শৈশব ও কৈশোর হোক আনন্দময়

ফাইল ছবি: নীরব চৌধুরী

জীবনের সবচেয়ে আনন্দপূর্ণ দিনগুলোর কথা মনে করলে শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোর ছবিই ভেসে ওঠে। নির্ভাবনার ওই জীবন ফিরিয়ে দিলে গ্রহণ করতে একমুহূর্তও অপেক্ষা করব না। কিন্তু জীবন আনন্দময় এ কারণে যে না আমরা অতীতে ফিরতে পারি, না জানতে পারি ভবিষ্যৎ। বর্তমানই জীবনকে নির্মাণ করে, স্রোতের মতো বয়ে নিয়ে যায় গন্তব্যে। তাই তো স্মৃতি এত মূল্যবান, স্মৃতিচারণা বিশুদ্ধ আনন্দের।

কত দুষ্টু-মিষ্টি গল্প আছে ছেলেবেলার। মায়ের রুটি তৈরির বেলনের বাড়ি, বাবার চোখ রাঙানো—সব এখন সোনালি অতীত। দিনগুলোর কথা মনে পড়লে দুই চোখ জলে ভরে ওঠে। শিশু-কিশোরদের দেখি, ছেলেবেলা খুঁজতে চেষ্টা করি। কিন্তু আনন্দ পাওয়ার চেয়ে বেশি দুঃখিত হই। প্রথম হওয়ার দাবিতে ছেলেবেলা হারাতে বসেছে। জয় গোস্বামীর টিউটোরিয়াল কবিতার প্রতিচ্ছবি সর্বত্র। ‘তোমাকে পেতেই হবে শতকরা অন্তত নব্বই (বা নব্বইয়ের বেশি) /তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম/তার বদলে মাত্র পঁচাশি!/পাঁচটা নম্বর কম কেন? কেন কম?’ মাথার ওপর শুধু চাপ, চাপ আর চাপ। চারপাশে কেবলই অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বৃত্তি পেতে হবে, প্রথম হতে হবে, সেরা হতে হবে নানাবিধ দাবিতে ছেলেবেলা বিপর্যস্ত।

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হওয়ার চর্চা করাও শিখতে হয়। ভালো মানুষ হব, মানুষের পাশে দাঁড়াব। কথাগুলো বলতে বা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু সত্যি সত্যি কাজে করে দেখানো অতটাও সহজ নয়। কোনো বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের মতো মানবিক মানুষ হওয়ার জন্যও প্রস্তুতি নিতে হয়। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে শিশুকাল থেকেই মানুষ এসব গুণ রপ্ত করতে শুরু করে।

সেদিন এক বড় ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে তাঁর আট বছরের ছেলের দৈনন্দিন রুটিন দেখে আহত বোধ করলাম। ছেলেটা এখন আনন্দ করবে, খেলবে, বন্ধুদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে দৌড়াবে, মায়ের বকুনি শুনবে, বাবার চোখ মোটা করা দেখবে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এসবের ছিটেফোঁটাও তার জীবনে নেই। সকাল ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ব্যস্ত মানুষের মতো টাইট শিডিউল। এক চুলও এদিক-ওদিক হবে না।

কথা প্রসঙ্গে আরও জানলাম, ভাই-ভাবি ছেলেকে কারও সঙ্গে মিশতে দেয় না। টিউটরের পাশাপাশি শিল্পের বিভিন্ন বিষয় রপ্ত করানোর জন্য প্রশিক্ষক আছে। আবৃত্তি, গান ও নানা রকম ইনস্ট্রুমেন্ট বাজানো শিখছে। কিছুদিনের মধ্যে ক্রিকেট একাডেমিতেও ছেলেকে ভর্তি করবে। তাদের এক কথা, ছোট থেকেই বড় হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। অনেক কিছু করতে হবে, অলরাউন্ডার হতে হবে।

