মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের ১০ম গ্রেড কেন চাই
সুচিকিৎসার অন্যতম প্রধান একটি ধাপ হলো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন। কিন্তু ওষুধ যদি সঠিকভাবে বণ্টন ও বিতরণ না করা হয়, কিংবা ওষুধের সঠিক ডোজ অনুযায়ী ওষুধ সেবন না করা হয়, তবে রোগ থেকে পরিত্রাণের পরিবর্তে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আবার কোনো ওষুধ প্রয়োজনের থেকে অধিকমাত্রায় গ্রহণ করলে সেটি অপব্যবহারের পর্যায়ে পড়ে যায় বা অ্যান্টিবায়োটিক–জাতীয় ওষুধ সঠিক ডোজ নিয়ন্ত্রণ না করে গ্রহণ করলে মানব শরীরে এটি রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায়। উপরোক্ত সমস্যাগুলো যাতে না হয় সে জন্য রোগীকে সঠিক ওষুধ ব্যবহারের নিয়ম ও বিতরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যিনি করে থাকেন, তিনি হলেন ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে প্রায় সাত হাজার ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট কর্মরত আছেন। আবার পর্দার পেছনে থেকে রোগ নির্ণয়ের মত সূক্ষ্ম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যাঁরা করে থাকেন, তাঁদের নাম মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। এ পেশাটির সঙ্গে পূর্বে মানুষ পরিচিত না হলেও কোভিড-১৯–এ তাঁদের গুরুত্ব মানুষ বুঝতে পেরেছেন। মানুষের শরীরের রক্ত, প্রসাব, ফ্লুইড কিংবা এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই মেশিনের মাধ্যমে তাঁরা বিভিন্ন রোগ নির্ণয় করে থাকেন। কিন্তু ডাক্তার নার্সের ফোকাসে গুরুত্বপূর্ণ পেশাটি বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, একজন ডাক্তার নিয়োগ দিলে তিনজন নার্স, পাঁচজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশে ৩০ হাজার ডাক্তার, ৮০ হাজার নার্সের বিপরীতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কর্মরত মাত্র ৭ হাজার। অথচ এ সংখ্যাটি হতে পারত দেড় লাখের মতো। এর ফলে সরকারি হাসপাতালে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ব্যাপক সংকট। সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের অভাবে পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে ল্যাব টেস্টের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। চার বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা-ইন-মেডিকেল টেকনোলজি এবং ডিপ্লোমা-ইন-ফার্মেসি কোর্স স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ ও বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল অধিভুক্ত। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, স্বাস্থ্য শিক্ষার ডিপ্লোমা কোর্স দুটি সম্পন্ন করে সরকারি চাকরিজীবনে প্রবেশ করতে হয় ১১তম বেতন স্কেলে।
অথচ সমমানের চার বছরের ডিপ্লোমা করে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারা ১৯৯৪ সালে, ডিপ্লোমা নার্স ২০১১ সালে, ডিপ্লোমা কৃষিবিদ ২০১৮ সালে ১০ম গ্রেড পেয়েছে। কিন্তু বরাবরই বঞ্চিত হয়ে আসছে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং ফার্মাসিস্টরা। পারতপক্ষে ডিপ্লোমা ইন ফার্মেসি ও ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি কোর্সের মান কোনো অংশে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, নার্সিং কাউন্সিল থেকে কম নয় বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি। যেমন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে সর্বনিম্ন পাস মার্ক মোট নম্বরের ৪০ নম্বরের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক নিয়ে। কিন্তু মেডিকেল টেকনোলজি ও ফার্মেসি কোর্সে পাস মার্ক মোট নম্বরের ৬০ শতাংশ অর্থাৎ তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক অংশে ভিন্ন ভিন্নভাবে পাশ করতে হবে সিজিপিএ এবং গ্রেডিং পদ্ধতিতে। অর্থাৎ কোর্সের মান ও শিক্ষা পদ্ধতি মানসম্পন্ন, যা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়েরের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত। অপর দিকে অন্যান্য সরকারি চাকরিজীবীরা সপ্তাহে দুই দিন অর্থাৎ শুক্র ও শনিবার ছুটি ভোগ করলেও টেকনোলজিস্ট–ফার্মাসিস্টদের ছুটি মাত্র শুক্রবার।
কিন্তু অত্যান্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাস্থ্যসেবার এই বীর সেনারা বরাবরই তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলায় বেতন স্কেলে এ যেন এক বিশাল বৈষম্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই সমমর্যাদা ডিপ্লোমাধারীদের ১০ম গ্রেড প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার কারণে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট জাতির স্বপ্নের ১০ম গ্রেডের সোনালি সূর্য এখনো উদিত হয়নি। যা বৈষম্যের শিকার হাজারো ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট অ্যান্ড টেকনোলজিস্টদের মনে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এমতাবস্থায় নবনিযুক্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও জনপ্রশাসনমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের প্রাণের দাবি ১০ম গ্রেড বাস্তবায়ন করে তাঁদের কর্মস্পৃহা বাড়াতে সহায়তা করুন।
*লেখক: মোতাছিম বিল্লাহ মুন্না, ফার্মাসিস্ট ও কলাম লেখক
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]