মানুষ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সম্প্রতি আমার এক সুহৃদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন। তার মন্তব্যটি এ রকম, ‘ছোটবেলায় গরুর রচনা পড়েছিলাম, তাই গরু চিনতে ভুল হয় না। কিন্তু মানুষের রচনা পড়া হয়নি তাই মানুষ চিনতে এখনো ভুল হয়।’ তার মন্তব্যটি হাস্য-রসাত্মক মনে হলেও আসলে কথাটির অর্থ কিন্তু অনেক গভীর। সত্যিই মানুষ চেনা রীতিমতো কঠিন কাজই বটে। এ জন্যই বোধ করি বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের ‘Know Thyself’ এই শব্দ দুটিকে তাঁর মহামূল্যবান বাণী হিসেবে গণ্য করা হয়। একই কথা আরেক মনীষী অ্যারিস্টটলও বলেছিলেন, ‘Knowing yourself is the beginning of all wisdom’। আত্মপরিচয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা তথা জ্ঞানার্জন করা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তা বলাই যায়। অথচ কত জ্ঞান-বিজ্ঞান, কত শিল্প-সাহিত্য, কত ইতিহাস-ঐতিহ্য আমরা জানার চেষ্টা করি; কিন্তু মানুষ সম্পর্কে বা নিজের পরিচয় সম্পর্কে আমাদের জানার আগ্রহ তেমন নেই। ফলে মানুষ চিনতে আমাদের ভুল হয়। তাই আমার আজকের লেখার বিষয় ‘মানুষ’।

২.

মানুষ কাকে বলে বা মানুষের সংজ্ঞা কী? ছোটবেলায় গরুর রচনা পড়তে গিয়ে আমরা বলতাম, গরু একটি গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণী। যার চারটি পা, দুটি কান, দুটি চোখ, দুটি শিংবিশিষ্ট একটি মাথা ও একটি লম্বা লেজ আছে। একইভাবে মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে যদি বলা হয়, মানুষ একটি প্রাণী, যার দুটি হাত, দুটি পা, দুটি চোখ, দুটি কান, একটি নাক, একটি মুখ ও একটি মাথাবিশিষ্ট শরীর রয়েছে। এটুকু বললেই কি মানুষের সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। এর উত্তর হলো, না। প্রাণ থাকলেই আমরা তাকে প্রাণী বলি আর মানুষ হতে হলে প্রাণের সঙ্গে মনও থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ মন আছে বলেই আমরা মানুষ। চলুন একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি—একটি কম্পিউটার যেমন কিছু হার্ডওয়্যার (মনিটর, সিপিইউ, কি–বোর্ড, মাউস) ও সফটওয়্যারের (অপারেটিং ও অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার) সমন্বয়ে গঠিত, ঠিক একইভাবে মানুষও শরীর (হার্ডওয়্যার), আত্মা ও মন (অপারেটিং ও অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার) এই তিনটির সমন্বয়ে সৃজিত একটি প্রাণী, যাকে অন্য সব সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে।

৩.

