ছাত্রজীবনেই প্রেম, প্রেম করেই ছাত্রাবস্থায় বিয়ে, সংসার। রাগ, বিদ্বেষ, খুনসুটি আর পড়াশোনা একসঙ্গে চলেছে বহুদিন। তারপর একদিন হুট করেই চৈত্রের দেহ-মনজুড়ানো বাতাসের মতো ঘরের ভেতর ঢুকে গেল হিমিকা, হাসনাইনের আত্মা। হিমিকার মা যেদিন জানতে পারল সে গর্ভবতী, সেদিন তার ভয়কাতুরে চোখ দেখার মতো ছিল। ভয়ে জড়সড় হয়ে ঘরের এক পাশে বসে মুখে ওড়না পেঁচিয়ে বসেছিল দীর্ঘক্ষণ।
হাসনাইন ঘরে ঢুকে দেখে, হিমিকার মা বসে রয়েছে এক কোণে। শামুক যেমন চলার পথে মাটির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলতে থাকে, ঠিক তেমন হিমিকার মাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে নিজের অধীনে নিয়ে আসে হাসনাইন। পাশ ফিরিয়ে বুকের ভেতর বন্দী করে ফেলে মুহূর্তেই। হিমিকার মা হাসনাইনের বুকের ভেতর বন্দী হওয়ার পর যেন মুক্তির আনন্দ ফিরে পায়। কিছু বন্দিত্ব যেন মুক্তির হুকুম নিয়ে আসে। এ যেন এমনই মুক্তি।
কী হয়েছে তোমার? পাশ ফিরিয়ে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখে বলে হাসনাইন।
কিছু হয়নি। মুখ লুকিয়ে বলে হিমির মা। লজ্জা যেন তার চোখেমুখে লেপটে রয়েছে।
কিছু হয়নি বললে তো আর হবে না। তোমাকে আমি কি আজ থেকে চিনি। কিছু তো একটা হয়েছেই। বলো। আরও জোরে জড়িয়ে ধরে জানার বায়না করে হাসনাইন।
হিমির মা এতক্ষণে একটু ভরসা পায়। বলার সাহস তার বুকের ভেতর বর্ষাকালের অঙ্কুরোদ্গমের মতো বীজ হতে কথার চারা তরতর করে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসে।
মা হওয়ার মতো সুখকর অনুভূতির কাছে ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তা যখন অগ্রাধিকার পেয়ে যায়, তখন কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হয় সেই চিন্তার ছাপ কপাল থেকে মুছে দেওয়ার জন্য। একজন বন্ধুর হাত তখন মাথার ওপর ছায়া হয়ে দাঁড়ালে জীবনের সব অপ্রাপ্তি যেন প্রাপ্তির মোড়কে সেজে ওঠে। হাসনাইন মিতুকে ভরসা দেয়, বুকে টেনে নেয়; কপালে একটা চুমু এঁকে দেয়। বুকের ভেতর সজোরে জাপটে ধরে।
কী করছ এসব? হাসনাইনকে চমকে দিয়ে সরে যায় মিতু।
কেন, কী হয়েছে? হাসতে হাসতে এক হাত বাড়িয়ে দেয় মিতুর দিকে।
এভাবে ধরছ কেন? আমি কি এখন আর একা? আমার ভেতর এখন আরেকজন আছে না? ও যদি ব্যথা পায়? নতুন অনুভূতির কাছে ধরা খাওয়া বালিকার মতো লাজে নিজেকে গুটিয়ে নেয় মিতু।
হাসনাইন তার স্ত্রীকে এবার আরও কাছে টেনে নেয়। আরও গভীরে আড়াল করে সুখের আবেশে। হিমিকার মা নতুন বউয়ের মতো লাজে সরে যায়। লজ্জাবতীর লজ্জাপাতা যেন তার চোখেমুখে ভর করেছে। ওড়নাও যেন তার লজ্জাকে আড়াল করতে পারে না। হাসনাইন এবার চিবুকে হাত রেখে মুখ তুলে আলতো করে ঠোঁটে একটা চুমু দেয়। ছোঁয়া পেয়ে পরিপক্ব পলাশের মতো ঝরে পড়ে হাসনাইনের বাহুর ভেতর।
হুট করে হাত থেকে পালক পড়ে যাওয়া দৃশ্যের মতো সেদিনও হিমিকার মা হাসনাইনের হাতে খসে পড়েছিল। হিমিকার মা সেদিন যে রকম আশ্বস্ত হয়েছিল, হাসনাইনের ভালোবাসা পেয়ে এমনটা পেলে যেকোনো নারী জীবন সার্থক হয়ে যায় চোখের পলকেই। নারী হয়তো এমন সুখের জন্য অপেক্ষায় থাকে যুগ যুগ ধরে।
বিয়ের আগে হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্ত একটু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য তারা বলেছিল একটু দেরিতে বাচ্চা নেবে এবং সেটা হঠাৎ করে আগন্তুকের মতো ঘরের ভেতর তার স্থান দখল করার খবরে একটু চিন্তিত হয়েছিল বৈকি, কিন্তু ভেঙে পড়েনি। সেদিন হাসনাইন তাকে সাহস জুগিয়েছে। সংসার একার নয়, দুজনের। তারা দুজন চাইলে ঠিক এ এলোমেলো সময় কাটিয়ে উঠতে পারবে।
অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়ে হিমিকা ঘরে আসার পর ঠিকই সামলে উঠেছিল তারা। দুজনেই চাকরি পেয়েছে। নতুন ঘর, নতুন সংসার শুরু করেছিল। সারা দিন অফিস শেষ করে ঘরে ফেরার পর হিমিকার মুখ দেখে ক্লান্তি ভুলেছে অগণিত কাল।
ছোট্ট হাতের পরশে নিমেষেই ভুলে থেকেছে জীবনে ফেলে আসার সব অপূর্ণতা। হিমিকার হাসি দেখে জীবনের শত জটিলতার সরল সমাধান বের করে এনেছে দিনের পর দিন।
তাদের মধ্যকার ভালোবাসা, চাওয়া ও না-পাওয়ার বেদনার সময় ফুরিয়ে গেল নিষ্পাপ মুখের হাসি দেখে। জীবনে পেছনে ফেলে আসা পথের ঠিকানা ভুলে নতুন করে নতুন পথে চলার নাম হিমিকা।
হিমিকার সঙ্গে তাদের দুজনের পরিচয় যেন নতুন এক মাত্রা তৈরি করে ভালোবাসার সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। ভালোবাসার নতুন এক দিকপাল যেন ভর করেছে তাদের সংসারে। পালতোলা নৌকার মতো দুলে দুলে চলেছে হিমিকার প্রতি ভালোবাসার ছোট্ট নদীতে।
ছোট্ট হিমিকার কচি হাতের ছোঁয়ায় শত কঠিন ভাবনার ডালপালাও যেন চুপসে যায়। ভালোবাসার কাছে পরাস্ত হয় জীবনের নানান জটিলতা। জীবনের চিরাচরিত সমীকরণ পাল্টে নতুন এক মোড়ে দাঁড় করিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়।
জীবনের সূত্র হলো দেওয়া–নেওয়া। জীবনকে যতটুকু দেওয়া হবে, জীবন ঠিক ততটুকু ফেরত দেবে। একটু কমও না, একটু বেশিও না। জীবন কখনো কাউকে মাপে কম দেয় না। বেশি দিলে সেটা ফেরত নেয়।
জীবনের নানাবিধ ব্যস্ততা হিমিকার সঙ্গে তার মা-বাবার নিদারুণ দূরত্ব তৈরি করেছে। দুজন দুজনার মতো জীবনের পথে ব্যস্ত। দুই বছর বয়সের হিমিকা অভুক্ত পাখির মতো ভালোবাসার জন্য অপেক্ষায় থাকে। ছোট্ট মানুষ, মুখে বলতে পারে না কিন্তু তার নিষ্পাপ অভিব্যক্তি মা-বাবার মনের দুয়ারে সামান্য কড়া নাড়তে পারে না।
হাসনাইন হিমিকার মায়ের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিষয়টা মিটমাট কতে চায়। হিমিকার মা হাসনাইনের সঙ্গে মেয়ের ব্যাপারটা আপস করতে চায়। দুজনই আলোচনার মাধ্যমে মিটমাট করতে চাইলেও কেউই কিন্তু চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে চায় না। একসময় সামান্য অর্থের অভাব তারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। সেই সব দিনের ছবি এখনো তাদের সামনে স্পষ্ট। একটা চাকরির জন্য কতটা অস্থির সময় তারা পার করেছে, তার দগদগে ক্ষত এখনো দৃশ্যমান। বহুদিন অপেক্ষা আর সাধনার আর্থিক সচ্ছলতার এ ক্ষেত্রটাকে ছাড় দেওয়ার কোনো মানেই হয় না।
কিছুদিন ধরে দেখছি আমরা সকালে বের হয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মনটা ছোট হয়ে যায় তার। হাসনাইনই কথাটা শুরু করল।
অফিস থেকে মাত্র ঘরে ঢুকে জামা পাল্টানোর জন্য বাথরুমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় হাসনাইনের কথা শুনে একটু দাঁড়ালে মিতু। কোনো কথা বলল না। মুখও ফিরাল না।
মিতু বাথরুম থেকে বের হওয়ার পর আবার সেই কথাটাই বলল হাসনাইন। মিতু এবারও চুপ। কীভাবে কথা শুরু করবে ভাবতে পারছে না।
মিতুর আকাশ ঘনকালো মেঘে ঢেকে গেছে। মেঘ ভেদ করে সহসা রোদ উঠবে, এমনটাও মনে হচ্ছে না। মেয়ের চিন্তায় সেও অনেকটা ভেঙে গেছে। সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। সমাধান হলো যেকোনো একজনকে চাকরি ছাড়তে হবে। এটা সে জানে। এই বিষয় নিয়ে কিছুদিন ধরে সে ভাবছে কিন্তু সমাধান বের করতে পারছে না। কিছু সমস্যা জানা থাকলেও সমাধানের সহজ পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ত্যাগ কে স্বীকার করবে? কার আছে এত সাহস? কে ছাড়বে চাকরি? চলবে...
*লেখক: মফিজুল হক, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, ঢাকা