এ দেশের সড়কপথ কবে নিরাপদ হবে

সড়ক দুর্ঘটনাপ্রতীকী ছবি

এদেশে মানুষের নিরাপত্তার বড় হুমকি সড়ক দুর্ঘটনা। আমাদের সড়ক যে কতটা অনিরাপদ, তা বুঝতে একদমই বেগ পেতে হয় না। পত্রিকার পাতা কিংবা টেলিভিশনের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনার খবর, স্বজন হারানোর কান্নায় ভেঙে পড়া বিভৎস ছবি; সড়ক দুর্ঘটনায় পুঙ্গ মানুষের চিৎকার। এ দেশের সড়ক এতটাই অনিরাপদ যে ঘর থেকে বের হয়ে ঘরে ফিরতে পারব কি না, তা নিয়েই চিন্তা করতে হয়। দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনা মহামারিতে রূপ নিচ্ছে। কিন্তু এ অবস্থা চলবে আর কতকাল? আর কত মায়ের বুক খালি হলে, কত মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করলে এদেশের সড়ক নিরাপদ হবে?

বিশ্বের অনিরাপদ সড়কের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দিকে। তবু এদেশের সড়ককে নিরাপদ করতে নেই কোনো শক্ত পদক্ষেপ। টেলিভিশনে টক শো, সভা-সেমিনার, ঢাকঢোল পিটিয়ে বছরে একদিন দিবস পালন; এ সবেই সীমাবদ্ধ। সড়ক দুর্ঘটনা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় তৈরি হওয়া মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। এটিকে এখন দুর্ঘটনা বললে ভুল হবে, এটা একধরনের হত্যাকাণ্ড। হত্যার বিচারের মতো বিচার হওয়া উচিত।

অনেক সময় দুর্ঘটনার পরে তদন্ত কমিটি হয়। সেখানে কারণ হিসাবে উঠে আসে নানান বিষয়। প্রতিটি দুর্ঘটনার পিছনের কারণ প্রায় একই রকম। দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে যেসব বিষয় উঠে আসে সেগুলো হলো অদক্ষ চালক, বেপরোয়া গতি এবং অভারটেকিং, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা কিংবা বেদখলে থাকা, মহাসড়কে ইজিবাইক, রিকশা, অটোরিকশা চলাচল ইত্যাদি। অথচ, আগে থেকেই এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে শক্ত পদক্ষেপ নিলে এসব সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলে সেসময় সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপের ঘোষণা দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান মতে, ২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন ১০ হাজার ৩৭২ জন। ২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৩৫৬ জন আহত হয়েছেন।

নিঃসন্দেহে এ পরিসংখ্যান আমাদের জন্য অশনিসংকেত। সড়ক ও যানবাহন দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতির খবর বহু পুরোনো। এসব সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। নইলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে।

এ ছাড়া, লাইসেন্সপ্রাপ্তি ও নবায়নের ক্ষেত্রে আরও কঠোর হতে হবে। অযোগ্য ও অদক্ষ চালকদের লাইসেন্স বন্ধ করতে হবে। সড়কে নৈরাজ্যের অন্যতম কারণ দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি। সড়ক নির্মাণে অনিয়ম এবং পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।

আরও পড়ুন

সড়ক নিরাপদ করতে নানা আইন প্রণয়ন করা হলেও তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করা কয়েকটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন বেশকিছু সুপারিশ করলেও সেগুলো আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলছে। প্রতি ৩ (তিন) মাস অন্তর চালকদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা জরুরি। ডোপ টেস্টে পজিটিভ হলে লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। চালকদের বাৎসরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সময় এসেছে মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তুকে সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে করণীয় বিষয়গুলো সংযোজন করার। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি আমাদেরকে আরও সচেতন হতে হবে। ট্রাফিক আইন মেনে চলার অভ্যাস গড়তে হবে।

সবশেষে বলতে চাই, সড়ক নিরাপদ করতে লোক দেখানো পদক্ষেপ আর নয়। সড়কে আর কোনো প্রাণ না ঝড়ুক, পঙ্গুত্ব বরণ করে দুর্বিষহ জীবন না কাটুক। নিরাপদ সড়ক এখন গণমানুষের দাবি। দেশ ও জনগণের জানমাল রক্ষার্থে নিরাপদ সড়ক গড়ে তুলতে শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণ করুন।

লেখক: আনিসুর রহমান, শিক্ষার্থী, এলএলবি, ঢাকা

*নাগরিক সংবাদ-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]