মানুষের সবচেয়ে বড় স্বাতন্ত্র্য হলো তার মেধা, জ্ঞান, বুদ্ধি ইত্যাদি। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ যাপিত জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে মেধা, জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে তাকে টিকে থাকতে হয়। যেমন মানুষের প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা ক্ষুধা নিবারণের জন্য তাকে মেধা খাটাতে হয়। অন্যান্য সৃষ্টি বা পশুপাখি যেখানে প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত খাবার সরাসরি গ্রহণ করে, মানুষকে সেখানে তার মেধা খাটিয়ে খাদ্য উৎপাদন, চাষ, খাদ্যের উৎস সন্ধান, প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে তার খাদ্যের সংস্থান করতে হয়। একইভাবে তার লজ্জা নিবারণ, বাসস্থান তৈরি, চিকিৎসাসহ জীবনের প্রয়োজনীয় সব উপকরণের জন্য কত প্রযুক্তি, কত কলাকৌশল রপ্ত করতে হয়, কত জ্ঞানবুদ্ধি খরচ করতে হয়। এ জন্যই মানুষকে এ মহাবিশ্বের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী বলা হয়। দ্বিতীয়ত, মানুষের আরেকটি আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো—মানুষকে স্রষ্টা কিছু কিছু বিষয়ে স্বাধীনতা দিয়েছেন, যেখানে অন্যান্য সৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে একটি নিয়মের অধীন। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে কিছু বিষয়ে (জন্ম-মৃত্যু, বেড়ে ওঠা, বিভিন্ন জৈবিক বিষয়াবলি ইত্যাদি) নিয়মের অধীন ঠিকই, তবে তার কর্মের স্বাধীনতা রয়েছে। তৃতীয়ত, মানুষের রয়েছে চিন্তা ও কল্পনা করার ক্ষমতা। মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যে তার জৈবিক চোখ ছাড়াও কল্পনার চোখ দিয়ে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের অনেক কিছু দেখতে পারে। চতুর্থত, মানুষের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, সে তার মনের ভাব, চিন্তা-কল্পনাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে। আবার সেই ভাবকে প্রতীক, সংকেত বা চিহ্নের মাধ্যমে লিপি আকারেও প্রকাশ করতে পারে। যা এই মহাবিশ্বে অন্য কোনো সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয়। সর্বোপরি মানুষকে এই সৃষ্টিজগতের অনেক কিছুর ওপর আধিপত্য করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

৪.

তবে এই বৈশিষ্ট্যগুলোই মানুষের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় বহন করে না। কারণ, মানুষের মধ্যে একাধারে দুটি বিপরীতমুখী বৈশিষ্ঠ্য রয়েছে—মনুষ্যত্ব ও পশুত্ব। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে একদিকে যেমন সৃষ্টির সেরা হওয়ার মতো গুণাগুণ দিয়েছেন অন্যদিকে তার মাঝে এমন কিছু প্রবৃত্তি দিয়েছেন, যা তাকে মহাবিশ্বের নিকৃষ্টতম অবস্থায় পৌঁছে দিতে পারে। আর বিপরীতমুখী এই দুটি স্বভাবের মাঝে যার মধ্য যেটির আধিক্য পরিলক্ষিত হয়, সে সেই দলভুক্ত। সুতরাং মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার সবচেয়ে বড় উপাদান হলো ‘মনুষ্যত্ব’। আর মনুষ্যত্ব হলো সেসব গুণের সমষ্টি (দয়া–মায়া, প্রেম-ভালোবাসা, মহানুভবতা, উদারতা, জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেকবোধ, চিন্তাশীলতা, সভ্যতা, সৌন্দর্যবোধ, শৃঙ্খলা-নিয়মানুবর্তিতা, পরিচ্ছন্নতা, সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি) যা মানুষকে অন্য সব প্রাণী বা সৃষ্টি থেকে আলাদা করেছে। মানুষকে একদিকে যেমন ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, আবার এই মহাবিশ্বের হেন অপকর্ম নেই, যা মানুষের দ্বারা সংঘটিত হয় না। তাই তো আমরা দেখি, হত্যা-মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় (বৃক্ষনিধন, পাহাড় ধ্বংস, কার্বন নিঃসরণ, জলাশয় ভরাট ইত্যাদি), পরিবেশ (বায়ু, পানি, মাটি) দূষণসহ জলে-স্থলে যত ধরনের অনিষ্ট, সবই মানুষেরই কর্ম।

মোদ্দাকথা, মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচায়ক হলো ‘মনুষ্যত্ব’। মনুষ্যত্বহীন ব্যক্তি আকারে–অবয়বে মানুষের মতো দেখালেও আদতে সে মানুষ নয়। আর এদের জন্যই ‘অমানুষ’ শব্দটির উদ্ভব ও প্রয়োগ। তাই তো বলা হয়, There is a big difference between Human Being and being Human.

*লেখক: জেলা লাইব্রেরিয়ান, শেরপুর

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]