মাগুরা ও ঝিনাইদহ ‘কোর্ট ভিজিট’–এ আমরা
‘সবার জন্য ন্যায়বিচার থাকলেই প্রকৃত শান্তি অর্জিত হতে পারে।’ —ডেসমন্ড টুটুর এই উক্তির বাস্তবতা পরোক্ষ করতে আমরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের একঝাঁক শিক্ষার্থী গিয়েছিলাম মাগুরা ও ঝিনাইদহ কোর্ট ভিজিটে। ফৌজদারি কার্যবিধি কোর্সের অংশ হিসেবে কোর্স টিচার অধ্যাপক আলতাফ হোসেন স্যারের তত্ত্বাবধানে আমরা ফৌজদারি বিচারপ্রক্রিয়া সরেজমিনে দেখতে ৮ মে, বৃহস্পতিবার ২০২৫ মাগুরা ও ঝিনাইদহ আদালত ভিজিটে গিয়েছিলাম।
পূর্ব আকাশের বুক চিরে রক্তিম আভার ন্যায় সূর্য মামা উঁকি দেওয়ার আগেই আমরা জিয়া মোড়ে এসে উপস্থিত হই। ৬টা ৪৫ মিনিটে মেন গেট থেকে গাড়ি ছাড়ার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণে কিছুটা দেরি হয়ে গেল গাড়ি ছাড়তে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি গাড়ি নিয়েছিলাম। বাসগুলোর সঙ্গে আমাদের আবেগ জড়িয়ে আছে। বাসে উঠব বলে একদা কঠোর পরিশ্রম করেছি। আজ সেই স্বপ্নের বাসে উঠে বসেছি। আমরা মেন গেট থেকে রওনা হলাম। পথিমধ্যে বসন্তপুরসংলগ্ন রাস্তার পাশে আমাদের দুজন সহপাঠী অপেক্ষা করছিল। তাদের পেয়ে ভীষণ খুশি। আমরা একে অপরের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠেছি। কিন্তু আমাদের এ আনন্দের যাত্রা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কিছু দূর যাওয়ার পর আমাদের বহনকারী বলাকা বাসটি পথিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেল। পরবর্তী সময়ে জানতে পারলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরণ্যক নামক আরেকটি বাস পাঠানো হবে আমাদের জন্য। বাসটির জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। এ সময়ের মধ্যে আমরা আমাদের সকালের নাশতা সেরে নিলাম।
ঝিনাইদহ টার্মিনালে আমাদের সঙ্গে কোর্স টিচার যুক্ত হলেন। সেখানে আমাদের জন্য আপেক্ষা করছিল আমাদের বন্ধু রাজু, মেজবা, সেবাসহ আরও অনেকে। আমাদের এই পুরোটা যাত্রায় রাজু মেডিকেল সাপোর্টের দায়িত্বে ছিল। আমি তার থেকে কিছু মেডিসিন সংগ্রহ করে নিলাম। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো বাসটি এসে পৌঁছেছে। আমরা বিরতি শেষে পুনরায় আমাদের নিজ নিজ আসনে বসলাম। বাস সম্পূর্ণ গতিতে ছুটে চলেছে মাগুরার উদ্দেশ্যে। আমি লক্ষ করলাম রাস্তার দুই পাশের সারি সারি গাছগুলো তীব্র গতিতে আমাদের পেছনে ছুটছে। বাসের তীব্র গতি আর ঝাঁকুনিতে আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। নাজনীন, জান্নাত আমার অসুস্থতার কারণে ভীষণ টেনশন করছিল। বন্ধু রাজুর থেকে সংগ্রহ করা মেডিসিন তারা আমাকে দিল। আমি মেডিসিন নিয়ে জান্নাতের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঝলাম। কিছুটা সময় পর হঠাৎ করে সবার আনন্দধ্বনি শুনতে পেলাম। চোখ মেলতেই দেখলাম আমরা মাগুরা কোর্টে পৌঁছেছি।
