রাজশাহীতে কেমন গেল আমের মৌসুম
আপনি যদি রাজশাহী বিমানবন্দর থেকে শহরের দিকে যেতে চান, দেখবেন চৌরাস্তার মোড়ে বিশাল ঝুড়ির ওপর বসানো আছে তিনটি আধা পাকা আমের বিশাল ম্যুরাল। আপনাকে জানান দেবে, আপনি বিখ্যাত আমনগরী রাজশাহীতে প্রবেশ করছেন। এই মোড়ের নাম হয়েছে আমচত্বর।
আমের মৌসুমে রাজশাহী ও এর আশপাশের অঞ্চলে আম নিয়ে হয় মহাযজ্ঞ। আমের মুকুল কেমন হলো, কতটুকু শীতল আবহাওয়া বা বৃষ্টিবাদল—এ সবকিছু নিয়ে আম বাজারজাতকরণের প্রস্তুতি চলে। এ আম নিয়ে মানুষের উৎসাহের কমতি নাই। হলুদ, কমলা, সবুজ বা হলুদের বিভিন্ন শেডের মিশ্রণের বাহারি রং, জাতের বৈচিত্র্য আর সুমিষ্ট সুঘ্রাণের রসাল ফলটির সঙ্গে অন্য কোনো ফলের তুলনা হয় না। আকার-আকৃতি ও স্বাদের দিক দিয়েও সারা বিশ্বের আমপ্রেমীদের কাছে প্রশংসনীয় ও জনপ্রিয়। ছোট থেকে শুরু করে বড়—এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যে কিনা আম পছন্দ করে না। আম পাকার সময় যত ঘনিয়ে আসে, কেমন একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়।
এ অঞ্চলে আমের গাছে গাছে মুকুল আসতে শুরু হওয়ার পর থেকেই বাতাসে মুকুলের ম-ম গন্ধ আমচাষি ও আমপ্রেমীদের উদ্বেলিত করে। মুকুল আসে জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে। রাজশাহী অঞ্চলে শীতের প্রকোপ যেই বছর কম হয়, সেইবার তাড়াতাড়ি মুকুল হয়। শীত কম থাকার কারণে এ বছর রাজশাহী শহর ও আশপাশের অঞ্চলগুলোতে জানুয়ারি মাসেই আমের মুকুলে ছেয়ে যায়।
জনপ্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশে আম চাষের উৎকৃষ্ট অঞ্চল হিসেবে বৃহত্তর রাজশাহীকেই ধরা হয়। সব এলাকায় কমবেশি আমের চাষ করা গেলেও আমনির্ভর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাকে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আম চাষের সবচেয়ে উপযোগী অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্বাভাবিক কারণেই এখানকার জলবায়ুর মান, ভৌগোলিক পরিবেশ, সেই সঙ্গে চাষিদের যথার্থ পরিশ্রমের অর্জন হিসেবে অঞ্চলটি পরিণত হয় আমের রাজধানীতে। প্রাকৃতিকভাবেই আবাদি এ অঞ্চলে অনেক আগে থেকেই গড়ে উঠেছে বড় বড় আমের বাগান।
এ অঞ্চলের অনেক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমের সংস্কৃতি নিয়ে মগ্ন। অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে নিরাপদ, উচ্চ মানের আম উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণসহ যাবতীয় শিল্পদক্ষতা রপ্ত করেছেন এই অঞ্চলের লোকজন। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতেই ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের উৎপাদন প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন। প্রতি মৌসুমে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে বসে বাংলাদেশের বৃহত্তম আমের বাজার। ব্যতিক্রম স্বাদ ও নিরাপদ আমের পাইকারি বাজার হিসেবে সারা দেশের আমপ্রেমীদের কাছে ‘কানসাট আমবাজার’ সবচেয়ে বিখ্যাত।
আম আবাদের চর্চা রাজশাহীর একটি আদি অধ্যবসায়। ইতিমধ্যে জনপ্রিয়তার কারণে বেড়েছে আমবাগানের সংখ্যা, সেই সঙ্গে বেড়েছে আমের জাতও। গুটি আমের পাশাপাশি অতিপরিচিত গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, ফজলি, আশ্বিনা, আম্রপলি ছাড়াও স্থানীয় বাজারে গুরুত্ব পেয়েছে বারি-৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, কহিতুর, কাটিমন, মিয়াজাকি বা সূর্যডিমের মতো নতুন জাতের আমগুলো, যা আকৃষ্ট করছে বিদেশি চাহিদাকেও।
রাজশাহীর প্রায় সব গাছেই, বিশেষ করে পুরোনো গাছের তুলনায় নতুন গাছেই প্রচুর আম ধরতে দেখা গেছে। প্রতিবছরের তুলনায় এবারের ফলন ছিল যতটা বাড়তি, দামও ছিল ঠিক ততটাই সস্তা। চলতি মৌসুমে আম সংগ্রহের কাজ দুই সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হয়; উৎসব আমেজের সঙ্গে আমপাড়া ও একত্রীকরণের চিত্রটাও ছিল বেশ জমজমাট।
