জুলাই বিপ্লব: এ টেল অব জেন–জেড
বিপ্লব হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে একটি মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন, যা তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে এবং জনগণ চলমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জেগে উঠে। জুলাই বিপ্লব শব্দটা শুনলে এতকাল চোখে ভেসে উঠেছে ১৮৩০ সালে ফ্রান্সে সংগঠিত বিপ্লবের চিত্র, যা ১৮৩০ সালের ২৬ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। কিন্তু ২০২৪–এর জুলাইয়ে এসে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান হলো। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ‘বাংলা ব্লকেড’ শব্দটির সঙ্গে জনমণের একাত্মতাকে স্বৈরাচার সরকারের দমিয়ে রাখার প্রয়াস গিয়ে আশ্রয় খুঁজল একাত্তর–পরবর্তী ঘৃণ্য ‘রাজাকার’ শব্দে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী হলে থালা বাসনে উঠল বাদ্যযন্ত্রের হুংকার, হাজারও তরুণ সুর মিলাল
‘তুমি কে, আমি কে
রাজাকার, রাজাকার
কে বলেছে, কে বলেছে
স্বৈরাচার স্বৈরাচার’
ধ্বনিতে।
পুলিশি বুলেটে আবু সাঈদের অটল বিশ্বাসে ভরা বুকটার নিশ্বাস আটকে যায়, মুহূর্তেই তিউনিসিয়ার মোহাম্মদ বোয়াজিজি মূর্তমান হয়ে উঠে আমার বাংলায়। শুরু হলো বাংলা বসন্ত। সরকার বুঝতেই চাইল না ক্ষমতা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। পতঙ্গের পতন এলে সে আগুনের দিকেই ঝুঁকবে, এটাই কী স্বাভাবিক নয়? রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপেশাদারিত্ব, মন্ত্রীদের বিতর্কিত ন্যারেটিভ পাল্টে দিলো বিপ্লবের ধারা, বিক্ষোভে ফুঁসে উঠল হাজারো তরুণ। ভাষা এবং শব্দের ব্যবহারে মতাদর্শের প্রতিফলন কীভাবে ঘটে এবং তার প্রতিবাদ কেমন হওয়া উচিত, জেন–জেড তার প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করল। অকুতোভয় ছাত্র–জনতা আলিঙ্গন করতে শিখে নিল মৃত্যুকে, রাজপথে স্লোগান উঠল ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ ধ্বনিতে। উপাচার্যদের নির্লিপ্ততা আহমদ ছফাকে আরও একবার যুগোপযোগী করে তুলল, মনে পড়ল গাভী বিত্তান্ত উপন্যাসের কথা। ছাত্র–জনতার তোপ, কূটনীতিক চাপে আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ডাক দিলেন আলোচনার।
স্বনির্ভর, স্বাধীনচেতা জেন–জির আত্মমর্যাদা প্রচণ্ড, ঘুরানো–প্যাঁচানো ডিপ্লোম্যাসিতে বিরক্ত হয় এরা। আমার ভাইয়ের লাশের ওপর দিয়ে কীভাবে সংলাপ হতে পারে প্রশ্ন ছুড়ল। চলমান ছাত্র আন্দোলনে সরকারের ব্যর্থতা এবং অবাধ গুলি করার আইনি সুরক্ষার মধ্যস্থতা করল সান্ধ্য আইন। বিজিবি এবং সেনা মোতায়েনের মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে ছাত্র আন্দোলন দমিয়ে রাখার চেষ্টায় আশার আলো দেখতে চাইলেন তৎকালীন সরকারপ্রধান, বাতিল করলেন স্পেন সফর। গণহত্যা গবেষক প্রফেসর গ্রেগরি স্ট্যানটনের ‘এইট স্টেইজ অব জেনোসাইড’ প্রবন্ধের আটটি ধাপের সর্বশেষ ধাপ ডিনায়াল বা অস্বীকার দেখলাম সবশেষ স্বৈরাচার সরকারে। মোর্স কোডের মতো জটিল সব কোডের ব্যবহারে ডিবি কার্যালয় থেকে ছয় সমন্বয়কের আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতির আড়ালে জেন-জেড বুঝে নিল এই আন্দোলন দমানো যাবে না। দাবি ঠেকল এসে ৯ দফায়। রাষ্ট্রের সর্বত্র অরাজকতা, অব্যবস্থাপনা, দমন-পীড়ন, গুমের রাজনীতি দংশন করল রিকশাচালক, চা বিক্রেতা, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিল্পীসমাজ, শিক্ষকসমাজসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। এবার আপনিই বলুন, এ গণ–অভ্যুত্থান কি কারফিউ মানে?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ডাউনফল করলে পাশে দাঁড়ায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ডাউনফল করলে পাশে দাঁড়ায় স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থী। দেয়াল ছেয়ে যায় প্রতিবাদী গ্রাফিতি এবং দেয়াল লিখনে, একটা দেশের রাজা চুপ অথচ রাজপথ কথা বলে। এ যেন গ্রিক শহর এফিসাস। ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’, ‘আসছে ফাগুন আমরা হব দ্বিগুণ’, ‘ব্লাডি জুলাই’, ‘আমি মেট্রোরেল হতে চেয়েছিলাম, খোদা আমাকে ছাত্র বানাল’, ‘তুই মোর ছাওয়াক চাকরি না দিবু না দে, কিন্তু মারলু ক্যানে?’
