‘আমার কাছে রিঙ্গিত নেই’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন এবং জাতিসংঘের অর্থায়নে এক সপ্তাহের একটা প্রশিক্ষণ শেষ করে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো থেকে ঢাকায় ফিরলাম। এয়ারপোর্টের সব কাজ শেষ করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে সরাসরি বিমানবন্দরের বাইরে চলে এলাম। আসার পথে অনেকেই অনেক ধরনের সার্ভিস অফার করল। কিন্তু আমি সেদিকে কান দিলাম না। কারণ, বিমানবন্দর নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলো সবই ঠকে যাওয়ার গল্প। আমার ইচ্ছা, হেঁটে বিমানবন্দরের সামনে থেকে সরাসরি বাসে উঠে বাসায় ফেরা। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবয়সী এক নারী আমার পিছু নিলেন। বারবার আমাকে বলছেন, ‘বাপ, আমাকে একটা রিঙ্গিত দিয়ে যা।’ আমার হাবভাব দেখে উনার হয়তোবা মনে হয়েছে আমি মালয়েশিয়া থেকে ফিরেছি। আমি যতই বলি, ‘আমার কাছে রিঙ্গিত নেই।’ উনি মোটেও বিশ্বাস করেন না। আমি বাসে উঠে যাওয়ার আগপর্যন্ত উনি চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। অবশেষে আমি বাসে উঠে পড়লে উনি হাল ছেড়ে দিয়ে আবার বিমানবন্দরের দিকে ফিরে গেলেন।
সিডনি থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়ার জন্য আমাদের প্রথম পছন্দ মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস। কারণ, ওদের খাবার এবং আতিথেয়তা। সিডনি থেকে মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর তিন-চার ঘণ্টার ট্রানজিট থাকে। সেই সময় আমরা এয়ারপোর্টের মধ্যেই ঘোরাঘুরি করি, ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হই। ওয়াশরুমে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের চেহারা পরিচিত হওয়ায় সাহস করে বাংলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি বাংলাদেশি?’ উত্তরে উনি বললেন, ‘জি, আমার বাড়ি চাঁদপুরে।’ এরপর উনার সঙ্গে অনেক গল্প জমে গেল। উনাদের বেতন কেমন, সুবিধা কী কী এই সব নিয়ে। ইতিমধ্যে অনেক মানুষ ওয়াশরুমে আসছেন এবং বেরিয়ে যাচ্ছেন। এক ভদ্রলোক এসে বুঝে উঠতে পারছিলেন না সিংকের কলটা কীভাবে কাজ করে। সেটা উনি দেখিয়ে দিলেন। সেই ভদ্রলোক যাওয়ার সময় বকশিশ হিসেবে রিঙ্গিতের একটা নোট উনার পকেটে গুঁজে দিয়ে গেলেন।
করোনার প্রকোপ সবে কমে এসেছে। এমন সময় দেশে যেতে হলো। সে এক বিশাল ঝক্কির ব্যাপার। কত রকমের টেস্ট, আর তার কাগজ যে হাতের মধ্যে রাখতে হয়েছিল। আর কত রকমের যে ফরম পূরণ করতে হয়েছিল! মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টে কী একটা ফরম দিল। সেখানে সবই ইংরেজিতে লেখা। আমি দ্রুতই আমার ফরমটা পূরণ করে ফেললাম। এরপর একজন ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘ভাই, আমারটাও পূরণ করে দেন। আমি উনারটা হাতে নিতেই আমার সামনে মানুষের একটা বিশাল লাইন হয়ে গেল। উনারা সবাই মালয়েশিয়াতে কাজ করেন। এখন দেশে যাচ্ছেন। আমি বিমানে ওঠার আগে দ্রুত যতজনের পারি পূরণ করে দিলাম। তখন বাকিরা আফসোস করতে লাগলেন। আমি বললাম, ‘আপনারা বিমানে আমার কাছে এসেও পূরণ করে নিতে পারেন।’ পরে বিমানে বসেও সেই ফরম পূরণ করে দিলাম। ফরমটা পূরণ করে দেওয়ার পর উনারা আমার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার যে হাসি দিচ্ছিলেন, সেটা ছিল অমূল্য। মনটা নিমেষেই ভালো হয়ে গেল।
গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে ঝটিকা সফরে দেশে যেতে হলো। মালয়েশিয়া গিয়ে ফটকের সামনে বসে আছি। একে একে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছেন। তাঁদের প্রায় সবাই মালয়েশিয়াতে শ্রমিকের কাজ করেন। সবার পোশাক-আশাকই চটকদার। মাথায় বাহারি চুলের কাট। চোখে রোদচশমা। কানে কর্ডলেস হেডফোন। হাতে ক্যামেরাওয়ালা মুঠোফোন। সারাক্ষণই উনারা দেশের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছেন। প্রত্যেকের মুখই দেশে স্বজনের কাছে ফেরার খুশিতে উদ্ভাসিত। কতবার করে যে বলছেন, ‘সব কাজ শেষ করে বসে আছি, একটু পর বিমানে উঠব।’ হয়তোবা তখন দেশে থেকে উনার বাবা, মা, নতুন বউ, ছোট বাচ্চাটা বিমান দেখতে চাইছে। উনি তখন মোবাইলের ক্যামেরা ঘুরিয়ে বিমান দেখাচ্ছেন। আমরা নিজে শত কষ্টে থাকলেও প্রিয়জনকে সব সময়ই হাসিখুশি, সুখী দেখতে চাই।
কার জন্য কী নিয়ে যাচ্ছেন, তার তালিকা বলছেন। সেটা নিয়ে আসতে বিমানের লোকদের সঙ্গে কত বাগ্বিতণ্ডা হয়েছে, তার বর্ণনা দিচ্ছেন। উনাদের কথা শুনি আর ভাবি, আহা, কত সহজ-সরল একটা জীবন! কত সামান্যতেই না খুশি হওয়া যায়। আর আমরা দেশ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছি, দেশের সর্বোচ্চ সরকারি চাকরি করেছি। তাতেও নিরাপদ বোধ না করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছি। সেখানে গিয়েও কি নিরাপদ ভাবছি নিজেদের? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন যাতে সচ্ছলতায় কাটে, তার জন্য বাড়ি-গাড়ি আরও কত কি করছি! এতে আসলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপকার না অপকার করছি, সেটা ভেবে দেখার দরকার আছে। নিজের জন্য কিছু নিজে করার মধ্যে যে আনন্দ, সেই আনন্দ থেকে আমরা তাদের বঞ্চিত করছি। তাদের আত্মবিশ্বাস তৈরি হতেও দিচ্ছি না। যা-ই হোক, সেটা নিয়ে অন্য সময় লিখব।
ঢাকা বিমানবন্দরে চেকইনের জন্য একটু আগেভাগেই আসতে হয়। ভেতরে ঢুকে দেখি, অনেক মানুষ একই ধরনের টি-শার্ট এবং ক্যাপ পরে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা যখন গেটের কাছে গেলাম, তখন তীব্র একটা দুর্গন্ধ এসে নাকে লাগল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারলাম, এটা ঘামে ভেজা মোজার গন্ধ।
এইবার বিমানে সিট পড়েছিল টয়লেটের কাছাকাছি। বিমান ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মোটামুটি তাই আমাদের সামনে লাইন লেগে গেল। একে একে সবাই টয়লেটে যাচ্ছেন। হঠাৎ দেখি এক ভদ্রলোক টয়লেটের দরজা খুলে নাক মুখ সিঁটকে ফেললেন। উনার আগেই একজন টয়লেট থেকে বের হয়েছেন। কিন্তু টয়লেট করে হয়তোবা ফ্ল্যাশ করেননি। তাই অপরিষ্কার টয়লেট দেখে উনার মুখের এই অভিব্যক্তি। একটু পর বিমানবালা এসে টয়লেটের ভেতরে ঢুকে পরিষ্কার করলেন তারপর উনি ঢুকলেন। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে একজন করে টয়লেট থেকে বের হওয়ার পর বিমানবালা টয়লেটে ঢুকে পরিষ্কার করেন তারপর পরেরজন ঢুকেন। এতে বেশ বড় জটলা তৈরি হয়ে গেল। তখন আসল ঘটনা বুঝলাম। আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা টয়লেটে গিয়ে ছোট হোক বড় হোক, টয়লেট সেরেছেন; কিন্তু ফ্ল্যাশ করেননি। কারণ, উনারা জানেন না কোন বোতামে চাপ দিয়ে ফ্ল্যাশ করতে হয়।
এমনিতেই বিমানের টয়লেটগুলো ছোট আকৃতির। আর তার মধ্যে এত রকমের বোতাম যে উনারা ভয়ে কোনো বোতাম না চেপে বের হয়ে আসাটাকেই নিরাপদ মনে করেছেন। আমার শুধু অবাক লাগে, উনাদের যেসব এজেন্সি বিদেশে নিয়ে এসেছে, তারা সামান্য একটা টয়লেট ট্রেনিং তো দিতেই পারত। কারিগরি প্রশিক্ষণ বা ভাষার প্রশিক্ষণের কথা না হয় বাদই দিলাম। গ্রামের এই সব গরিব মানুষের কাছ থেকে দরকারের তুলনায় তিন-চার গুণ বেশি টাকা নিয়ে উনাদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। উনাদের এটুকু উপকার করতে তো বেশি কিছু লাগার কথা নয়। বিমানের টয়লেটের কয়েকটা ছবি তুলে কোন বোতামটা কোথায় থাকে, সেটা দেখিয়ে কোনটাতে চাপ দিতে হবে, দেখিয়ে দিলেই উনারা পারতেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ, আমাদের শিখতে সময় লাগে না।
বছরখানেক সাভার উপজেলার সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছিলাম। তখনকার একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের নিজের কাজের বাইরেও অনেক কাজ করতে হয়। তার মধ্যে একটা কাজ হলো কাগজপত্র সত্যায়ন করার ক্ষমতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, পাসপোর্টের আবেদন করতে, চাকরিতে, বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে দরকারি কাগজপত্র সত্যায়ন করে জমা দিতে হয়। সরকারি লোকজন এমনিতেই সারা দিন বিভিন্ন ঝামেলায় থাকেন। তাই তাঁরা এগুলো এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। আমি এটাকে উপভোগই করতাম। যিনিই আসতেন, তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতাম। প্রত্যেক মানুষই আমার কাছে একেকটা বইয়ের মতো। তাই তাঁদের সঙ্গে গল্প করাটা একটা নতুন বই পড়ার অভিজ্ঞতার মতো লাগে আমার কাছে।
একদিন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক এসে আমাদের অফিসের দরজায় জুতা খুলছেন দেখে বললাম, জুতা খুলতে হবে না, ভেতরে আসেন। ভেতরে আসার পর জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলেন, আপনার জন্য কী করতে পারি?’ উনি বললেন, ‘স্যার, আমি মিডল ইস্টে কাজ করি। আমার হাতে লেখা পাসপোর্ট। এখন ওরা মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট বানাতে বলেছে। তার আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। তাই কিছু কাগজপত্র সত্যায়িত করতে হবে।’ আমি উনাকে বসতে বলে কাগজগুলো বের করতে বললাম। আর জিজ্ঞেস করলাম, মূল কপিগুলো এনেছেন কি না? আমি সাধারণত মূল কপিগুলো একঝলক দেখেই সত্যায়ন করে দিই। স্বাক্ষর করতে করতে বললাম, ‘দেশের অর্থনীতি তো টিকিয়েই রেখেছেন আপনারা। আপনাদের রক্ত পানি করা পয়সাতেই আমাদের বেতন হয়।’