ইদানীং আধুনিক প্রযুক্তি ও আমবাগান করার অত্যধিক প্রবণতা পাল্টে দিচ্ছে কৃষি অর্থনীতির চেহারা। সাম্প্রতিক কালে উত্তরবঙ্গের প্রায় অধিকাংশ জেলাজুড়ে উন্নত জাতের আমবাগান নগরীকে বাণিজ্যিকভাবে স্বাবলম্বী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, কানসাট, ভোলাহাট ও গোমস্তাপুর অঞ্চলে স্থানীয় জাতের আমের পাশাপাশি রাজশাহীর নাটোর ও পুঠিয়া উপজেলার বানেশর এবং নওগাঁর সাপাহার এলাকার বাগানগুলোতে দেশি জাতের সঙ্গে আধুনিক ও বিদেশি জাতের চাহিদাসম্পন্ন কমবেশি আম চাষাবাদ হচ্ছে, যা বেশ লাভজনক।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবুল বাশারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি মৌসুমে রাজশাহী বিভাগে মোট ৯২ হাজার ৯১৩ হেক্টর জমির বাগানে আমের চাষ হয়েছে। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীতে ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর, নওগাঁতে ৩০ হাজার হেক্টর, নাটোরে ৫ হাজার ৭৪৭ হেক্টর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৩৭ হাজার ৫৮৮ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদিত হয়েছে। তা ছাড়া এবার রাজশাহীতেই ১ হাজার ৬৩ হেক্টর জমিতে আমের উৎপাদন বেড়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোর—৪ জেলা মিলিয়ে প্রায় ৯২ হাজার ৯১৩ হেক্টর জমিতে প্রায় ১১ লাখ ৫২ হাজার ৫০৬ মেট্রিক টনের আম হয়েছে। চলতি বছরের হিসাব অনুযায়ী, যার বাজারমূল্য দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা। রপ্তানি করা আমের সম্ভাব্য হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত রাজশাহীতে ৯ দশমিক ৯৭ মেট্রিক টন, নওগাঁ জেলা ৯০ দশমিক ২১ মেট্রিক টন ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ১৭২ দশমিক ১৫ মেট্রিক টন। বছরের টার্গেট অনুযায়ী যা ২৭২ দশমিক ৩৩ মেট্রিক টনের মতো।
সাধারণত আমের বাজারে আমচাষি নিজে বা বাজারের আড়তদারের মাধ্যমে আম বেচাকেনা হয়ে থাকে। তবে বাণিজ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আড়তদার ব্যবসায়ীদের তুলনায় মৌসুমজুড়ে বিভিন্ন অনলাইন প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পেজভিত্তিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আম পৌঁছে দিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্রেতাদের একদম নাগালে। দাম নির্ধারণ করছেন আমের গ্রেডিং বা প্রকারভেদ বুঝে।
মূলত সময় বাঁচাতে আম সড়কপথেই পরিবহন করা হয়। কারণ, পরিবহনে খুব বেশি সময়ক্ষেপণে আম পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া বাগান থেকে আম বাজারে নিতে ভ্যান বা ছোট পিকআপ ব্যবহার করা হয়। পরিবহনের উপযোগী করতে প্রথমত আম সংগ্রহের পর আঘাতপ্রাপ্ত, রোগাক্রান্ত, পোকায় আক্রান্ত ও গাছপাকা আম আলাদা করে বাছাই করা হয়। দূরে পাঠানোর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক উজ্জ্বল ও পরিপুষ্ট আম বাছাইয়ের কাজটি করতে হয় খুব গুরুত্বসহকারে। প্যাকিংয়ের জন্য সাধারণত বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহার করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালো ব্যবস্থা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় প্লাস্টিকের ক্র্যাটস। এর তলায় কিছু খড় বিছিয়ে অথবা প্রতিটি আম খবরের কাগজে মুড়িয়ে সারিবদ্ধভাবে বিচক্ষণতার সঙ্গে এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে করে নিচের আম বেশি চাপে পড়ে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। প্রতিটি প্যাকেটের গায়ে ফলের নাম, জাতের নাম, প্রাপকের নাম ও মুঠোফোন নম্বর লিখে পার্সেল তৈরি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গন্তব্যে।
বাংলাদেশে আমের মূল উৎস হলো রাজশাহী। দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ফলের মধ্যে এ শহরে আমের কদর যেমন সবচেয়ে বেশি, তেমনি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও সুমিষ্ট এই ফলের বেশ সমাদর। প্রতিবছরের মতো এবারও বিদেশিদের চাহিদা উপযোগী ‘ফ্রট ব্যাগিং’(রক্ষণাবেক্ষণ) পদ্ধতিতে উৎপাদন করা আম বিদেশের বাজারে রপ্তানি হচ্ছে। বলা চলে, এই বছর রাজশাহীতে আম উৎপাদনের চাহিদার মাত্রা বিগত বছরগুলোর রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আর তাতে কদর বাড়ছে আমচাষিদের, কদর বাড়ছে রাজশাহীর।