বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে আইপিও সমস্যা ও সমাধান
শেয়ারবাজার একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি। এটি শিল্পায়ন, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার তার সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগাতে পারছে না। এর পেছনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রাথমিক গণপ্রস্তাবসংক্রান্ত (আইপিও) বহুবিধ সমস্যা। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত ব্যাংকের ঋণনির্ভর। ব্যাংকের ঋণনির্ভর অর্থনীতি টেকসই কোনো অর্থনীতি নয়। আইপিও প্রক্রিয়ার দুর্বলতা, স্বচ্ছতার অভাব ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার অদক্ষতা শেয়ারবাজারের উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করা জরুরি।
প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) সমস্যার মূল কারণ
১. ভালো কোম্পানির অভাব
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ভালো মানের কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগ কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহী। এর পেছনের মূল কারণ হলো করপোরেট সুশাসনের অভাব ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার ঘাটতি। আমাদের শেয়ারবাজারের গভীরতা অনেক কম। ভালো ভালো কোম্পানিগুলো এই বাজারে আসতে খুব বেশি আগ্রহী নয়। এসব কোম্পানির মালিকেরা ভাবেন, ছেলে হবে পরিচালক, বউ চেয়ারম্যান। ব্যবসায় যা মুনাফা হবে, তা নিজেরা ভোগ করবেন। শেয়ারবাজারে আসা মানেই ভালো ব্যবস্থাপনা, করপোরেট সুশাসন ইত্যাদি উন্নত হওয়া। কিন্তু অনেকে সুশাসনের বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চান না। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ, করপোরেট গভর্ন্যান্স মেনে চলা এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, যা অনেক কোম্পানির মালিকের কাছে অস্বস্তিকর।
২. প্রক্রিয়াগত জটিলতা
প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ। অনেক কোম্পানি এই প্রক্রিয়াকে ঝামেলাপূর্ণ মনে করে। এ ছাড়া আইপিওর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে গিয়ে অনেক কোম্পানি হিমশিম খায়। এই জটিল প্রক্রিয়া অনেক সম্ভাবনাময় কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আসতে নিরুৎসাহিত করে।
৩. নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। তবে এই সংস্থার দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিএসইসির সিদ্ধান্ত এবং নীতিমালা বাজারকে স্থিতিশীল করার পরিবর্তে আরও অস্থির করে তোলে। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে নতুন যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে, সেগুলোর মান নিয়েও রয়েছে বিনিয়োগকারীদের নানা প্রশ্ন। এ কারণে তালিকাভুক্তির কিছুদিন যেতে না যেতেই অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর দামের নিচে নেমে গেছে। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও আইপিও প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
৪. বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে অতীতে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের কেলেঙ্কারি ও অব্যবস্থাপনার ঘটনা ঘটেছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করেছে। আইপিওর ক্ষেত্রে অনেক সময় কোম্পানিগুলো অতিরঞ্জিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা পরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে বর্তমানে শেয়ারবাজার পুঁজি হারানোর বাজার। ভালো-মন্দ বেশির ভাগ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেও লাভের দেখা মিলছে না। তাই বাজারে আসতে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। এই ধরনের ঘটনাগুলো বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করে।
৫. করনীতির অসুবিধা
করনীতির অসুবিধাও আইপিও প্রক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো করের কিছু সুবিধা পেলেও এই সুবিধাগুলো পর্যাপ্ত নয় বা আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয় না। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করপোরেট করের হার শর্ত সাপেক্ষে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ, যেখানে তালিকাভুক্ত নয়, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর করের হার সাড়ে ২৭।
প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) সমস্যার সমাধান
১. ভালো কোম্পানি আকর্ষণ
শেয়ারবাজারের গভীরতা বাড়ানোর জন্য ভালো মানের কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণ করা জরুরি। এ জন্য সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে করের সুবিধা, সহজীকৃত প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। এ ছাড়া করপোরেট সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। গত ১০ বছরে গড়ে প্রতিবছর প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে ৬০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে বিভিন্ন কোম্পানি। তালিকাভুক্ত এসব কোম্পানির বেশির ভাগই ছিল দুর্বল মানের। তার বিপরীতে উল্লিখিত সময়ে বাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। ভালো কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে এলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে এবং বাজারের গভীরতা বৃদ্ধি পাবে।
২. আইপিও প্রক্রিয়া সহজীকরণ
আইপিও প্রক্রিয়াকে সহজ ও দ্রুততর করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ এবং অনুমোদন প্রক্রিয়াকে ডিজিটালাইজড করতে হবে। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরও দক্ষ ও স্বচ্ছভাবে কাজ করতে হবে। ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে কী চায়, সেটা তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে হবে। আইপিওতে আসতে ভালো কোম্পানিদের কী কী অসুবিধা হচ্ছে, সেটা বের করতে হবে এবং তার সমাধান করতে হবে। আইপিও প্রক্রিয়ায় সময় কমাতে ও জটিলতা দূর করতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
৩. নিয়ন্ত্রক সংস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি
বিএসইসির দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরও পেশাদার ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া বিএসইসি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। গত ১৫ বছরে শেয়ারবাজারে যেসব কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করেছে, সেগুলোর ওপর একটি বিশ্লেষণ দরকার। শেয়ারবাজারে সুশাসন নিশ্চিত করা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি গঠন করা হয়েছিল। এ জন্য কমিশনকে বিপুল আইনি ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি আমরা দেখছি, শেয়ারবাজারসংক্রান্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা মন্ত্রণালয়নির্ভর হয়ে পড়েছে। শেয়ারবাজারের স্বার্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
৪. বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি
বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আইপিওর ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করার জন্য স্বাধীন ও পেশাদার অডিট ফার্ম নিয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ ও সেমিনারের আয়োজন করতে হবে।
৫. করনীতির সংস্কার
করনীতির সংস্কার করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য করের সুবিধা প্রদান করতে হবে। তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে করহারের ব্যবধান উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়ানো গেলে, অনেক সম্ভাবনাময় কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগ্রহ হারাবে। বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো করপোরেট করের ক্ষেত্রে মাত্র ২ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ সুবিধা পায়, যা তাদের জন্য যথেষ্ট প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে না। এ ব্যবধান বাড়ানো না হলে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পরিবর্তে ব্যাংকঋণ বা অন্যান্য অর্থায়নের উৎস বেছে নেবে, যা শেয়ারবাজারের গভীরতা ও টেকসই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে।
৬. প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ততা
প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ভারতের শেয়ারবাজারে প্রবাসী ভারতীয়দের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের প্রবাসীরাও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আরও বেশি আগ্রহী হতে পারেন, যদি বাজারকে আকর্ষণীয় ও লাভজনক করে তোলা যায়।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের উন্নয়নে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভালো কোম্পানি আকর্ষণ, আইপিও প্রক্রিয়া সহজীকরণ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে শেয়ারবাজারকে শক্তিশালী করা সম্ভব। এ জন্য সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাজার–সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শেয়ারবাজারের উন্নয়ন শুধু বিনিয়োগকারীদের জন্য নয়, পুরো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
* লেখক: মাহমুদুল হাসান এফসিসিএ, ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট, পিকেএসএফ।