বিধবার ছেলের ঈদ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ফাহিম, শাহিন, তুহিন, মৌ আর জুঁই একসঙ্গে খেলছিল। হঠাৎ তুহিন বলল, ‘এই শাহিন, তোর মা–আব্বা ঈদের নতুন জামাকাপড় কিনে দেছে তোর?’ শাহিন বলল, ‘হুম কিনে দেছে। তোরও কি কিনে দেছে?’ তুহিন বলল, ‘হুম দেছে। তারপর বলল, ‘মৌ, জুঁই তুরা কিনেছিস?’

মৌ, জুঁই বলল, ‘হুম আমার আম্মু–আব্বু তো তোদের কেনার আগেই কিনে দেছে।’

তুহিন হেসে বলল, ‘ও তা–ই? খুব ভালো।’ তারপর ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফাহিম, তোরে কিনে দেছে জামাকাপড়?’ ফাহিম কী বলবে! মনমরা ভাবে মুখটা নেড়ে বলল, ‘না...।’ তারপর মুখে হাসি টেনে বলল, ‘আম্মু বলেছে ঈদের আগে কিনে দেবে। তারপর...’

ছয় বছরের ছোট্ট ফাহিম দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে ওর মায়ের কাছে এল। ওর মা রহিমা তখন পরের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করতে যাওয়ার জন্য ঢাকার মালিবাগ রেললাইনের বস্তির ছোট্ট একটা ঘর থেকে বেরোচ্ছে। পায়রার খোপের মতো ছোট ছোট সারিবদ্ধ বস্তির ঘরগুলো। ওরা মা–ছেলে বস্তির ছোট্ট একটা ঘরে থাকে। ফাহিম এসেই কাঁদতে কাঁদতে ওর মা রহিমার হাত ধরে বলল, ‘ও মা, মা, সবাই ঈদের নতুন জামা, প্যান্ট, জুতা, টুপি কিনছে। আমারটা কখন কিনে দেবে মা? ও মা, মা...বলো না...আমরা কখন যাব মার্কেটে নতুন জামাকাপড় কিনতে? ঈদ যে এসে গেল মা..৷ সেমাই, চিনি কিনবে না..?’

বারবার মায়ের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল ফাহিম। ছেলেক ওভাবে কান্না করতে দেখে বিধবা রহিমার মাতৃহৃদয় ডুকরে কেঁদে উঠল। চোখ দুটো তার ভরে গেল জলে। রহিমা ছলছল নয়নে আসমানের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

হয়তো মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে বলল, ‘প্রভু কেন তুমি অকালে আমার স্বামীটাকে করোনায় কেড়ে নিলে? কেন আমার ছেলেটাকে তুমি পিতৃহীন করলে? কেন আমাদের এত গরিব করলে? যে ছেলেকে ঈদের জন্য এখনো একটা নতুন জামা কিনে দিতে পারলাম না।’

তারপর শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছর। একটু উবু হয়ে বসে ছেলেকে বুকে টেনে ওর চোখের জল মুছে কান্নাধরা গলায় বলল, ‘যাব বাবা, যাব। চিন্তা করিসনে। এখনো তো ঈদের দু–তিন দিন বাকি আছে। দেখি, এর মধ্যে কাজের টাকাটা পেলেই কিনে দেব।’ ফাহিম বলল, ‘জানো মা, তুহিন, শাহিন, মৌ, জুঁই ওরা সবাই ঈদের জামা, প্যান্ট, জুতা কিনেছে।’ রহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওদের সবার যে আব্বা বেঁচে আছে, বাবা ফাহিম। ওরা ইনকাম করে। আজ যদি তোর বাবাও বেঁচে...’ গলা ধরে এল রহিমার। আর কথা বলতে পারল না। ফাহিমকে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল। ফাহিম মায়ের কান্না দেখে। ওর ছোট্ট দুটো কচি হাত দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল, ‘তুমি আর কেঁদো না, মা, আর কেঁদো না। থাক মা, আমার কোনো নতুন জামা লাগবে না।’ এ কথা শুনে রহিমা ফাহিমের কপালে–মুখে স্নেহের চুম্বন দিয়ে বলল, ‘আমার লক্ষ্মী সোনা ছেলে একটা।’

