শিক্ষানীতি ২০২২ বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা ও পরামর্শ

ফাইল ছবি

স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কয়েকটি জাতীয় শিক্ষানীতির প্রস্তাব করা হলেও কোনো শিক্ষানীতিই দেশের জনগণের আস্থা পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি। এ কারণে বারবার শিক্ষানীতি পরিবর্তন করতে হয়েছে। এর ফলে সনদধারী শিক্ষিতের হার বেড়েছে, বাড়েনি সুশিক্ষিতের হার।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকায়ন, বিজ্ঞানসম্মত, যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানসম্মত করার লক্ষ্যে ২০২২ সালে প্রণীত হয় শিক্ষানীতির একটি নতুন রূপরেখা। আইনি জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন ফাইলবন্দী থাকার পর ২০২৩ সালে শুরু হয় এর বাস্তবায়ন। শিক্ষাক্রম বা কারিকুলাম ২০২২ বাস্তবায়নের শুরুটা সুন্দর হলেও প্রায় এক বছরের কাছাকাছি সময়ে এসে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

শিক্ষকেরা নতুন এ শিক্ষাক্রমের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন কি না শুরু থেকেই সেটি একটি ভাবনার বিষয় ছিল। কারণ, শিক্ষকদের কোনোরকম প্রশিক্ষণ না দিয়েই ২০২৩ নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী সাজানো পাঠ্যবই। যেকোনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চালিকা শক্তি হলেন শিক্ষক। প্রশিক্ষণ ছাড়া সম্পূর্ণ নতুন এ শিক্ষাক্রম পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষকেরা যে প্রশ্নবিদ্ধ হবেন, এটি অনেক আগে থেকে অনুমেয় ছিল।

অন্যদিকে অভিভাবকেরা মনে করছেন যে তাঁদের সন্তানেরা কিছুই শিখছে না। শুধু কাগজ কাটাকাটি করে সময় নষ্ট করছে। আর যেহেতু এটি প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা নয়, শিক্ষার্থীরাও তাদের ফলাফল নিয়ে চরম অসন্তুষ্ট। এ ত্রিমাত্রিক অসন্তুষ্টির বেড়াজালে আটকে পড়েছে শিক্ষাক্রম ২০২২। এ অবস্থায় অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর দাবি শিক্ষাক্রম বাতিল করা হোক। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সাতটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীরা তিন দফা দাবি আদায়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। তাঁদের দাবিগুলো হলো—

* নতুন কারিকুলাম বাতিল করতে হবে।

* পরীক্ষাপদ্ধতিতে ফিরে আসতে হবে।

* ব্যবহারিক কাজগুলো স্কুল সময়ের ভেতর স্কুলেই শেষ করতে হবে।
অভিভাবকদের এ তিন দফা দাবির প্রথম দুটি আযৌক্তিক হলেও শেষেরটি যুক্তিসংগত ও আদায়যোগ্য।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে কয়েকটি কর্মপরিকল্পনার ওপর আলোকপাত করছি।

প্রথমত, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে বিএড ও এমএড কোর্সের পাঠ্যবই, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। সম্পূর্ণ নতুন ও ভিন্নধর্মী এ পদ্ধতি শিক্ষকেরা তখনই আত্মস্থ করতে পারবেন, যখন তারা বেশি বেশি প্রশিক্ষণ পাবেন। দু–তিন মাস পরপর উপযুক্ত যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন প্রশিক্ষক দ্বারা শুধু লেকচারভিত্তিক নয়, অ্যাকটিভিটি–ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে শিক্ষকেরা হাতে–কলমে সবকিছু শিখতে পারেন।

যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীর শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে ফলাফল নির্ধারিত হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষককে দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখতে হয়। এর সবকিছু প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু হতে হবে। কারণ, একজন যোগ্য শিক্ষকই পারবেন একটি শিক্ষাক্রম সফলভাবে বাস্তব রূপ দিতে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দিতে হবে প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ ও সঠিক নির্দেশনা। মোটকথা শিক্ষকদের এ শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ব্যবহারিক কাজকর্ম সম্পূর্ণটা শিক্ষার্থীরা যেন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিদ্যালয়ের উদ্যোগ ও খরচে বিদ্যালয়ে শেষ করতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে। গ্রুপ ওয়ার্ক বিদ্যালয়ে গ্রুপের সঙ্গে বসেই করতে হবে, বাসায় একাকী কাজ করলে সেটা কখনো গ্রুপ ওয়ার্ক হয় না। এ ছাড়া প্রজেক্ট ওয়ার্ক হবে অথেন্টিক; গুগল, ইউটিউব দেখে করলে তাতে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শিক্ষার্থীরা প্রজেক্ট ওয়ার্ক করবে শিক্ষকের নির্দেশনা অনুযায়ী। এতে শিক্ষা ডিভাইস–কেন্দ্রিক হবে না। ব্যবহারিক উপস্থাপনা থেকে তথ্য ও তত্ত্ব সংগ্রহ করতে হবে। এ থেকে তাত্ত্বিক কোন বিষয় শিখল, সেখানে আলোকপাত করতে হবে।

