পাখিদের কেউ নেই
আমি এখন একটা ছোট্ট জলাশয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। জলাশয়টি আজকালের মধ্যে ভরাট হবে। এ জলাশয়টি ভরাট হলে এ এলাকায় আর কোনো জলাশয় থাকবে না। বালুতে পরিপূর্ণ একটা আবাসিক এলাকা হয়ে যাবে। ভাবতে ভালোই লাগে গ্রামগুলো শহর হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের এঁদো কাদা মাটির যুগ শেষ। সবকিছু ঝকঝকে তকতকে। নাগরিক সুবিধার ছড়াছড়ি। জলাশয়ে একটি মাছরাঙা বসে আছে। তার চোখে দুঃখী দুঃখী ভাব।
—কী ব্যাপার তুমি এখনো এখানে বসে আছ? আমি মাছরাঙাকে প্রশ্ন করলাম।
—কোথায় যাব বল? এ জায়গাটুকু বাদে আর কোথাও তো যাওয়ার জায়গা নেই।
—কোথাও নেই!
—না, নেই। পাখিদের কথা কেউ ভাবে না। পাখিদের কেউ নেই।
—কেন এমন কষ্টের কথা বলছ?
—তোমার কি এ জলাশয়ের কথা মনে নেই। এটা কি এত ছোট ছিল? এটা ছিল একটা বিশাল বিল। সে সময় কত হাজার হাজার পাখি এখানে আসত। কত ছোট ছোট মাছ থাকত বিলে। কত জীবনের খাবারের ব্যবস্থা হতো এ বিল থেকে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
মাছরাঙার কথায় আমার মনে পড়ে আমার ছোট্টবেলায় দেখা সে বিলের কথা। সত্যি কত্ত বড় এক বিল ছিল এখানে। বর্ষাকালে আমিও এখানে পানকৌড়িদের সঙ্গে ডুবসাঁতার কেটেছি। ডাহুকের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছি। কত ধরনের প্রাণী যে এ বিলে ছিল, তার হিসাব নেই। গুইসাপ, বেজি, শিয়াল, মেছো বাঘ, বক, শালিক, কাক, ঘুঘু। কত নাম না জানা পাখি, কত রকমের মাছ, কত ধরনের প্রাণী, কত ধরনের পোকামাকড়। আমি ঠিক সবকিছুর নাম জানি না। বর্ষার শেষে এখানে মাছ ধরার ধুম পড়ত। মনে হতো পুরো এলাকাজুড়ে এক উৎসবের আমেজ। কত মাছ যে ধরা পড়ত, তার কোনো হিসাব নেই। বর্ষার শেষে শীতের শুরুতে শুকনা বিলে হতো শর্ষে, গম, ধনিয়া, কালিজিরা, কলাইসহ নানা ফসলের চাষ। ছোট্টবেলায় আমাদের অনেক গরু ছিল। গরু নিয় বিলে যেতাম কলাই খাওয়াতে। বিকেলে যখন গরু নিয়ে বাসায় ফিরতাম, তখন হাজার হাজার পাখি মাথার ওপর দিয়ে নীড়ে ফিরত। সন্ধ্যার আধ আবছায়ায় সে পাখির কিচিরমিচির ডাক এক ভিন্ন দ্যোতনা সৃষ্টি করত। সত্যি কোথায় গেল সে পাখির দল, সে নাম না জানা নানা রকম প্রাণী। কোথায় গেল? কোথায়?
—তাদের তোমরা হত্যা করেছ। স্রেফ গণহত্যা!
—গণহত্যা!
—হুম। বরং তার চেয়েও জঘন্য! তোমাদের দেশে পাকিস্তানিরা একাত্তরে যে গণহত্যা চালিয়েছে, তার চেয়ে এসব গণহত্যা কোনোভাবেই ছোট নয়।
—তুমি এভাবে কেন বলছ?
—আজ ইসরায়েল ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালাচ্ছে। সারা বিশ্ব নিন্দা করছে। আমরা পাখিরাও এর নিন্দা জানাই। কিন্তু তোমরা মানুষেরা যে অহরহ কোনো নোটিশ ছাড়া ইসরায়েলের চেয়ে ভয়ংকর নৃশংসতা চালাও সে কি তোমরা জান?
—ইসরায়েলের চেয়ে ভয়ংকর নৃশংসতা!
—হুম। ধর তুমি এই বিলের যত প্রাণীর কথা বললে তারা একদিন দেখতে পেল বিশাল বিশাল ড্রেজার হতে শত শত বালুকণা তাদের ওপর আছড়ে পড়ছে। কত প্রাণী যে বালুর নিচে চাপা পড়ে মারা গেল, কত প্রাণী যে গৃহ ও খাবার হারা হলো, কত পাখি যে চলে গেল, সে খবর কি তোমরা রাখ? তোমরা নেতানিয়াহুর চেয়ে কোনো অংশেই কম খারাপ নও। অন্তত পাখির কাছে। নানা প্রাণীর কাছে।
আমি মাছরাঙার কথা শোনে বিষণ্ন হয়ে গেলাম। আসলেই এসব প্রাণীকে আমরা নির্বিচার হত্যা করেছি, তাদের আবাসন ধ্বংস করেছি, তাদের খাবার কেড়ে নিয়েছি। এসব প্রাণী যদি আমাদের নামে ঈশ্বরের কাছে বিচার দেয়, তবে স্রষ্টার আদালতে হয়তো আমরা দোষী হয়ে যাব।
—তোমার কথা শোনে দুঃখ পেলাম। মানবজাতির পক্ষ থেকে ক্ষমা চাচ্ছি।
—তোমার দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। পাখিদের কারও প্রতি কিছু চাওয়া নেই। পাখিদের কেউ নেই। এখন যাও। আমাকে একা থাকতে দাও। আমি জলাশয়ের জলের দিকে একটু তাকিয়ে থাকব।
আমি চলে এলাম। মনে মনে ভাবছি মাছরাঙাটির কথা। আগামীকাল এখানে মাছরাঙাটিকে দেখা যাবে না। আজ রাতে এ ছোট্ট জলাশয়টিও বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলা হবে। মাছরাঙার চুপটি করে বসে থাকার মতো এতটুকু জল আর কোথাও অবশিষ্ট থাকবে না। সত্যি পাখিদের কেউ নেই! তাদের দুঃখ কাউকে ছুঁয়ে যায় না।