প্রবীণ বোঝা নয়, হোক অহংকার
জন্মের পর থেকেই প্রতিদিনই আমাদের বয়স বাড়ছে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে একসময় আমরা পৌঁছে যাই প্রবীণ বয়সে। প্রবীণ বয়সটা আসলে কেমন? আমরা যাঁরা তরুণ রয়েছি, আমাদের ধারণাই নেই, সে বয়সে আমিই-বা কেমন থাকব? প্রবীণ জীবন আসলে সুখের নয়।
বাংলাদেশে যাঁদের বয়স ষাটের বেশি, তাঁদেরই আমরা প্রবীণ ব্যক্তি বা জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করব। কেমন আছেন আমাদের দেশের বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ নাগরিকেরা। আমি বলব, ভালো নেই। আমাদের দেশ উন্নয়নশীল দেশ। এখনো এ দেশের অনেক মানুষই তিনবেলা পেট ভরে খেতে পায় না।
জীবন-জীবিকার লড়াইটা করতে হয় বেশির ভাগ মানুষকেই। জন্মের পর থেকেই শুরু হয় একটু ভালোভাবে বাঁচার জন্য জীবনের দৌড়। কিন্তু এই দৌড়ের শেষ কোথায়? কোথায় এর পরিসমাপ্তি? মৃত্যুর আগে সেই দৌড় যে আরও বেশি করে দিতে হবে। পারবেন তো? আমরা প্রস্তুত তো? একটা সময় চাইলেও কি আমরা পারব যৌবনের মতো দৌড়াতে? না, পারব না।
বার্ধক্য এসে ভর করবে আমাদের শরীরে। মানুষের মন কখনো বুড়ো হয় না, কিন্তু সব শক্তি খেয়ে নিয়ে শরীর একটু একটু করে বুড়ো হয়ে যায়। চিরচেনা নিজের সেই শরীরকে আরেকটু সুস্থ–সবলভাবে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন পড়ে খাদ্যের, প্রয়োজন পড়ে চিকিৎসার, প্রয়োজন পড়ে অর্থের।
বাড়ছে মানুষের গড় আয়ু। বাড়ছে এ দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ বলছে, যদি আকস্মিক মৃত্যু না ঘটে, আপনি চাইলেও আর ৭৩ বছরের আগে মরছেন না। কারণ, গড় আয়ুটা যে বেড়ে গেছে। আবার রাষ্ট্রই বলছে, আপনার বয়স ৬০ বছর হলেই আপনি প্রবীণ, আপনার কোনো কর্মসংস্থান নেই।
অন্যদিকে সমাজব্যবস্থায় যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে তৈরি হচ্ছে একক পরিবার। এই একক পরিবারের কারণে পরিবারে বাড়ছে প্রবীণদের নিরাপত্তাহীনতা। প্রবীণেরা পালাবেন কোথায়? রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজ—কেউই প্রবীণদের দায়িত্ব নিচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা নেহাতই কম নয়, এ মুহূর্তে জনসংখ্যার ৮ শতাংশ প্রবীণ, আর তা প্রায় দেড় কোটি। হিসাব বলছে, প্রবীণ বৃদ্ধির এই হার যদি অব্যাহত থাকে, তবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এ দেশে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা হবে প্রায় ৩ কোটি এবং ২০৫০ সালে প্রতি পাঁচজনে একজন প্রবীণ থাকবেন।
হিসাবটা জানা দরকার, কারণ, এই ২০২২ সালে এসেও প্রবীণদের নিরাপত্তায় এখন পর্যন্ত আমরা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, ২০১৩ সালে মা-বাবার ভরণপোষণ আইন পাস হয়েছে, ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি এ দেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ ঘোষণা দিয়ে কিছু সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছেন। কিন্তু, কথাগুলো যেন কথাই থেকে যায়। বাস্তবে আমরা প্রবীণদের জন্য তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা দেখতে পাই না। বরং দিনকে দিন বাড়ছে প্রবীণ নির্যাতন।
প্রবীণেরা নির্যাতিত হচ্ছেন ঘরে, সমাজে তথা রাষ্ট্রে। আমাদের ঘর, সমাজ ও রাষ্ট্র খুব বেশি প্রবীণবান্ধব নয়। গবেষণা বলছে, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রবীণেরা তিন ধরনের নির্যাতনের শিকার শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতন। পুরুষের চেয়ে নারীরা এই নির্যাতনের শিকার বেশি হন। শহুরে প্রবীণেরা তবু পরিবারে কোনো রকম টিকে থাকলেও গ্রামীণ প্রবীণদের চিত্রটা আরও ভয়াবহ।
