জিপিএ-৫ জীবনের সবকিছু নয়
প্রতিযোগিতা একটি সময় খেলাসংশ্লিষ্ট অতিপরিচিত শব্দ হলেও আজ তা ছড়িয়েছে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে। আর এর পরিধি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাশের বাড়ির ছেলে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে, তাই যেকোনো মূল্যে আমার ছেলেকেও প্রথম শ্রেণিতে পাস করাতে হবে। এমন মনোভাব জন্ম নিয়েছে অধিকাংশ অভিভাবকদের মধ্যে। ফলে আমাদের জ্ঞান, দক্ষতা—সবকিছু সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে। সারা বছর আমরা সিলেবাসের সাজেশন অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছি, যেখান থেকে ২০টি প্রশ্ন পড়লে ১০টি প্রশ্ন পরীক্ষায় কমন আসবে। আর তার জন্য আমরা দৌড়ে চলেছি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। স্কুল, কলেজে ক্লাস না করে ছুটছি ঘরোয়া শিক্ষকের আস্তানায়। গুটিকয়েক সূত্রের শর্ট আর সাজেশনের ফটোকপিতে মুগ্ধ হয়ে ধ্যানজ্ঞান জন্ম নিচ্ছে পরীক্ষাকেন্দ্রিক। আর তখনই ঘটছে নৈতিকতার চরম অবক্ষয়।
সততা, সামাজিকতা, একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা—সবকিছু ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। আর একটি সময় গিয়ে এই মুখস্থ বিদ্যা আর শর্ট সাজেশনের প্রভাব পড়ছে আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। প্রতিবছর লাখো জিপিএ-৫ বের হলেও শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ন্যূনতম নম্বর পেয়ে পাস করতে পারছে না হাজারো জিপিএ-৫। শিক্ষার্থীরা অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজনের চাপে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। আর তখনই তাঁরা ঝুঁকে পড়ছেন মাদকদ্রব্য, জুয়াসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপে। এই রীতিনীতির সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে সুস্থ মস্তিষ্কের পরবর্তী প্রজন্ম পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তাই এক্ষুনি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাস করেছে ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ শিক্ষার্থী। তবে এখান থেকে আরও পাঁচ বছর আগের পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যাবে, পাসের হার ও জিপিএ-৫-এর সংখ্যা ছিল অনেকটা কম। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক বছরে জিপিএ-৫ বেড়েই চলেছে। কিন্তু চারদিকে জিপিএ-৫-এর ছড়াছড়ি ঘটলেও শিক্ষার মান নিয়ে বরাবরের মতো প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ উচ্চশিক্ষা নিয়ে একটি গবেষণা করে। সেখানে দেখা যায়, বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩২ এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন, যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধি তৈরি করতে মারাত্মক সংকটে পড়তে হবে। তাই কিছুটা বাধ্য হয়ে বলতে হয়, আশাজনক এই ফলাফল কি শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য হচ্ছে, নাকি গতানুগতিক ধারায় সিলেবাস কমিয়ে আনা, প্রশ্নপত্রের সহজীকরণ নানা সমীকরণের কারণে এমনটা দাঁড়াচ্ছে? যদিও শিক্ষামহল, অভিভাবকদের থেকে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর চলে আসবে। তবু এমন ফলাফল আমাদের সন্তানদের জন্য অশুভ কিছু বয়ে আনছে না তো? প্রতীক্ষিত এই জিপিএ-৫ একটি সময় তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে না তো? জিপিএ-৫-এর পেছনে দৌড়ে অর্জন করা এই পুঁথিগত বিদ্যার সনদধারীরা একসময় দেশের জন্য যেন ভার হয়ে না উঠে, সে বিষয়ে এক্ষুনি সচেতন হওয়া দরকার। কারণ, জিপিএ-৫ আসলে কোনো দেশের শিক্ষার মান নির্ধারণ করতে পারে না। আর শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার নির্ধারক হিসেবে শুধু জিপিএ-৫ কখনো মানদণ্ড হতে পারে না।
আমাদের দেশের পরবর্তী উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে বর্তমানে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট সিট রয়েছে ৫০ হাজারের মতো। এ ছাড়া মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে আসন রয়েছে সাড়ে ৪ হাজারের মতো। এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট সিট রয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল পেয়েও উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না লাখ লাখ শিক্ষার্থী। আর তখন তারা মানসিক বিষণ্নতায় ভুগে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছে, যা কোনোভাবেই আমাদের জন্য প্রত্যাশিত নয়। এই শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ ব্যক্তিরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থাকা বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হবে। আর তখনই পাবলিক পরীক্ষায় অর্জন করা ফলাফলের দিকে তাকিয়ে তারা হতাশায় নিমগ্ন হবে, যা গতানুগতিক ধারায় হয়ে আসছে। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থার এমন পরিবর্তনে দিন দিন জিপিএ-৫ সংখ্যাধারী ছাত্রছাত্রী বেড়েও আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছি না। আর আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে ঢুকে পড়া এমন চিন্তাচেতনা কতটা তার সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক হচ্ছে, সেটিও ভাবছি না। তাই সন্তানদের মানহীন শিক্ষায় ছুড়ে দিয়ে শুধু জিপিএ-৫-এর দিকে ধাবিত না করে তাদের ধর্মীয় জ্ঞান, মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে, যাতে প্রতিটি সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ ও দেশের প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে পারে।
লেখক: রিয়াদ হোসেন, শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা