফোন করলে ধরেন না তো কখনো। আমার কথা তাঁদের মনে নেই সত্যি। যাহোক, আমাদের সঙ্গে কোরবানি করুক সবাই—আমি এটাই চাই।

-বাবা, তোমার মতো দাদির খুব অভিমান। দাদা চলে গেছেন বছর চলছে। এখন হয়তো তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারছেন। তবুও মাকে একটিবার ফোন করেন না—এটাই আমার দুঃখ। অভিমান কত দিন জিইয়ে রাখা যায়। মানুষ বাঁচে কত দিন, বাবা।

রোহান ষষ্ঠ শ্রেণির পাট চুকিয়ে যেই শহরে পড়তে এসেছে, আর গ্রামে যাওয়া হয়নি। কদাচিৎ কাজ বা অনুষ্ঠান ছাড়া বাসা থেকে পা পড়ে না তার; এমনকি গরুর বাজারও নয়। অথচ সে এখন কলেজে পড়ে। দাদার বাড়ি সেই শৈশবে ছেড়েছে। মা-বাবা খুব কষ্ট করে তাকে মানুষ করছে। একাকী যুদ্ধ করে তাদের ভাইবোনকে মানুষ করছে তার স্কুলশিক্ষক মা। বাবা তো বছর আট বাদে একবার এল স্বদেশে। তিনি তো হঠাৎ এসে একটু আনন্দভুবন পার করে প্রবাসে চলে যান জীবন-জীবিকার তাগিদে। তারপর সেই তো একলা বাবাহীন জীবন কাটানো, যা খুব কষ্ট দেয় রোহানকে।

একটু উঁচুমতো একটি ডিবির ওপর উঠে বাপ-ছেলে পুরো বাজার দেখছিল। পাশেই বাঁধা আছে টকটকে লাল গরুটি। রোহান মনেপ্রাণে চায় তার দাদির সঙ্গে এবার কোরবানির ঈদটা করবে। কী জানি, কপালে থাকলে হবে।

-রোহান, ওই দিকে আসো। আরও সুন্দর গরু দেখতে পাচ্ছি।
-বাহ্! এটা তো আরও বেশি নাদুসনুদুস গরু।
রোহান গরুর গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। সত্যি কখনো প্রাণীদের সঙ্গে এভাবে কাছাকাছি যাওয়া হয়নি। মা মাঝেমধ্যে বছরে দু-একবার ফয়’স লেক চিড়িয়াখানায় নিয়ে যান। ওই তো খাঁচায় বন্দী প্রাণীদের দেখে মন জুড়ানো, এই আরকি।
-বাবা, গ্রামে গরুর দাম কেমন জানো?
রোহান গরুর চড়া দাম দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।

-হবে হয়তো একটু কমবেশি। তবে বর্তমান দ্রব্যমূল্য থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে পোষা প্রাণী লালন-পালনও ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। এখন সেই অর্থ জনগণ থেকে আদায় করে নেবে।

-ঠিক বলেছ। তবু তো তুমি মাকে বিকাশে মাসিক টাকা পাঠালে হাজারটা প্রশ্ন করো, হিসাব খোঁজো। অথচ মা আমাদের ছাড়া কাউকেই জীবনে দেখেন না। এতটাই ভালোবাসেন আমাদের। অভাব কী জিনিস আমাদের বুঝতে দেন না। মা চাইলেই অনেক বিলাসিতা করতে পারতেন। করেন না আমাদের কথা ভেবে। তোমার এসব ভাবা উচিত। মাকে আর বকবে না। টাকা আমরা কেউ চোখেই দেখি না। এত খরচাপাতি হয়ে যায় কী আর বলব। এখন আমি মাঝেমধ্যে বাজারে গেলে হিমশিম খাই মনমতো কিছু কিনব কি না।

-দুঃখিত, রোহান। আজ কয়েক দিন বাজারে এসে যে পরিস্থিতি দেখছি, তোমার মাকে বকা দেওয়া আমার অন্যায্য হয়েছে। তবু মিতব্যয়ী হতে বলি। সামনে আরও খারাপ দিন আসবে। তাই এখন থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তোমার মায়ের কাছে আজকে গিয়ে সরি বলব। তুমি কষ্ট পেয়ো না, বাবা আমার।
-বাবা, দেখো ওই দিকে একটা লাল-কালো ডোরাকাটা বাঘের মতো দেখতে গরু। আসো ওটা দেখে আসি।
-চাচা, দাম কত গরুটার?
-দাম জিগায় কাম নাই। আগে পছন্দ করেন। ভালো লাগলে বলমু।

চাচার কড়া কড়া ভাষায় মনে হলো বেশ দামই হাঁকবে। তবে গরুটা একদম অন্য রকম। রোহানেরও খুব পছন্দ হয়েছে। সে ওটার সামনে থেকে সরছেই না।

-হুম্, গরুটা পছন্দ হয়েছে। কত দাম বলেন এবার। কয় মণ গোশত হবে বলে মনে করেন। সেই অনুপাতে দাম বলবেন। কবির সাহেব জায়গামতোই চেপে ধরলেন চাচা মিয়াকে।

-সাড়ে তিন মণ গোশত পাবেন। একটু এদিক-সেদিক হবে হয়তো। তবে দেশি গরু। ঠকবেন না। দরদাম না করলে একদাম বলব, শুনবেন?

