আশা-নিরাশার দোলায় দোদুল্যমান নিরাপদ সড়ক

ফাইল ছবি

নিরাপদ সড়ক বলতেই আমাদের মানসপটে এমন এক সড়কচিত্র ভেসে ওঠে, যেখানে সবাই নির্বিঘ্নে এবং শঙ্কামুক্ত চিত্তে চলাফেরা করতে পারে। তা সে হেঁটেই হোক, সড়ক পারাপারেই হোক, সাইকেল চালনাতেই হোক আর কার-মোটরসাইকেল বা অন্য কোনো যানবাহনেই হোক।

‘নিরাপদ সড়ক’ এবং ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ বিষয় দুটি পরস্পরবিরোধী এবং বিপরীতমুখী হলেও সচেতনতার লক্ষ্যে এর একত্রে আলোচনা খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিবছর ঘটছে বিপুল পরিমাণে হতাহতের ঘটনা এবং তা বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে আমাদের দেশের দুর্ঘটনার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে অনেক ওপরের দিকে, যা প্রতিবছর ক্রমান্বয়ে আরও ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে তো হচ্ছেই।

এমনই একটা পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, গত বছর সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে, যা ২ হাজার ২১৪ জন। এটি মোট দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এরপরই রয়েছে পথচারীর মৃত্যুর সংখ্যা, যা ১ হাজার ৫২৩ জন। এটি মোট দুর্ঘটনার ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। অন্য একটা পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, সরকারি হাসপাতালগুলোর বাৎসরিক চিকিৎসার বাজেটের ৩০ শতাংশ শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় ব্যয় হয়। এটি অতিমাত্রায় উদ্বেগজনক ও আশঙ্কাজনক।

পরিসংখ্যানগুলোতে যা-ই দেখানো হোক, বাস্তবচিত্র কিন্তু আরও অনেক ভয়ংকর। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত সাধারণভাবে সংগ্রহ করা হয় থানাগুলো থেকে। অনেক সময় দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করে না। অনেক সময় অভিযোগ করলেও সেটি চলে যায় গোপনীয়তার স্তরে। আবার প্রভাবশালীরা ভয় দেখিয়ে বা টাকার জোরে বিষয়টিকে থানার বাইরেই মিটিয়ে ফেলে, যার ফলে এসব দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত থানার রেকর্ডে থাকে না। এ ধরনের ঘটনা কিন্তু কম নয়, যার কথা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। তারপরও সড়ক দুর্ঘটনার যে সব চিত্র পরিসংখ্যানে আসছে, তা অতিশয় আতঙ্কজনক।

দেশের সড়ক ব্যবহারকারীদের আমরা আট শ্রেণিতে ভাগ করতে পারি—
১. পথচারী
২. বাইসাইকেল
৩. রিকশা
৪. মোটরসাইকেল
৫. সিএনজিচালিত অটোরিকশা
৬. বাস/ট্রাক/বড় কাভার্ড ভ্যান/ও অন্যান্য ভারী যানবাহন ইত্যাদি
৭. মিনিবাস/ছোট কাভার্ড ভ্যান/লেগুনা (হিউম্যান হলার) ইত্যাদি
৮. কার/জিপ(এসইউভি)/মাইক্রোবাস ইত্যাদি।

এই আট শ্রেণির প্রতিটিই আলাদা স্পিড-ভ্যালু বহন করে। এ কারণে অপেক্ষাকৃত কম স্পিডের যানবাহন অপেক্ষাকৃত বেশি স্পিডের যানবাহন চলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, যা থেকে সূত্রপাত হয় অ্যাক্সিডেন্টের। তাই চলার পথকে দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে এবং অবাধ চলাচল বজায় রাখতে প্রতিটি শ্রেণির জন্য আলাদা এবং স্বাধীন লেন প্রয়োজন। অর্থাৎ, প্রতিমুখী ৮ লেন করে মোট ১৬ লেনের রাস্তা (ফুটপাতসহ) নির্মাণ করা প্রয়োজন (ফুটপাত বাদ দিলে ১৪ লেন) যা বাস্তবে প্রায় অসম্ভব।