প্রতিবাদের ভাষা গায়ে ফুটল শব্দের চাবুক হয়ে। আন্দোলনকারীদের ডাকে গণমিছিল ও দ্রোহযাত্রায় উত্তাল হলো রাজপথ। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম ছাত্র–জনতা অভ্যুত্থান দেখেছিল ১৯৯০ সালে, স্বৈরাচার এরশাদ পতনের সময়। এরপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় গণজাগরণ দেখেছে এবং আওয়ামী সরকারবিরোধী ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের এ রক্তাক্ত ২৪ দেখেছে। আমার দেখা এ প্রথম অভ্যুত্থান আমাকে অভাবনীয় কিছু অভিজ্ঞতা দিয়েছে, সরকারি চাকরির ক্রেজ কিংবা রাজনৈতিক চিন্তা–ভাবনা সহপাঠী কিংবা সিটি ইউনিভার্সিটির অন্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে না দেখলেও এ ২৪–এর গণ-অভ্যুত্থানে তাদের যেভাবে জেগে উঠতে দেখেছি, সেটা বিস্ময়কর!
শিক্ষার্থীদের আড়ালে শিক্ষক মহলের ভূমিকাও নিদারুণ, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ে উঠেছিলেন এই আন্দোলনের এক, একজন রোল মডেল। কারাবন্দী ছাত্রের জন্য উনাদের উদ্বিগ্নতা, তাদের মুক্তির জন্য বলিষ্ঠ কণ্ঠে কথা বলা, ইংরেজি পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, আহত ছাত্রদের দেখতে হাসপাতালে ছুটে যাওয়া প্রভাবিত করেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের। তাঁদের একজন আমাদের অভিভাবক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় ১৮ জুলাই লিখেছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইট, ওরা সন্তান—আপনার, আমার, আমাদের, বাংলাদেশের।’ এবং ‘স্টুডেন্টস আর আওয়ার বি অল অ্যান্ড ইন্ড অল’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় স্যারের পোস্টে হেলাল হাফিজের সেই কালজয়ী কবিতা ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’; নবারুণ ভট্টাচার্যের—
‘যে পিতা সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি—
যে ভাই এখনো নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি—
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানি
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি’,
কিংবা ‘মিছিল কোনো দিন ভুলপথে যায় না, মিছিল পথ গড়ে দেয়’ লিখাগুলো শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল, আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল। আমরা নানা লিখনিতে জানতে পারি—মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে সেই অনুভূতি, যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বলে যা আমাদের রক্তে আজও বহমান। তিনি দীপ্ত কণ্ঠে বলেন—
From ashes, flames will rich the sky,
From seeds, the flowers sing,
Not knowing they buried
THAT WE WERE THE SEED
THAT WE ARE THE SEED
(Rahman M.M, -2024)
নিরাপত্তাহীনতার বদৌলতে সিটি ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগ ছিল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তার চাদর, অনুপ্রেরণার অবিকল উৎস। জুলাইয়ের পরে বাংলার বুকে আগস্ট আসে কিন্তু বাঙালি তারিখ গুনতে থাকে আজকে জুলাইয়ের ৩২ তারিখ! মুক্তি পেয়ে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন সমন্বয়কেরা। স্বৈরাচার সরকারের তাসের ঘর দুলতে শুরু করল পুবের হাওয়ায়, সরকারপ্রধান আলোচনার ডাক দিলেন গণভবনে। ততক্ষণে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে মুক্তির দাবি, এক দফা!
মিসরীয় লেখক আলা আল আসওয়ানির স্বৈরাচার এবং স্বৈরতন্ত্র নিয়ে লিখা ‘The Dictatorship Syndrome’ বইতে তিনি স্বৈরাচারের কখন পতন হবে এবং কীভাবে তা হবে, সেটার একটা চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর মতে স্বৈরাচারের পতনের বীজ স্বৈরাচারের হাতেই নিহিত থাকে। তিনি লিখেছেন,
‘A dictator in his virtual and multi-delusional world is like a person driving a car with no brakes or rear-view mirror. He drives without the least notion of the surroundings he is driving through, and he cannot stop the car even if he wants to. Under these circumstances, the car will end up crashing horribly. Even if it does not happen today, then it will tomorrow or the next day.’
৩৬ জুলাই, অকুতোভয় বাংলার মানুষ কারফিউ উপেক্ষা করে বন্দুকের নলের সামনে দিয়ে এক পা দুই পা করে এগিয়ে গিয়েছে বঙ্গভবনের দিকে। ১৬ বছর শোষণের রাজত্ব কায়েম করা সরকারপ্রধান লক্ষ্মণ সেনের ৮২০ বছরের রেকর্ড ভেঙে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন। গণজোয়ারে সৃষ্ট ঝড়ের দাপটে দেশে উড়তে থাকল লাল সবুজের পতাকা, মুহূর্তেই ছিঁড়ে গেল বুলডোজারের অদৃশ্য শিকল। মুক্ত হলো দেশ। ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের নীতি হয়ে উঠল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্তর্নিহিত নীতি। মৃত্যু পথযাত্রী জুলাইয়ের শেষ সাধ পূরণ হলো, জয় এল। জুলাই বুঝল—এবার তার শেষ হওয়ার পালা। শুরু হলো আগস্ট, শুরু হলো আগামী।
লেখক: সাদিয়া আফরিন প্রাপ্তি, শিক্ষার্থী, সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]