চাচা মিয়া বেশ কায়দা করে কথা বলছে দেখে রোহান মুচকি হাসছে। ব্যবসাটাও একটা আর্ট। কথা গুছিয়ে বলতে জানলে ক্রেতা থেকে ঠিক অনেক টাকা লাভ করা যায়।

-জি, বলেন। তবে কত দাম পড়বে, তা অনুমান আমি করেছি। কেবল ছেলেটা পছন্দ করল বলে কেনা। ওই দিকের গরুটাও দেখে এলাম। এদিকে না হলে ওটাই কিনব ফাইনালি।
চাচা মিয়া এবার একটু অস্বস্তির ঢেকুর তুলল। এত সমঝদার চালাক ক্রেতা সে আগে কখনো দেখেনি মনে হলো। রোহান এবার জোরে অট্টহাসি দিল।

-ভাই, ৮০ হাজার দিয়েন। আর কামাইতে পারুম না। একটা গরুর পেছনে অনেক খরচা পালতে। বোঝেন তো, এখন সবকিছুর দাম বাড়তি। কুলানো যায় না আসলে। আমার মাইয়্যা দুইখান বেজায় কষ্ট করে পালছে এ গরুটারে।

কবির সাহেব অন্যান্য গরুর হাটেও বেশ কয়েক দিন ঘুরছেন। ইজারাসহ দাম এত বেশি নয়। গরিব মানুষ হলেও লোকটা খুব সৎ মনে হলো তাঁর। আর কথা না বাড়িয়ে গরুর গলার রশিটা রোহানের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। রোহানের স্বপ্ন পূরণ করতে এ তো যৎসামান্য টাকা। যাক, ছেলেটা খুশি হোক। অনেক বছর পর বাবা-ছেলের একসঙ্গে কোরবানির ঈদ করা। এসব ভাবতে ভাবতে কবির সাহেবের চোখে জল চলে এল। নিজেকে সামলিয়ে তিনি চাচাকে টাকাটা গুনে দিয়ে গরু নিয়ে বাসার দিকে ছুটলেন। সামনের রাস্তার দুই গলি পরেই রোহানদের বাসা।

-মা, এসো। দেখো, গরু নিয়ে এসেছি।

রোহান একটা পিলারে গরুটাকে বেঁধে দিল রশির শক্ত গিঁট দিয়ে। এলাকায় ঢুকেই অনেকে ভাবল, এটা বাঘ নাকি। বাপ-ছেলে দুজনই বেশ উপভোগ করল সবার অবাক তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটা। আর রোহান তার মাকে সব ঘটনা খুলে বললে সবাই হাসতে লাগল। এ আনন্দ নিখাদ। অনেক দিন পর সবাই একসঙ্গে হওয়ার যে আকুলতা, ঈদগুলো যেন সবাইকে এক হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

-মা, দাদিকে একটা ফোন করবে প্লিজ। দাদিকে নিয়ে এবার ঈদ করতে চাই। করো প্লিজ।
রোহানের সাধাসাধিতে রোকেয়া ফোন দিলেন শাশুড়িকে।

-হ্যালো মা, কেমন আছেন? আপনার ছেলে আর নাতি চায় আপনি আমাদের সঙ্গে এবার কোরবানির ঈদ করুন। আর কত অভিমান করে থাকবেন বলেন। অনেক তো সময় নষ্ট হলো।

-ভালো আছি। ছেলের কথা বাদই দিলাম। তুমি তো আসোই না। আমি নাহয় দুনিয়াদারি কম বুঝি, অভিমান করি, কিন্তু তুমি তো শিক্ষক হিসেবে একজন সচেতন মানুষ। সংসারের অনেক দায়িত্ব থাকে।
-কী বলেন মা, আমি সেদিন গিয়েছিলাম। আপনারা কেউ আমার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেননি। কাছে গেলে দাম দেননি। এখন অন্য কথা বলছেন আপনার ছেলেকে শোনানোর জন্য কি? আমি রাখছি।

-রেখো না, বউমা। আমি যাব। আমার ছেলে, নাতি ও তোমাদের সবার সঙ্গে এবার ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করব। তবে শর্ত হলো আমার সঙ্গে চলে আসতে হবে একেবারের জন্য ঘরে। তোমরা ছাড়া অনেককাল ঘরটা শূন্য পড়ে আছে রে, মা।

রোকেয়া আর তার শাশুড়ির বহু বছরের জমানো কান্না যেন ঝরনার মতো চোখ দিয়ে গলগল করে বের হচ্ছে।
রোহান আর কবির সাহেব খুব খুশি। রোকেয়া শাশুড়িকে বলল যে গরু কেনা হয়ে গেছে। ট্রাকে করে গরুসমেত বাড়ি ফিরবে তারা।

আহা! কত দিন পর এমন আনন্দের বাঁধভাঙা শোরগোল খুশির বান এসেছে রোহান আর ডোরাকাটা বাঘের মতো গরুটার জন্য। ঈদ যে সবাইকে এক করে, সহমর্মিতায় উদ্বুদ্ধ করে, তা আবার প্রমাণিত হলো। রোহান এবার সবাইকে পেয়ে খুব আনন্দে দিন কাটাবে। আসছে ঈদে আরও বড়, সুন্দর গরু কিনে দেবে বলে কবির সাহেব রোহানকে কথা দিলেন।

  • লেখক: পারভীন আকতার, শিক্ষক, ৩১ নম্বর পশ্চিম মরিয়মনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মরিয়মনগর (রশিদিয়াপাড়া), রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।