ভারতের নির্বাচন প্রমাণ করেছে জনগণের চেয়ে বড় শক্তি নেই

ইভিএম পরীক্ষা করছেন নির্বাচন কর্মকর্তারাছবি: এএফপি

ভারতের নির্বাচন এখনো অনুকরণীয়। শক্তিশালী নির্বাচনব্যবস্থার কারণে ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন বর্জন করার প্রবণতা নেই। চলমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও এ নিয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তেমন কোনো উদ্বেগ নেই, এর বড় কারণ হলো রাজনৈতিক দলগুলো জানে জনগণের ভোট দিতে সমস্যা নেই। ক্ষমতাসীন দল যতই দমনপীড়ন করুক, নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা ভারতের গণতন্ত্র এগিয়ে নিয়েছে।

২০২৪–এর নির্বাচনে কংগ্রেসের ওপর আমার নজর ছিল। ভারতের প্রাচীনতম ও বড় এই রাজনৈতিক দলের গত নির্বাচনগুলোতে বিপর্যস্ত হওয়ার পর কীভাবে দলটি ঘুরে দাঁড়ায়, এটি নিয়ে আমার উৎসাহ ছিল। রাহুল গান্ধীকে জেলের শাস্তি এবং কর্মীদের ওপর বিজেপি সরকারের অত্যাচারের মধ্যে এই দলটি কীভাবে নিজেদের জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে, তার ওপর আমার চোখ ছিল। গত নির্বাচনেও যে কংগ্রেস ৫০টি আসনও পায়নি, সেই দল মেরুদণ্ড সোজা করে কর্মীদের চাঙা করতে পারবে কি না, তা নিয়ে আমার শঙ্কা ছিল। জানা ছিল, ২০২৪–এর সাধারণ নির্বাচন হবে কংগ্রেসের জন্য চ্যালেঞ্জের। বিজেপির হিন্দুত্ববাদের স্লোগান ও ঘৃণার রাজনীতি মোকাবিলা করা এত সহজ ছিল না কংগ্রেসের জন্য। সেখান থেকে এই নির্বাচনে একবারে ৯৯ আসনে জয়লাভ ভারতের জন্য এবং ভারতের মানুষের জন্য স্বস্তির।

রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে জনগণের সঙ্গে লেগে থাকতে হয়। সব শঙ্কা উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হয়। জনগণকে সুযোগ করে দিতে হয় ভোট দেওয়ার জন্য। কংগ্রেস হতাশ না হয়ে সব সময় মানুষের কাছে থাকতে চেয়েছে। রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’সহ বিভিন্ন অহিংস কর্মসূচি জনগণের মধ্যে নতুন ভাবনা তৈরি করেছে। যার প্রতিফলন দেখা গেছে উত্তর প্রদেশে। এই প্রদেশে কংগ্রেস জোটের অভাবনীয় সাফল্য প্রমাণ করে জনগণের শক্তিই আসল শক্তি।

নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, রাহুল গান্ধী ও কেজরিওয়াল

গণতন্ত্রে যে জনগণের চেয়ে বড় শক্তি নেই—এর প্রমাণ মোদির কন্যাকুমারী কিংবা ধর্মীয় কর্মসূচির ব্যর্থতা। ভারতের জনগণ যেভাবে ধর্ম রাজনীতির সঙ্গে লেগেছিল, তা সব সময় আমার কাছে খারাপ লেগেছে। ভারতের একটা আলাদা সুনাম ছিল। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল সারা বিশ্বের উদাহরণ। সেই জায়গা থেকে বের হয়ে ভারতের জনগণ যেভাবে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, তা ছিল অভূতপূর্ব। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো যে ভারতের মতো দেশের জনগণ কীভাবে এতটা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দিকে ঝুঁকে গেল। এবারের নির্বাচন নিয়ে তাই আমার কৌতূহল বেশি ছিল। ২০২৪ নির্বাচনে ভারতের মানুষ যে ঘৃণা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পরিত্যাগ করার চেষ্টা করেছে, তাকে সাধুবাদ জানাই।

বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্র যেভাবে একনায়কতন্ত্রের কাছে ধূসর হচ্ছে, তার জন্য জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর দায় আছে। ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতা এবং নির্বাচন বর্জন গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। সাধারণ নির্বাচনের সময় যেভাবে আম আদমি পার্টির প্রধানকে জেলে ভরা হলো, তা কখনই গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। এরপরও যে এ ধরনের অত্যাচারিত দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেনি, তা গণতন্ত্রকে মজবুত করতে সহায়তা করেছে। দীর্ঘ দুই মাস ধরে চলা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত জনগণের জয় হয়েছে। কংগ্রেস প্রাণ ফিরে পেয়েছে এবং মমতা ব্যানার্জি আবার ক্ষমতায় এসেছেন।

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক ধারার প্রতি বিশ্বাস দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে যে নতুন ভারতের শুরু হচ্ছে, তা সবার জন্য ভালো হবে। অহিংস রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। নির্বাচন যে জনগণের সঙ্গে সেতুবন্ধের মূল উপায় তার প্রতিও রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাস বাড়বে। একটা ভালো নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দরকার—এটি নিয়ে পাশের দেশগুলোকে ভাবনার সুযোগ দেবে। যে দলই সরকারে থাকুক, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের যে বিকল্প নেই, তা নিয়ে পাশের দেশগুলোকে আরও বেশি কাজ করার সুযোগ করে দেবে ভারতের ২০২৪ সালের নির্বাচন। প্রত্যাশা থাকবে, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক ধারার অনুশীলন হবে আমাদের মতো রাজনৈতিক আস্থার সংকটে থাকা দেশগুলোতে।

  • লেখক: অধ্যাপক মো. ফজলুল করিম, বিজিই বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল

নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]