যে ব্যক্তি সারা জীবন কৃষিকাজ করতেন বা কঠোর পরিশ্রমের কাজ করে আয়রোজগার করতেন, তিনি প্রবীণ বয়সে আর ভারী কাজ করতে পারছেন না। অন্যদিকে ছেলেমেয়েরাও আয়রোজগারের আশায় শহরমুখী। তাঁরাও তাঁদের মা–বাবাকে ঠিকমতো দেখভাল করতে পারেন না। এতে করে গ্রামীণ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই ছিটকে যাচ্ছে সমাজ থেকে। বেঁচে থাকার জন্য তারাও শহরমুখী হচ্ছে, বেছে নিচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি।
বাড়ছে ছিন্নমূল প্রবীণের সংখ্যা, পথপ্রবীণের সংখ্যা। শহরের চিত্রটা কিছুটা ভিন্ন হলেও প্রবীণ ব্যক্তিরা নিজ বাড়িতেই অনেক সময় দুর্ভোগের শিকার হন। নিজের ইচ্ছার কথাগুলো তারা ছেলেমেয়েদের বলতে পারছেন না, ছেলেমেয়েরা তাঁদের সম্পত্তি লিখে নিচ্ছেন এবং তারপর তাঁদের আর খোঁজখবর রাখছেন না। তাঁরা ভুগছেন অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায়। অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে তাঁরা বঞ্চিত।
ছেলে, ছেলের বউয়ের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় অনেক প্রবীণই মনে মনে আলাদা থাকতে চান, কিন্তু কে নেবে তাঁদের দায়িত্ব। আবার অনেক প্রবীণই পেনশনের টাকা বা তাঁর নিজ জমানো টাকা দিয়ে নিজের মতো বাস করতে চান। সে ক্ষেত্রে তারা খুঁজে বেড়ান বাসযোগ্য একটি জায়গা। কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় এখনো প্রবীণদের জন্য বাসযোগ্য প্রবীণদের বসবাস কেন্দ্র তৈরি হয়নি। এটি হওয়া জরুরি।
প্রবীণেরা চাইলেও আলাদা করে বসবাস করতে পারছেন না। প্রবীণদের জন্য নেই কোনো আলাদা অধিকারের ব্যবস্থা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন পর্যন্ত নেই কোনো জেরিয়েট্রিক মেডিসিন স্পেশালিস্ট, নেই জেরিয়েট্রিক মেডিসিন বিভাগ, জেরিয়েট্রিক ফিজিওথেরাপি বিভাগ, স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাব্যবস্থা। ট্রেন, বাস কিংবা কোনো লাইনে প্রবীণদের জন্য নেই কোনো আলাদা অগ্রাধিকার। নেই সামাজিক ব্যবস্থায় তাঁদের জন্য তেমন কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা। বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
প্রবীণেরা সবচেয়ে বেশি ভুগে থাকেন অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায়। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সক্ষম প্রবীণদের তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি পরিবারে প্রবীণের স্বস্তিময় বাস নিশ্চিত করতে হবে। সমাজব্যবস্থায় প্রবীণদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমরা সবাই মিলে যে যার অবস্থান থেকে যদি প্রবীণদের কল্যাণে কাজ শুরু করি, তবে এ দেশে তাঁদের স্বস্তিময় বার্ধক্য নিশ্চিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
আমরা চাই প্রবীণবান্ধব বাংলাদেশ। আমাদের নবীন ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রবীণের কল্যাণে আজ থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। আমাদেরও মনে রাখতে হবে আজকের নবীনই কিন্তু আগামী দিনের প্রবীণ। আমরা আজ প্রবীণের জন্য প্রাপ্য সম্মান ও স্বস্তিময় বার্ধক্য নিশ্চিত করতে পারলে, আগামীকাল যখন প্রবীণ হবো, তখন সেই সুফল আমরাই ভোগ করব। আসুন সবাই মিলে প্রবীণবান্ধব বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আজ ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস থেকেই কাজ শুরু করি। বোঝা নয়, বরং প্রবীণ হোক আমাদের অহংকার।
লেখক: মহসীন কবির, বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্যবস্থাপক, প্রবীণ নিবাস, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