আমাদের বন্ধুত্ব

সুখ-দুঃখ আর হতাশা-ক্ষোভ, চাওয়া-পাওয়ার সব হিসাব যাকে মন খুলে বলা যায় সেই বন্ধু। বন্ধু মানে নিছক আড্ডার সঙ্গী নয়, বরং বন্ধু মানে দুঃখের সঙ্গী। একে অপরের পথচলার চালিকা শক্তি, যা জীবনে বয়ে আনে বৈচিত্র্য আর সফলতার পথে এগিয়ে দেয় কয়েক ধাপ। বলা হয়ে থাকে, যদি বন্ধু হও, হাতটা বাড়াও। সেই হৃদয়ের আহ্বানে মিলেছে সব বন্ধুর হাত। সত্যিকার অর্থেই বন্ধুত্ব এক অদ্ভুত সম্পর্কের নাম।

এমনই বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ষষ্ঠ বছরে পদার্পণ করলাম আমরা তিন বন্ধু আশিক, অনিক ও আমি ইদুল। পরিচয় আমাদের অতি সাদামাটা। স্কুলজীবনে শেষ করে ভিন্ন তিন গ্রাম থেকে এক কলেজে ভর্তি হলাম তিনজন। কেউ কাউকে চিনতাম না, বড়ই অচেনা। অন্য ক্লাসমেটদের মতোই স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো আমাদের। কেন জানি অন্যদের চেয়ে একে অপরের পছন্দ–অপছন্দ একই হতে শুরু করল। ক্লাসের ফাঁকে অচেনা মানুষের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় মেতে ওঠা। কলেজের ফাঁকে পাশের বাজারে মাঝেমধ্যে ঘুরতে যাওয়া। তখনো আমরা বন্ধুত্বের মায়ায় আবদ্ধ হইনি, বন্ধুত্ব শব্দটি যে বিশাল। শুধু একে অপরকে জানার শুরু।

এভাবেই কেটে গেল আমাদের কলেজজীবনের প্রথম কয়েক মাস। খুব অল্প সময়েই একে অপরের ভালো লাগায় পরিণত হলাম। অন্য ক্লাসমেটরা একজনকে কটুকথা বললে একযোগে প্রতিবাদ করা। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্পে মগ্ন থাকা। এরই মধ্যে কখন যে নিজেদের বন্ধুত্বের মায়ায় বেঁধে ফেলেছি, বুঝতেই পারিনি। আমরা হয়ে উঠেছি একে অপরের আপন। অবসরে একসঙ্গে আড্ডা আর হাসিঠাট্টা। একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে কলেজে আসা। ‘তুই আসলে আমি আসব, না আসলে যাব না’। ক্লাসবিরতির সময়গুলো পার্শ্ববর্তী স্টেশনে বসে চা–আড্ডায় কাটানো। খুব অল্প সময়েই তিন অচেনা মানুষ হয়ে গেল চিরচেনা। ক্লাস-পরীক্ষা বাদেও বিকালে তিন গ্রামের কেন্দ্রবিন্দু নন্দনগাছী বাজার এবং নন্দনগাছী রেলস্টেশন হয়ে উঠল আমাদের আড্ডার নিয়মিত স্থান। কলেজ ছুটি থাকলে সেই দিনে আমরা এভাবে দেখা করতাম।

দেখতে দেখতেই কেটে গেল আমাদের উচ্চমাধ্যমিক অর্থাৎ কলেজজীবন। এর পরক্ষণেই শুরু হলো সেই মহামারি করোনাভাইরাস। হঠাৎই বাইরের পরিবেশটা হয়ে গেল স্তব্ধ। করোনা মহামারির ভয়ংকর রূপ যেন সবার জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো ছেয়ে গেল। করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমাতে দেশে তখন কড়া লকডাউন। এর মধ্যে জমে উঠল আমাদের অনলাইন আড্ডা। মনের সব অব্যক্ত কথা আমরা মুঠোফোনেই আদান-প্রদান করতাম।

সময়টা যেন খুব দ্রুত চলে গেল, তবে এর ছাপ আজও আমাদের মধ্যে রয়ে যায়। করোনা মহামারি শেষ হতে না হতেও আমাদের স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা শুরু। ভাগ্যের কবলে ভাগ হয়ে গেলাম আমরা। স্নাতকে একেক শহরে একেকজনকে যেতে হলো আমাদের। তবে শহরের দূরত্ব বাড়লেও বন্ধুত্বের দূরত্ব বাড়েনি এতটুকুও। বন্ধু আমরা বন্ধুই থেকে গেলাম একে অপরের আস্থাভাজন হিসেবে।

বছরের বিভিন্ন সময় ছুটিতে এখনো একত্রিত হই আমরা তিন বন্ধু। একসঙ্গে ঘুরাঘুরি, খাওয়াদাওয়া সবকিছুই অব্যাহত। ঈদের ছুটি পুরোটাজুড়ে আমরা সেই আগের মতোই আড্ডা দিই, গল্প করি, হাসিঠাট্টায় মেতে উঠি। বয়স বাড়লেও বন্ধুত্ব আমাদের শিশুমন এখনো জাগ্রত রেখেছে। এভাবেই সুখ-দুঃখ, হতাশা-ক্ষোভ, চাওয়া-পাওয়ার মধ্য দিয়েই কেটে গেল আমাদের বন্ধুত্বের ছয়টি বছর। হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে অটুট। ভালো থাকুক সবাই, অটুট থাকুক আমাদের বন্ধুত্ব।
*লেখক, ইদুল হাসান, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া