বিশ্বখ্যাত অনেক কীর্তিমানের ছেলেবেলার গল্প পড়েছি। কিন্তু একসঙ্গে এত কিছুর চর্চা কেউ করতেন, এমনটা চোখে পড়েনি। তাঁদের কারও ছেলেবেলা কেবল প্রতিযোগিতা জয়ের গল্প দিয়ে ঠাসা না, হইহুল্লোড় ও আনন্দে পরিপূর্ণ। বোধ করি, বাবুকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দেওয়া উচিত হবে। এমন বাঁধা-ধরা জীবন মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে। ভাই-ভাবির মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। আমার কথায় অসন্তুষ্ট হয়েছেন অনুমান করে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলাম। গ্রামের বাড়ির বিভিন্ন বিষয়ে কথা শুরু হলো। কথা সূত্রে জানতে চাইলাম, ‘গ্রামের বাড়ি কবে যাবেন?’ উত্তরে ভাবি এমন কিছু বলবেন প্রত্যাশা করিনি। ‘কি যে বল, গ্রামে যাব, সময় কই! তা ছাড়া ছেলের সময় নষ্ট করে কোথাও ঘুরতে যাব না।’ ভাইও সুর মেলালেন। আঙ্কেল-আন্টি আসেন কি না জিজ্ঞাসা করলে ‘বাড়ির থেকে কেউ তেমন আসে না। বাবার বয়স হয়েছে, এখন আর জার্নি করতে পারে না’ বললেন ভাই। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল মুখের ওপর স্পষ্ট করে বলি, ‘আঙ্কেল-আন্টিকে নিয়ে একসঙ্গে থাকলেই পারেন।’ কিন্তু কথাটা শেষ পর্যন্ত বলা হয়ে ওঠেনি।

ছেলেটার কথা যতই ভাবছি, ততই মন খারাপ হচ্ছে। কি নিদারুণ কষ্টে ছেলেবেলা ভেসে যাচ্ছে। দাদা-দাদির মতো আবদার ও আদরের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত। গ্রামে বাড়ি থাকতেও বিশুদ্ধ বাতাসে বছরে একবারও শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। সবুজ নলের ডগায় সোনালি ধান কি অপরূপ; কত পরিশ্রমে সোনার ফসল ফলান কৃষক; ছিপে মাছ ধরার আনন্দ ইত্যাদি থেকে সে কত-না দূরে! বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে ছুটে বেড়ানোর মতো সহজলভ্য সুযোগটুকুও নেই। প্রতিযোগিতা, চর্চা আর বড় হওয়ার অজুহাতে সব হারাতে বসেছে। সুখ-দুঃখের জীবনে কখনো একা হয়ে পড়লে কোন স্মৃতি আঁকড়ে ধরবে সে? ফাস্ট হয়েছিলাম, পুরস্কার পেয়েছিলাম—কেবল এটুকুতেই কি জীবন মধুময় হয়?
শিশুরা দেখে শেখে, স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আর শেখার প্রক্রিয়াটা যত সুন্দর হয়, ভালো মানুষ হওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি থাকে। টক স্বাদের গাছ লাগিয়ে, মিষ্টি ফল খাওয়ার প্রত্যাশা করা সমীচীন নয়। আমরা বাবা-মা’কে নিজেদের থেকে দূরে রাখি। প্রয়োজন বা সুযোগ থাকলেও অনেক সময় কাছে রাখতে চাই না। কিন্তু প্রত্যাশা করি, সন্তানেরা আমাদের আদরযত্নে রাখবে। পারিবারিক সব আলোচনা সামনাসামনি করি। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট যত্নবান নই। যা মুখে আসে বলি। টিফিনের খাবার দেওয়ার সময় বলে দিই, পুরোটা খাবি কাউকে দিবি না। এভাবে জেনেবুঝে অথবা না জেনেই ছেলেমেয়েকে স্বার্থপরতা শেখাই। মাত্র কয়েক নম্বর কম পাওয়ায় কিংবা ফলাফল খারাপ করায় বকাবকি করি, গায়ে হাত তুলি। ক্লাসের অন্য কেউ কত বেশি পেয়েছে তুলনা করে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিই।

বড় মানুষ হওয়া, ভালো পড়ালেখা করা, প্রথম হওয়া অবশ্যই জরুরি। তবে কোনোক্রমেই শৈশব-কৈশোরকে ধ্বংস করে নয়। শৈশব-কৈশোর হবে আনন্দময়। শিশুরা পড়ালেখা করবে, শিল্পের চর্চা করবে। পাশাপাশি নিয়মিত মাঠে খেলবে, দৌড়াদৌড়ি করবে, কাছের-দূরের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিশবে। মানুষকে ভালোবাসতে শিখবে। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ হওয়ার পরিবর্তে মানবিক মানুষ হবে। তাই কোচিং সেন্টারের পাশাপাশি তাদের মাঠেও নিয়ে যেতে হবে। ক্রিকেটার বা ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দিয়ে নয়, স্রেফ আনন্দের জন্য তুলে দিতে হবে ব্যাট, বল। সময় অতিবাহিত হতে হতে ওরা নিজেরাই নিজেদের লক্ষ্য ঠিক করে নেবে। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে খেলছে, ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, হইহুল্লোড় করছে, এর চেয়ে মধুর দৃশ্য কি হতে পারে?

*লেখক: সৌমেন্দ্র গোস্বামী: কবি ও লেখক, কেশবপুর, যশোর।