হঠাৎ দেখা
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
স্টেশনে হঠাৎ দেখা। ভেবেছি কখনো দেখা হবে না। কয়েক মাস আগে দেখেছি, আলতা রাঙা পায়ে। লাল রঙের শাড়িতে এলোমেলো চুল। উড়ু উড়ু মনে এক পলক দেখেছি। তার মিষ্টি মুখের মুচকি হাসি। মনে হয় হাজার বছর ধরে দেখি। হঠাৎ কানে প্রশ্ন আসে
-কী ব্যাপার? এমনভাবে কী দেখছেন?
তার প্রশ্নকে পাত্তা না দিয়ে আচমকা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছি।
-আজব তো! এভাবে কি কেউ দেখে?
পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তাহলে কীভাবে দেখব?
-না, এভাবে আমাকে দেখতে হবে না।
-আপনি এত সুন্দরী কেন? আর আপনি কোথায় যাবেন?
-আমি সেতু। ঢাকায় যাব। নাম শুনে একটু মুচকি হাসি দিলাম।
-আশ্চর্য তো, হাসার কী হলো?
-কেন, মানুষকে হাসার স্বাধীনতাটুকুও দেবেন না।
-হ্যাঁ, অবশ্যই আপনার হাসার স্বাধীনতা আছে। আপনি মন খুলে হাসুন। আমি চললাম। এ কথা বলেই আলতা রাঙা পায়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে টিকিট কাউন্টারের দিকে।
-এই যে শুনেন? আপনাকে কিছু কথা বলার আছে। পরিচয়ের ৩০ মিনিটে না বলার কথাগুলো আজ বলে দিতে চাই।
কিন্তু বলা হলো না। ট্রেনের যাত্রাবিরতি শেষ। ট্রেনের দুবার শর্ট হুইসেল জানান দিচ্ছে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। ট্রেনের সব যাত্রী উঠে গেছে। তাই সে দ্রুত প্ল্যাটফর্ম থেকে দৌড়ে কামরায় বসল। ঝকমক ট্রেন চলছে। চলেই গেলে। রয়ে গেলাম বড় একা হয়ে। রোজ বিকেলে তার অপেক্ষায় বসে থাকি। কবে হবে তার দেখা! কতশত যাত্রী দেখা হয়। অনেক পছন্দ হয়। প্রেমে পড়ি, কিন্তু কেউ মন কেড়ে নিয়ে যেতে পারে না।
তার হাসির স্মৃতি নিয়ে ছয় মাস কেটে গেল। দেখা হয় না। রোজ বটগাছের নিচে কল্পনায় তার সঙ্গে কথা হয়ে মন ভেঙে যায়। ভাঙা মন চাঙা করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি নতুন করে আবার প্রেমে পড়ব। প্রতিদিনের মতো পথ ধরেছি স্টেশনের দিকে। গিয়ে দেখি আগের মতো সেতু দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে বিশ্বাস করতে পারছি না। আবার এমনভাবে দেখা হবে। তাই তো দুই হাত দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিয়েও দেখছি সেতু দাঁড়িয়ে হাসছে। কত মাস হয়ে গেল!
- প্রতিদিন আপনার অপেক্ষায় থাকি। কবে দেখা হবে আর মনের অজানা কথাগুলো বলে দিতে পারব!
- আচ্ছা, আপনি কেমন আছেন? আজ আবার কোথায় যাচ্ছেন? হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। এক ভদ্রলোক সেতুকে ডাকছে। ও গো! দ্রুত এসো। ট্রেন চলে আসছে। সেতু বলল, হ্যাঁ, যাচ্ছি। বলেই তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে ট্রেনে উঠে চলে গেল। রয়ে গেলাম নিরুদ্ধ প্রেমিক হয়ে। আর দেখা হলো না! যুবক পেরিয়ে চুল পেকে বুড়ো স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলো শুধু মনে পড়ে। আর কতকাল তার অপেক্ষায়! কখনো তার চিন্তায় দুই চোখের জল গড়িয়ে পড়ে অঝোর ধারায়। শরীরের অবস্থা বেহাল ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখে বলল, আরও কিছুদিন হাসপাতালে বিশ্রাম নিতে। তবে দুঃখের বিষয়, ডায়ালাইসিস করতে হবে। বাঁ দিকের বৃক্ক অকেজো হয়ে গেছে।
-ডায়ালাইসিস করতে এত টাকা কোথায় পাব, সুমন?
সুমন বলল, চিন্তিত হবে না, আমি দেখি কী করা যায়। এই বলে তার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলল। সে কিছু না বলেই বাইরে চলে গেল। পরের দিন সুমন সকালে হকারের কাছ থেকে খবরের কাগজ দিয়ে বলল। এই পত্রিকায় আপনার খবর ছাপানো হয়েছে। পত্রিকা খুলে দেখি, ‘দেশের আলোচিত লেখক জাসেতের টাকার অভাবে ডায়ালাইসিস করা হচ্ছে না’ শিরোনামে খবর ছাপানো হয়েছে। পত্রিকা পড়া শেষে সুমন বলল, এই খবর দেখে অনেকেই আপনার পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন।
সকালে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি মুক্ত আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি ওড়ে। আমিও মুক্ত আকাশে ঘুরতে চাই। ভাবনাগুলো শেষ না হতেই এক ভদ্রমহিলা। দেখতে মাথায় পাকা চুল আর যুবতীর মতো, কিন্তু যুবতী নয় বৃদ্ধ হয়েছেন। তিনি এসে প্রশ্ন করলেন,
-আপনি কেমন আছেন? আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন? জবাবটা দিলাম না, আমি চিনতে পারিনি। বয়স বেড়েছে, সবকিছু স্মরণ রাখতে পারি না।
- স্টেশনের সেতু মেয়েটির কথা স্মরণ আছে? আমি সেই সেতু।
এ কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে দেখতেই থাকি। একের পর এক প্রশ্ন আওড়ে যাচ্ছি! কখন অজ্ঞান হয়ে শুয়ে পড়ি, তা স্মরণ নেই। মাসখানেক পর সুস্থ হয়ে জানতে পারলাম, আমার সুস্থ হওয়ার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার সেতু বহন করছে। শোবার ঘরের টেবিলে এক টুকরা কাগজ পড়ে আছে। সেই সাদা কাগজে লেখা আছে ‘তোমাকে কখনো বলেছি যে মন থেকে মুছে ফেলেছি? বলিনি! কোনো দিন বলব না। তুমি আছো, থাকবে হৃদয়ে আর গোপনে কাঁদব অঝোর ধারায়। ভালো থাকো, সুস্থ থাকো।’