এমন সময় বস্তির আরেক বাসিন্দা আকাশের বউ এসে বলল, ‘এই ফাহিমের মা, ফাহিমের মা…ও, যাক তুই দেখছি বাড়ি আছিস! আমি তো সংবাদটা শুনেই তোর কাছে ছুটে এসেছি।’ রহিমা বলল, ‘কী সংবাদ, আপা?’ আকাশের বউ সুখতারা বলল, ‘এই আজ ফিতরা দিচ্ছে দৌলত খান। দেরি করলে কিন্তু পাওয়া যাবে না। চল, এখুনি যেতে হবে।’ দৌলত খান প্রতিবছর ঈদের আগে গরিবদের ফিতরা দেয়। খুব দানশীল, দয়ালু লোক। এলাকার মানুষও তাকে বেশ ভালোবাসে, ভক্তি–শ্রদ্ধা করে।

রহিমা বলল, ‘কিন্তু আপা, আমাকে যে কাজে যেতে হবে। আজ আমার মাসের টাকা দেওয়ার কথা।’ আকাশের বউ বলল, ‘তাহলে তাড়াতাড়ি আসিস কিন্তু কেমন...।’ রহিমা বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আপা।’ সুখতারা চলে গেল। রহিমা ফাহিমকে বলল, ‘বাবা ফাহিম, তুই খেলতে যা...। আমি কাজ থেকে এসে তোকে নিয়ে মার্কেটে জামাকাপড় কিনতে যাব।’ ফাহিম বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে মা।’

তারপর খেলতে চলে গেল ফাহিম।

রহিমা কাজ করে বস্তির পাশেই এক ধনী লোকের বাড়িতে। তাদের বাড়ির গেট খুলে ভেতরে যেতেই বাড়ির মালিকের বউ বলল, ‘এত দেরি হলো কেন, রহিমা? সামনে ঈদ। বাড়িটা একটু পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করতে হবে। ঈদের দিন মেহমান আসবে বাড়িতে, বুঝলি?’ রহিমা বলল, ‘চিন্তা করবেন না, খালামণি। আমি সবকিছু করে দিচ্ছি।’ মালিকের বউ বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। একটু তাড়াতাড়ি কর।’ রহিমা সারা দিন কাজ করল।

কাজ শেষে চলে আসার সময় রহিমা বলল, ‘খালামণি, আমার মাসের কাজের টাকাটা যদি দিতেন। আমার ছেলেটার জন্য একটু কেনাকাটা করতাম।’ মালিকের বউ বলল, ‘এত টাকা টাকা করিস কেন? ঈদ কি পার হয়ে গেছে? যে কিনতে পারবি না? যা, ঈদের আগের দিন নিস।’

কাচুমাচু হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রহিমা বলল, ‘খালামণি, আমি আমার ছেলেটাকে বলে এসেছি, আজ ফিরে গিয়ে ওকে নিয়ে জামাকাপড় কিনে দেব। তাই বলছিলাম, যদি টাকাটা...’ শুনে মালিকের বউ কাট কাট শব্দে বলল, ‘এই যা তো, যা। আর কানের কাছে ঘ্যানর-ঘ্যানর করিস না। যত্তসব! গরিবের আবার ঈদ।’

রহিমা আর কোনো কথা বলতে পারল না। শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কাঁদতে কাঁদতে গেট দিয়ে বেরিয়ে এল। রহিমা চলে আসতেই মালিক ওর বউকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপার? কাজের মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ওভাবে চলে গেল কেন?’ মালিকের বউ বলল, ‘আর বোলো না। টাকা–টাকা করে পাগল করে দিচ্ছে। নানা রকম ছুতা দেখাচ্ছে। ছেলের ঈদের জামা কিনবে, আরও কত কী!’ শুনে মালিক বলল, ‘যাহোক, কাজটা তুমি ভালো করোনি। গরিব মানুষ; স্বামীটাও মারা গেছে। টাকা তো দিয়ে দিলেই পারতে।’ তারপর মালিক বেরিয়ে গেল অফিসের কাজে। রহিমা সন্ধ্যার সময় বাড়িতে ফিরে ফিতরা আনতে গেল দৌলত মিয়ার বাড়িতে।

কিন্তু ওই যে কথায় আছে না... অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকিয়ে যায়।

তেমনটাই হয়েছে পোড়াকপাল বিধবা রহিমার বেলায়।

রহিমা যখন দৌলত খানের বাড়িতে পৌঁছাল, ততক্ষণে ফিতরার টাকা দেওয়া শেষ হয়ে গেছে। রহিমা গেটের দারোয়ানের কাছে জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল, ‘ফিতরা দেওয়া যে শেষ হয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগে আসেননি কেন?’