ব্যবহারিকের তুলনায় তাত্ত্বিক দিকের ওপর তুলনামূলক কম গুরুত্ব দেওয়ায় অভিভাবকেরা বুঝতে পারছেন না যে তাঁদের ছেলেমেয়েরা আসলে স্কুলে কী শিখছে, আর বাসায় কী করছে। শিখনপদ্ধতির বেশ কিছু দিকের অস্পস্টতার কারণে তাঁরা মনে করছেন, ছেলেমেয়েরা স্কুলেও যেমন কিছু শিখছে না, বাসায় এসেও লেখাপড়ার কোনো প্রয়োজন মনে করছে না। অভিভাবকেরা মূলত পাঠ্যবই, পাঠপদ্ধতি ও মূল্যায়নের পদ্ধতি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। তাঁদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের বিষয়টি আলোচনার মধ্য নিয়ে আসতে হবে এবং দূর করতে হবে।

এই শিক্ষানীতি সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন করে তুলতে হবে। এর প্রচার ও প্রসার বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে তথ্যসংবলিত ভিডিও বানিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে; যাতে অভিভাবকেরা সহজে এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন।

তৃতীয়ত, মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন দরকার এবং মূল্যায়ন সূচকের বোধগম্যতা সৃষ্টি করা দরকার। মূল্যায়নপদ্ধতিতে ত্রিভুজ–চতুর্ভুজের পরিবর্তে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গ্রেডিং পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। মূল্যায়নপদ্ধতি এমনভাবে সাজাতে হবে, যেন একজন শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার স্মৃতিশক্তি বিকাশের দিকটিও মূল্যায়ন করা হয়। ব্যবহারিক উপস্থাপনার পাশাপাশি তাত্ত্বিক উপস্থাপনও যেন সমান গুরুত্ব পায়। মূল্যায়ন সূচকের দুর্বোধ্যতার কারণে অভিভাবকেরা এ পদ্ধতির প্রতি অনাগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এ সূচকের মাধ্যমে করা মূল্যায়নপত্র অভিভাবকেরা যখন হাতে পাচ্ছেন, তখন তাঁরা বুঝতে পারছেন না যে তাঁদের ছেলেমেয়েরা মেধা বিকাশের কোন পর্যায়ে আছে।

চতুর্থত, শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও সম্মানী প্রদান করতে হবে। শিক্ষকেরা যেন তাঁদের জ্ঞান ও দক্ষতার সবটুকু দিয়ে এ কারিকুলাম বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে পারেন, সে জন্য তাঁদের যোগ্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাঁদের জীবনমান উন্নয়নের দিকেও নজর দিতে হবে।

এ ছাড়া শিক্ষা খাতে সরকারকে বাজেট বাড়াতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সেরা স্কুলের তালিকা তৈরি না করে লেভেল প্লেয়িংয়ের দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে, যাতে সব স্কুল সমান সুযোগ–সুবিধা পায় ও সমানতালে চলতে পারে। সমালোচনার খাতিরে সমালোচনা নয়, বরং প্রকৃত সমস্যা তুলে ধরতে হবে এবং তার প্রতিকারের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।  

নতুন এ কারিকুলামে শিক্ষার্থীর ওপর লেখাপড়ার চাপ নেই, অসম প্রতিযোগিতা নেই, রোল নম্বর নেই, পিঠে নেই বইখাতায় ভরা ভারী ব্যাগ, নেই পরীক্ষাভীতি। বাড়ির কাজ কম থাকায় কোচিং বা প্রাইভেট পড়ার দৌরাত্ম্য নেই। তারা আনন্দের সঙ্গে প্রজেক্ট বানাচ্ছে ও উপস্থাপন করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা যখন কোনো কিছু আনন্দের সঙ্গ শেখে, সেই শিক্ষা দীর্ঘমেয়াদি হয়, যেখানে মুখস্থবিদ্যা ভুলে যাওয়ার প্রবণতা থাকে অনেক বেশি। এ শিক্ষাক্রম অবশ্যই শিক্ষার্থীবান্ধব ও যুগোপযোগী। একে সাধুবাদ জানাতে হবে এবং এর সফলতার জন্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

এ শিক্ষাক্রম বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে উন্নত বিশ্বের শিক্ষাক্রম অনুকরণে করা হয়েছে, যা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এটি বাস্তবায়নে একদল জ্ঞানীগুণী, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা–গবেষক নিরলস ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তঁদের সঙ্গে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। তাহলে এ শিক্ষানীতি আলোর মুখ দেখতে পাবে।
*লেখক: ফারজানা বেগম, সিনিয়র শিক্ষক, অ্যাপল ট্রি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, মিরপুর, ঢাকা- ১২১৬