বাংলাদেশ দলে ফিনিশারের অভাব কবে পূরণ হবে
ক্রিকেটে বল বাউন্ডারির বাইরে নেওয়ার জন্য চার-ছক্কা হাঁকাতে যদি শুধু পেশিশক্তির প্রয়োজন হতো, তাহলে সব কটি বিশ্বকাপ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের ঘরে চলে যেত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ক্রিকেটে পেশিশক্তির সঙ্গে দক্ষতা, পরিশ্রম, কৌশল, বলের দিক সম্পর্কে বোঝা, প্রতিটি শর্ট সম্পর্কে নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলো। এ ছাড়া উদাহরণস্বরূপ দেখা যায়, ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দল গ্রুপ পর্বের বাছাই ম্যাচ থেকে বিদায় নিল। তাহলে তাদের এত পেশিবহুল খেলোয়াড়েরা কি সফল হয়েছেন! অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে সাধারণ দলও মূল পর্বে খেলার সুযোগ পেল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। যা–ই হোক, মূল কথা হলো, দক্ষতার সঙ্গে ব্যাটে-বলে মিল করিয়ে দ্রুততম সময়ে বল বাউন্ডারি পার করে দ্রুত রান তোলাই হলো সফলতার পরিচয়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কেউ কি আছেন, ম্যাচের শেষ দিকে ব্যাটে-বলে টাইমিং করে দ্রুত স্কোর বড় করার। সেই ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে কতজনকে না ট্রাই করা হলো ফিনিশার হিসেবে, কিন্তু কেউ সফল হতে পারেননি। যদিও কেউ কেউ মাঝেমধ্যে দুই–একটা ম্যাচে কিছুটা ঝলক দেখান, ফিনিশারের কিন্তু ধারাবাহিক হতে পারে না।
টি-টোয়েন্টিতে ফিনিশার বলতে আমরা বুঝি এমন একজন, যিনি খেলাটাকে রিড করবেন পাওয়ার হিটিং অ্যাবিলিটি দিয়ে। তিনি দৃষ্টিকটুভাবে আউট হতে পারেন, পরাজিতও হবেন; কিন্তু যেদিন দাঁড়াবেন, সেদিন নিস্তার নেই প্রতিপক্ষের। তিনি যতক্ষণ মঞ্চে আছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বিরোধী শিবিরে থাকবে চাপা আতঙ্ক। সবাই জানে তিনি মারবেন, এই মারাটাই তাঁর শক্তিমত্তা। আবার তিনি মারতে গিয়ে মরবেনও, এটাই তাঁর দুর্বলতা। যে ক্রিকেটার যেকোনো পরিস্থিতিকে বদলে দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন, যিনি প্রতিপক্ষের মনোবল-কৌশল সব দুমড়েমুচড়ে দেওয়ার সাহস রাখেন, যিনি যেকোনো বোলিং আক্রমণ মুহূর্তেই ‘ছেলেখেলা’ করতে পারেন, যিনি ম্যাচ বা ইনিংসটাকে গৎবাঁধা পরিণতির বদলে অবিশ্বাস্য ও চমকে দেওয়া সমাপ্তির দিকে টেনে নিতে পারেন—আজকাল ফিনিশার বলতে আমরা বুঝি তাঁদেরকেই।
আন্দ্রে রাসেল, কাইরন পোলার্ড, হার্দিক পান্ডিয়া, ডেভিড মিলার, টিম ডেভিড, লিয়াম লিভিংস্টোন… আজকালকার সময়ে ‘ফিনিশার রোল’প্লে করা স্মরণীয় সব নাম। আর দীনেশ কার্তিক-অ্যাডাপ্ট্যাবিলিটি, ইনোভেশন, ট্রান্সফরমেশন ও টাইমিংয়ের চমৎকার উদাহরণ।
অথচ বাংলাদেশের আফিফ, সোহান, শেখ মেহেদি, মেহেদী হাসান মিরাজ, জিয়াউর রহমান, নাসির হোসেন, সাইফুদ্দিন, মোসাদ্দেক, নাঈম ইসলাম, শামীম হোসনসহ আরও কতজনকে না ট্রাই করা হলো ফিনিশারের জায়গায়। লাভ কী হলো? কেউ তো আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি। যদি বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ছক্কা হাঁকানো এবং ব্যাটিং রান গড়, স্ট্রাইক রেট দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে ফিনিশারের অভাব কতটুকু।
গত চার বছরের পরিসংখ্যান বলে যে টি-টোয়েন্টিতে ৪০০ রানের বেশি করতে পেরেছেন মাত্র ৪ জন। তামিম, সৌম্য, মুশফিক ও রিয়াদ। মোহাম্মদ আশরাফুল ২৩টি-২০ ম্যাচ খেলে রান করেছিলেন ৪৫০। স্ট্রাইক রেট ছিল ১২৬.৪। একমাত্র লিটন দাস ছাড়া বাংলাদেশে আর কোনো ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেট আশরাফুলের ওপরে যায়নি। লিটনের স্টাইক রেট ১৩৫.০৩।