এটা শুনে উনি অঝোরধারায় কাঁদতে শুরু করলেন। সেটা দেখে আমি একটু বিড়ম্বনায় পড়ে গেলাম। উনি বেশ কিছুটা সময় নিলেন ধাতস্থ হতে। স্থির হয়ে যেটা বললেন তার সারমর্ম এমন। উনি খুব সকালে সাভারের একটা ইউনিয়ন থেকে উপজেলাতে এসেছেন। এই আশায় যে সেখানে তো অনেক প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা আছেন, তাঁদের কাউকে না কাউকে দিয়ে সত্যায়ন করিয়ে নেবেন। একটা উপজেলাতে অনেকগুলো প্রথম শ্রেণির পোস্ট থাকে। তাঁদের যে কেউই সত্যায়ন করে দিতে পারেন।
উনি সকাল থেকে প্রায় প্রতিটা অফিসেই গেছেন। কেউ গল্প করছেন, বলেছেন, অন্য জায়গায় যেতে। কেউ চা খাচ্ছেন, বলেছেন, অন্য জায়গায় যেতে। অবশেষে উনি আমার কাছে এসেছেন। আমি সত্যায়ন করে দিয়ে বললাম, হিসাবরক্ষকের কাছ থেকে সিল দিয়ে নিতে। একটু পর উনি আবার আমার কক্ষে ফিরে এলেন। হাতের একটা কাগজে উনার বাড়ির ঠিকানা লেখা। তারপরও উনি বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে যেতে হবে। বললেন, কোনো কাজে ওই ইউনিয়নে গেলে যেন অবশ্যই তাঁর বাড়িতে যাই। অবশ্য আমি শেষ পর্যন্ত উনার বাসায় যেতে পারিনি।
আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন বাংলালিংক মোবাইল ফোন কোম্পানিতে কাজ করি। আমাদের অন্যতম সাবকন্ট্রাক্টর চীনা কোম্পানি হুয়াইয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করতে সাইটে গিয়ে একদিন ওদের ইংরেজিতে নির্দেশনা দিচ্ছিলাম। কিন্তু ওদের মুখের ভাব দেখে বুঝলাম, ওঁরা আমার কথা বুঝতে পারছেন না। একটু পর ওঁরা ম্যানেজারকে ডেকে নিয়ে এলেন। তিনি এসে বললেন, ‘তোমার যা দরকার আমাকে বলো।’ আমি ওঁদের বুঝিয়ে দিচ্ছি। ওঁরা শুধু ওঁদের কাজটাই জানেন, ভাষাটা জানেন না। শুনে আমি খুবই অবাক হলাম। পাশে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনে উঁকি দিয়ে দেখি, সেখানে মাই কম্পিউটার, রিসাইকেল বিন, এই কথাগুলো চীনা ভাষায় লেখা। তখন আমি হাতে-কলমে দক্ষ জনশক্তির সঙ্গে পরিচিত হলাম।
বর্তমান বিশ্বে জনসংখ্যা দেশের জন্য বোঝা নয়, বরং সম্পদ। যদি আপনি ঠিকভাবে সেটাকে কাজে লাগাতে পারেন। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের সস্তা শ্রমের চাহিদা বিশ্বজোড়া। ভারত ও চীন তাদের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করেছে। তারা তাদের দেশের পাসপোর্ট করাসহ সরকারি কাজগুলো সহজ করে দিয়েছে। আর বিদেশে পাঠানোর আগে সেই কাজের ওপর একটা ছোট প্রশিক্ষণ দিয়ে দিচ্ছে, যাতে কাজটা ঠিকঠাক করতে পারেন। ভাষাটা তেমন দরকারি নয়; কারণ, তাঁদের ওপর উভয় দেশের ভাষা জানা একজন টিম লিডার থাকবেন, যাঁর কাছ থেকে তাঁরা নির্দেশনা পাবেন। আমরাও যদি এভাবে আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে পারতাম, তাহলে প্রকৃত অর্থে সোনার বাংলা তৈরি হতে বেশি সময় লাগবে না। কারণ, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষেরা অনেক কর্মঠ। তাঁরা যেকোনো কাজ করতে আগ্রহী।