শিক্ষানুরাগী মাদার বখশের ৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকী: জাতীয় স্বীকৃতি চাই
রাজশাহীর শিক্ষাবিস্তার ও উন্নয়নে মাদার বখশের ভূমিকা চিরস্মরণীয়। বৃহত্তর রাজশাহী বিভাগের মানুষের কাছে কিংবদন্তি নাম মাদার বখশ। তাঁর সামাজিক কর্মকাণ্ড উত্তরবঙ্গসহ দেশবাসীকে সব সময় আন্দোলিত করে। মাদার বখশ ১৯০৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নাটোরের সিংড়া উপজেলার স্থাপনদীঘি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২২ সালে তিনি সিংড়ার চৌগ্রাম উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে আইএ এবং ১৯২৬ সালে একই কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯২৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ পাস করেন এবং ১৯২৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইন বিষয়ে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন।
মুর্শিদাবাদ ও নওগাঁয় শিক্ষকতা করার পর মাদার বখশ ১৯৩৪ সালে রাজশাহীতে আইন পেশায় যুক্ত হন। একই সময়ে সমাজসেবায়ও মনোনিবেশ করেন। তিনি চল্লিশের দশকের শুরুতে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এরপর ১৯৪৬ সালে রাজশাহীর (আত্রাই, বাগমারা ও মান্দা) প্রতিনিধি হিসেবে অবিভক্ত বাংলার বঙ্গীয় আইন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। মাদার বখশ ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন রাজশাহী পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান।
মাদার বখশ ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী ভুবনমোহন পার্কে অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন তিনি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের তিনিই একমাত্র এমএলএ, যিনি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় নিজ দলীয় সরকারের সমালোচনা করার দায়ে কারাবরণ করেছিলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে দলের নীতিনির্ধারক ও সরকারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থানের কারণে মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
১৯৫৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভুবনমোহন পার্কে এক জনসভায় সরকারকে উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা না হয়, তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করতে আমরা বাধ্য হব।’ এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চে প্রাদেশিক আইন সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ক্ষণজন্মা-মহৎপ্রাণ মাদার বখশ ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৪ সালে সোবহানিয়া উচ্চবিদ্যালয়, ১৯৬০ সালে লক্ষ্মীপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ১৯৬৬ সালে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে রাজশাহীতে প্রথম বেসরকারি মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ১৯৫৫ সালে সরকারীকরণ এবং ১৯৫৮ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামে নামকরণ করা হয়। এ ছাড়া রাজশাহী মহিলা কলেজ, রাজশাহী গার্লস মাদ্রাসা, রাজশাহী মুসলিম হাইস্কুলসহ আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
মাদার বখশ রাজশাহীর উন্নয়ন ও শিক্ষাবিস্তারে যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে গেছেন, এর যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে কি? রাজশাহী সিটি করপোরেশন এবং মাদার বখশ প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁর জন্মদিবস বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয় কি? আজ ২০ জানুয়ারি মাদার বখশের ৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিভাবান মানুষটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ১৯৬৭ সালের ২০ জানুয়ারি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে রাজশাহীর কাদিরগঞ্জ গোরস্তানে সমাহিত করা হয়। রাজশাহী অঞ্চলের উন্নয়নে মাদার বখশের অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর ৫৬ বছর পেরিয়ে গেলেও নেই কোনো জাতীয় স্বীকৃতি। সমাজসেবা ও ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার অথবা একুশে পদকেও ভূষিত করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা নতুন নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষানগরী রাজশাহীতে মাদার বখশের নামে হতে পারে একটি বিশেষায়িত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যেমন জ্ঞান আহরণের সুযোগ পাবেন, তেমনি মাদার বখশের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাও দেখানো হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অবৈতনিক শিক্ষক, জনদরদি আইনজীবী, শিক্ষানুরাগী জননেতা মাদার বখশের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
*লেখক: ব্যাংকার, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়