দলের ভরসার ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে দ্রুত রান তোলার প্রত্যাশা পূরণ না হলে স্কোর বোর্ডে বড় সংগ্রহ কোনোভাবেই যোগ হবে না। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের পক্ষে মাত্র একটি শতরান আছে। সেই শতকটিও এসেছে দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে। ২০১৬ সালে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ওমানের বিপক্ষে ৬৩ বলে ১০৩ রানের ইনিংস খেলেন তামিম।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশ দল টি-টোয়েন্টিতে টিকে রয়েছে সিনিয়র কয়েকজন খেলোয়াড়ের ওপর। তাঁরা রান করলে দলের স্কোর বড় হবে, তাঁরা রান না করলে দলের স্কোর ১০০ রানের আগেই শেষ। অথচ আমরা যদি দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড—এসব দেশের দিকে তাকাই, তাদের ফিনিশিররা যেদিন দলের টপ অর্ডার এবং মিডল অর্ডার খারাপ করে, সেদিন ফিনিশাররা কীভাবে ব্যাট চালিয়ে দ্রুত রান তুলে স্কোর বড় করে। আর বাংলাদেশের ফিনিশাররা হতাশা, ভয়ে টপ অর্ডার আর মিডল অর্ডার যখন আসা-যাওয়ার মধ্যে ব্যস্ত থাকেন, তখন ফিনিশাররাও হয়তো টেস্ট খেলা শুরু করবেন, না হয় লং শর্ট খেলতে গিয়ে আউট হয়ে ফিরবেন।
কিন্তু যদি চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২২–এর দিকে তাকাই, পাকিস্তান বনাম অস্ট্রেলিয়া মুখোমুখি হয়েছিল বিশ্ব টি-টোয়েন্টির গত আসরের সেমিফাইনালে। ম্যাথু ওয়েড ও মার্কাস স্টোইনিস ৪০ বলে অপরাজিত ৮১ রানের জুটি গড়ে ‘মাখা ভাতে ছাই দেওয়ার মতো’ পাকিস্তানের ফাইনালের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেন। ম্যাথু ওয়েড ওপেন করতেন বা টপ অর্ডারে খেলেছেন। টুর্নামেন্টের মাসদুয়েক আগের দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশ সফরেও ওপেন করেছেন তিনি। সেই তাঁকে যখন ‘ফিনিশার রোল’ দেওয়া হলো, তিনি তা অ্যাডাপ্ট করে নিয়েছেন। একই ব্যাপার ব্র্যাড হজের ক্ষেত্রেও। ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় টপ অর্ডারে খেললেও ক্যারিয়ার সায়াহ্নে আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি রাজস্থান রয়ালস তাঁকে ‘ফিনিশার রোল’ প্লে করতে বললে অনায়াসে তাতে মানিয়ে নেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ফিনিশারের জায়গায় কেউ এমন কৃতিত্ব দেখাতে পারছেন না।
আর টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ ছক্কা হাঁকানো তালিকায়ও সিনিয়রদের নাম। ছক্কা হাঁকানোর তালিকায় সবার উপরে আছেন রিয়াদ। তাঁর ব্যাট থেকে বল সীমানা পার হয়েছে ৪৮ বার। এর পরই আছে তামিম ৪৪টি। মুশফিক ৩৩টি, সৌম্য ৩০ এবং লিটন ২৫টি ছক্কা নিজেদের ক্যারিয়ারে যোগ করেছেন। তাহলে ফিনিশারের ছক্কা রেকর্ড গেল কোথায়! খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না সিরিয়ালে। অথচ, ফিনিশারের ছক্কার রেকর্ড বেশি থাকার কথা ছিল দলে। কারণ, শেষ ৫ ওভারে টি-টোয়েন্টিতে দলের সর্বাধিক রান তোলার সুযোগ থাকে।
আর সে জন্য বাংলাদেশ দলের একাদশ গঠনে বোর্ড পরিচালকদের সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা করতে হয়। একজন ফিনিশারের অভাব কোনোভাবেই পূরণ হচ্ছে না। দলের ৭ নম্বর স্থানে কেউ নির্দিষ্ট হতে পারছেন না। সবাই অনিয়মিত। একই অবস্থা এবার অস্ট্রেলিয়া ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও হচ্ছে। কেউ ফিট হচ্ছেন না ফিনিশারের জায়গায়। এদিকে সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২২–এ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ১০৪ রানের বিশাল ব্যবধানে হারার পর তো ব্যাটিং কোচ নিজেই খেলোয়াড়দের ওপর রগচটা হলেন। তাহলে দোষটা কার? কোচ নাকি খেলোয়াড়দের দক্ষতায়!
তাই দলের বড় স্কোর গড়ার ক্ষেত্রে ফিনিশারের গুরুত্ব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। না হলে প্রতি ম্যাচে টপ অর্ডার এবং মিডল অর্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।
লেখক: মাজহারুল ইসলাম শামীম, শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