মাগুরার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল মতিন আমাদের আইনের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। উনার ব্যবহার ছিল অমায়িক। দারুণ আন্তরিকতার সঙ্গে তিনিসহ সবাই আমাদের গ্রহণ করে নিলেন। আবদুল মতিন স্যারের রুম থেকে সরাসরি সেমিনার রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে যাওয়া আইন অনুষদের অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী। যারা এখন সম্মানের সঙ্গে মাগুরা কোর্ট আলোকিত করছেন। কিছুক্ষণ পরেই উপস্থিত হলেন জেলা ও দায়রা জজ মিজানুর রহমান। তিনিও আমাদের আইনের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। লাবিব এবং মাহফুজ ফুল দিয়ে তাদের বরণ করে নিলেন। আমাদের পেয়ে যে কতটা আনন্দিত হয়েছিলেন, তা আন্তরিকতা দেখেই বুঝতে পারতেছিলাম।
চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল মতিন স্যার আমাদের প্রথমেই খুবই সাবলীল ভাষায় জানালেন সাজা কেন দেওয়া হয়। তিনি বললেন, অপরাধীর অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সাজা দেওয়া হয়। তিনি আমাদের জানালেন একজন ভালো আইনজীবীর বৈশিষ্ট্য কিরূপ। আমাদের কী কী করা উচিত, সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিলেন। তিনি বললেন, ‘সনদ, চেষ্টা, আত্মবিশ্বাস, প্রাকটিস, ধৈর্য, ক্ষমার গুণ, ম্যানার অ্যান্ড এটি গেট এবং আত্মসমালোচনা। এগুলো তোমার মধ্যে থাকতে হবে। প্রথমেই সনদ নিতে হবে, কেননা তুমি যতই প্রাকটিস করো না কেন, সনদ ছাড়া তোমার কোনো ভ্যালিডিটি নেই। আসলে আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বড় অভাব, এটা আগে অর্জন করতে হবে। তোমাকে চেষ্টা এবং প্রাকটিসের মধ্যে থাকতে হবে, ভালো মানুষ হতে হবে, অন্যকে সম্মান করতে হবে, বিশেষ করে নিজের শিক্ষককে কখনোই অপমান করো না যদিও তোমরা তাঁদের থেকে বেশিও জানো তবু। নিজের আত্মসমালোচনা করবে নিজের ভুল নিজে চিহ্নিত করার চেষ্টা করবে। মনোযোগসহকারে সিনিয়রদের কথা শুনবে, আমি আমার সিনিয়র উকিলদের কথা শুনতাম। খুব মনোযোগী ছিলাম এবং আমি সঙ্গে সঙ্গে লিখতাম।’ তিনি আমাদের মাগুরার ধর্ষণের শিকার এক শিশুর মামলার ব্যাপারেও অনেক কিছু বললেন, যা ওখানে না গেলে অনেক কিছুই জানতে পারতাম না। আবেগ দিয়ে যে আইন চলে না—এটাও বুঝতে পারলাম। সব কিছুরই একটি আইনগত প্রক্রিয়া রয়েছে। তবে শিশুটি ইনশা আল্লাহ দ্রুত ন্যায়বিচার পাবে—এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল। ভালো আইনজীবীর জেরা তুলে সেটা স্টাডি করতে হবে তোমাদের। বিভিন্ন ধারা আছে, যা তোমাদের জানা জরুরি। সেই ধারার কেটগুলো পড়বা। ১০টি সিভিল মামলা ও ১০টি ক্রিমিনাল মামলা দেখবা। একটি মামলার জেরা, জবানবন্দি থেকে শুরু করে সব কিছু থাকতে হবে তাতে।