দেশের বেশির ভাগ সড়ক (ফুটপাত বাদ দিলে) ৪ লেন বা ৬ লেনের। এর মধ্যেই ১৪ লেনের সব যানবাহনগুলোকে, অ্যাক্সিডেন্টের আশঙ্কার কথা মাথায় রেখেই, চলতে হয়। ওভারটেকিংয়ের সুযোগ না থাকলে (যা বেশির ভাগ সময়েই থাকে না) সবচেয়ে কম গতিসম্পন্ন যানটির পেছনে পেছনে বাকি সব যানবাহনকে চলতে হয়, যা অসহনীয়। বাস্তবে যা ঘটে, বেশি স্পিডের যানবাহন কম স্পিডের যানবাহনকে পাশ কাটিয়ে এগোনোর জন্য মরিয়া হয়ে অনবরত চেষ্টা চালাতে থাকে, যা থেকে অবশ্যম্ভাবীভাবে সড়ক দুর্ঘটনার সূত্রপাত।

দেশের সড়কগুলোতে এমন অনেক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, যেগুলোকে সড়ক দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলা যায়। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর চেষ্টা, প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানো, গাড়ি চালানো অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার, গাড়ি চালানো অবস্থায় গল্প-গুজবে মেতে ওঠা, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো, অন্যমনস্ক অবস্থায় গাড়ি চালানো, অসুস্থ অবস্থায় গাড়ি চালানোসহ নানাবিধ কারণে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে এবং এর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

যেসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেপরোয়া বা বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালানো। মোটরযান আইন অনুযায়ী, বেপরোয়া বা বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালানোর শাস্তি হচ্ছে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। এর সঙ্গে গাড়ি চালানোর লাইসেন্সও নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মন্তব্য করেন, চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে কারও মৃত্যু হলে, সেটা দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে না। সেটাকে হত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তখন এর বিচার হবে পেনাল কোডের ৩০২ ধারা মোতাবেক। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে হত্যা প্রমাণিত হলে আদালত ৩০২ ধারা মোতাবেক দোষীকে সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ, মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দিতে বাধ্য থাকবেন। এতৎসত্ত্বেও বেপরোয়া গাড়ি চালনার দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে। এসব চালক নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করেন না। আপনি যতই সাবধানে গাড়ি চালান না কেন, অন্য এক বেপরোয়া চালকের কারণে আপনি দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে পারেন। এতে নিরাপদ সড়কের আশা হয়ে যায় দুরাশা।

সড়ক দুর্ঘটনাগুলো ঘটার অপর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে অপরিপক্ব চালক, যা সাধারণত ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন বা নকল ড্রাইভিং লাইসেন্স বহনকারী চালকেরা। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে আমাদের দেশে ছোট গাড়িগুলোকে অশিক্ষিত ও অদক্ষ ড্রাইভার দিয়ে চালানো হয়। আর বড় গাড়িগুলোতে যেসব চালকের সহকারীরা থাকেন, তাঁরাই পরবর্তী সময় চালক হয়ে থাকেন। তাঁদের না থাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা, না থাকে বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স। অশিক্ষিত হওয়ার কারণে সড়কবিধি সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞানও থাকে অসম্পূর্ণ। যে কারণে বিদেশের চেয়ে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা এত বেশি। বিদেশের কথা এ কারণে বলছি যে বিদেশে চালকেরা থাকেন শিক্ষিত এবং সড়কবিধি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানসম্পন্ন তাই। সেসব দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে কম।

সড়কবিধি-সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাবও উচ্চ মাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। আমাদের দেশে অনেক ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুল এবং ইনস্টিটিউট আছে, যেখানে যানবাহনের শ্রেণিভেদে সঠিক ড্রাইভিং এবং তার সঙ্গে সড়কবিধি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দান করা হয়। বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদনের আগে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করার মতো নয়। সরকারি বিধান অনুযায়ী, ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে প্রথমে পেতে হবে লার্নার বা শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং সনদ। ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদনকারীর ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাস এবং সড়কবিধি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। অপেশাদারের জন্য ন্যূনতম ১৮ এবং পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য বয়স ন্যূনতম ২১ বছর হতে হবে। এ ছাড়া মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। এ সরকারি বিধানটিকে যদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা হয় অর্থাৎ, ‘যানবাহনের শ্রেণিভেদে সঠিক ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না’ যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে আসতে বাধ্য।

*লেখক: এ কে এম লুৎফর রহমান, পরিবহন পরিচালনা বিশেষজ্ঞ