কী বলবে রহিমা? দুচোখ জলে ছলছল করে উঠল তার। ওর যে একূল–ওকূল দুই কূলই গেল। আশাহীন মনে নিরাশার ছাপ এখন রহিমার চোখে মুখে। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাসায় ফি ল সে সন্ধ্যায়।

মাকে আসতে দেখে ফাহিম, ‘ও মা, মা, তুমি এসেছ?’ বলেই দৌড়ে এল মায়ের কাছে। ফাহিমকে ধরে রহিমা বলল, ‘আমি পারলাম না রে বাবা। ঈদে তোকে নতুন জামা প্যান্ট, টুপি কিনে দিতে।’ তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

সে সময় পেছন থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠল, ‘কে বলেছ তুমি পারোনি, রহিমা?’ রহিমা ঘাড় ফিরিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, সে যে বাড়িতে কাজ করে, সেই বাড়ির মালিক রহমান। রহমানের দুই হাতে অনেক বাজার-সদাই। নতুন কাপড়চোপড়ের প্যাকেটও আছে।

রহিমা বলে উঠল, ‘খালুজান আপনি!’ তারপর দ্রুত ঘর থেকে বসার জন্য চেয়ার এনে দিল।

রহমান বসতে বসতে বলল, ‘হুম, আমি। তুমি ওভাবে আমার বাড়ি থেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসার পর আমি সব শুনেছি। তুমি আমার মেয়ের মতো, মা। তোমার খালা তোমার সঙ্গে অন্যায় করেছে। তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও মা। এই নাও, এতে তোমার শাড়ি আর তোমার ছেলের জন্য ঈদের নতুন জামা, প্যান্ট, টুপি, জুতা, সেমাই–চিনিসহ কিছু বাজার-সদাই আছে।’ রহিমা বলল, ‘কিন্তু খালুজান...!’ রহমান বলল, ‘আর কোনো কিন্তু নয়, মা। গরিবের চোখে জল ঝরিয়ে কি ঈদ আনন্দ করা যায়, মা? নাও, ধরো।’ এমন সময় রহমানের স্ত্রীও এসে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ, স্বর্ণার আব্বু।’ রহমান বলল, ‘তুমি?’ স্বর্ণার মা রত্না বলল, ‘হুম, আমি। আসলে রহিমার সঙ্গে অমন ব্যবহার করে আমি নিজেই কষ্ট পেয়েছি। তাই...কিন্তু এসে দেখি, তুমি আমার আগেই এখানে। নে মা, রহিমা, তোর খালুর হাত থেকে প্যাকেটগুলো নে তো।’ রহিমা রহমানের হাত থেকে প্যাকেটগুলো নিল।

এমন সময় পেছন থেকে দৌলত খান বলল, ‘আসলে কথায় আছে না...যার কেউ থাকে না, তার আল্লাহ থাকে!’ রহিমা দৌলত খানকে দেখে বলল, ‘চাচাজান, আপনি?’

দৌলত খান বলল, ‘হুম আমি, মা। দারোয়ানের মুখে শুনলাম, তুমি কাঁদতে কাঁদতে চলে এসেছ। তাই না এসে আর থাকতে পারলাম না।’ তারপর সে কিছু টাকা দিয়ে বলল, ‘এই নাও মা, ঈদে মাংস কিনে তোমার ছেলে আর তুমি পেট ভরে খেয়ো, কেমন।’

রহিমা কাঁদছে। দৌলত খান বলল, ‘কাঁদছ কেন, মা রহিমা?’ রহিমা বলল, ‘এটা দুঃখের নয়, চাচাজান। খুশির কান্না। এই অভাগীর প্রতি আপনার দয়া দেখে।’ তারপর বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আল্লাহ যেন আপনাদের সবার ভালো করেন। আমার এতিম ছেলের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ আপনাদের এর প্রতিদান দেবেন।’ রহমান বলল, ‘কী ভাই ফাহিম, তুমি খুশি তো?’ ফাহিম নতুন জামাকাপড় হাতে নিয়ে হেসে বলল, ‘হুম, খুব খুশি। আপনারা সবাই অনেক ভালো।’ ‘তাহলে থাকো ফাহিম, আমরা আসি’, বলে সবাই চলে গেল বিদায় নিয়ে। তার দুদিন পর নতুন জামাকাপড় পরে সেমাই, মিষ্টি, মাংস, ভাত খেয়ে বেশ হাসিখুশি আনন্দের সঙ্গে ঈদ কাটল বিধবা রহিমা আর তার ছোট্ট ছেলে ফাহিমের।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ নানা সমস্যা, জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]