জেলা ও দায়রা জজ মিজানুর রহমান আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, রেগুলার পড়াশোনা করতে হবে, Where Law is? ল টা আসলে কোথায় আছে জানতে হবে, মোরালিটি, নিজের আচার ব্যবহার সুন্দর করতে হবে, নৈতিকতা ঠিক রাখবে, জ্ঞান আহরণ আর সব শেষে নিজের টার্গেট ঠিক রেখে আগিয়ে যেতে হবে। নিজের লক্ষ্য ঠিক রাখতে হবে। তিনি আমাদের সামারি ট্রায়েল সম্পর্কেও সুন্দর ধারণা দিলেন। এজলাসে উঠতে হবে, সেই জন্য তিনি আমাদের তার মহা মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় দিয়ে চলে গেলেন। আর মাঝে আমাদের জন্য নাশতা, কফি সব দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের দণ্ডবিধি কোর্সের শিক্ষক প্রোফেসর ড. আমজাদ হোসেন স্যার এসে উপস্থিত হলেন। আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর জজ সাহেবরা দিলেন। আমার ছোটবেলা থেকে জমানো একটি প্রশ্নের উত্তর আবদুল মতিন স্যার এত সুন্দর করে দিলেন যে আমার মনে হচ্ছিল আমার এখানে আসা স্বার্থক। সেমিনার শেষে আমাদের এজলাসে যাওয়ার জন্য বললেন। সেখানে আমরা দেখলাম কীভাবে ট্রায়েল হয়, সাক্ষী গ্রহণ হয়, কীভাবে রেমিডি চাওয়া ও দেওয়া হয়।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সেখান থেকে এসে আমরা মাগুরার একটি রেস্তোরাঁয় খাবার খেলাম। আমাদের ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইয়েরাও ছিলেন আমাদের সঙ্গে। যাঁরা মাগুরা কোর্টের আইনজীবী হিসেবে কর্মরত। ভাইয়েরা আমাদের জন্য লিচু আনলেন। আসার সময় আশিককে ওর সিট থেকে উঠিয়ে আমি জানালার কোনায় বসলাম আর আমার পাশে জান্নাত বসল। কারণ, আমার অনেক শরীর খারাপ লাগছিল। এরপর বাসে মাসুদ আমাদের সবাইকে ভাইদের দেওয়া লিচু সমানভাবে ভাগ করে দিল। অবশেষে বেলা তিনটার দিকে বাস এসে ঝিনাইদহ কোর্টের সামনে এসে উপস্থিত হলো। সেখানে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নেওয়া হলো। এর পরে আমাদের ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইয়েদের সঙ্গে আমাদের আরেকটি সেমিনার হলো। তাঁরা একে একে তাঁদের পরিচয় দিলেন ও আমাদের পরিচয় জানলেন। তাঁদের আইনজীবী হওয়ার গল্প শোনালেন। আমাদের সামনে ছিলেন ঝিনাইদহ জেলা বারের সিনিয়র আইনজীবী, যিনি ভাইদের সিনিয়র। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসেছেন। তিনার মুখে ভাইদের নিয়ে এত প্রশংসা শুনে সত্যিই খুব আনন্দ লাগছিল। সব শেষে আলতাফ স্যারের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেমিনার শেষ হলো। ভাইয়েরা আমাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেছিলেন, যা আমরা সবাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। অতি আনন্দে ‘কোর্ট ভিজিট’ শেষ হলো। এ ছাড়া আমাদের এই কোর্সে স্যার আমাদের কিছুদিন আগে ইবি থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন তদন্তপ্রক্রিয়া হাতে–কলমে দেখানোর জন্য। পড়ালেখার শেষ পর্যায়ে এসে এমন অভিজ্ঞতা আসলেই অন্য রকম একটি উদ্দীপনা সৃষ্টি করে তুলেছে আমাদের মধ্যে। স্যারদের এমন অনুপ্রেরণা আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে আরও আশাবাদী করে তুলেছে।
*লেখক: তামান্না ইসলাম, শিক্ষার্থী, আল ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া।