কিস্তিমাত

প্রথম আলো ফাইল ছবি

১.

‘আরে, আরে, আমার হোন্ডা গেল কই? এটা কোনো কথা হইল? ইফতারের আগেই তো বারান্দার সামনে রাখলাম। পলাশ, সোহাগ!’—ডাক্তার মামার আর্তচিৎকার। দৌড়ে বারান্দার জানালার কাছে গিয়ে নিচে অনেক মানুষের হল্লা দেখতে পেলাম। দুপুরের পর থেকে একটু পর পর আম্মা বিড়বিড় করে সুরা ইখলাস আর সুরা নাস পড়তে পড়তে জানালা দিয়ে ইমনের অপেক্ষায় রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন। ইমন শুধু আম্মাকে জানিয়ে বাসে টাঙ্গাইল গেছে, অনার্স পরীক্ষার্থী সিনিয়র এক আপার জন্য নোট আনতে। প্রায়ই সে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যায় বিভিন্নজনের অনুরোধে।

ডাক্তার সাহেবের বাসায় গিয়ে খোঁজখবর করতে আম্মা সাহায্যকারী নাজমুলকে তাগাদা দেন, ‘এমনিতেই ইমনের চিন্তায় মাথা খারাপ অবস্থা, তার মধ্যে ডাক্তার সাহেবের আবার কী হলো?’ মুহূর্তেই নাজমুল ৩২ দাঁত বের করে খবর নিয়ে আসে, ‘ডাক্তার সাহেবের লড়ঝইড়া হোন্ডাটা কে যেন চুরি করছে?’ আম্মা নিচতলায় ডাক্তার মামার বাসায় যেতে যেতে নাজমুলকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘মানুষের বিপদে হাসতে নেই।’

চিৎকার-চেঁচামেচি ক্রমেই বাড়তে লাগল। শেষে চোরকে শাপ-শাপান্ত বাদ দিয়ে শাহানা মামি আর উনার ছেলে পলাশ ও সোহাগকে বকাঝকা শুরু করেন ডাক্তারমামা। নিচে নেমে দেখি, শাহানা মামি শাড়ির আঁচল মুখে চেপে আম্মার পেছনে দাঁড়িয়ে হেসেই চলেছেন, সঙ্গে পলাশ-সোহাগ আর ডাক্তারমামার কম্পাউন্ডারও। মামি হাসি চেপে রেখে আম্মাকে বলেন, ‘আপা, এই ভাঙাচোরা হোন্ডা চোরে নিয়ে গেছে, ভালোই হইছে! এই হোন্ডায় বসে কারো বাসায় বেড়াতে যেতে খুব লজ্জা লাগে!’

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক চিকিৎসক মো. আখতারুজ্জামান আমাদের আজিমপুরের ৫৫ নাম্বার বিল্ডিংয়ের প্রতিবেশী। আজিমপুর ছাপড়া মসজিদসংলগ্ন দায়রা শরীফের অপোজিটে ‘নিবেদিতা ঔষুধ ঘর’–এ উনি অফিস ছুটির পর জিপি করেন। খুব সৎ এবং শিশুর মতো সরল মানুষ কীভাবে ফরেনসিক মেডিসিনের মতো ঝামেলার ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন, আব্বা মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে আমাদের বলেন। রাত ১০টার দিকে প্রায় একই সময় ইমন আর ডাক্তার মামা-মামি বাসায় আসেন।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ডাক্তার মামার শেল্টারে ইমন দ্রুতগতিতে নিজের রুমে ঢুকে পড়ে, আব্বাকে কোন বকাঝকা করার সুযোগ না দিয়ে। ড্রয়িং রুমে আব্বাকে আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারের পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের মাধ্যমে কীভাবে হোন্ডা উদ্ধার করেছেন, সেটা আনন্দের সঙ্গে জানাতে লাগলেন। আব্বাকে ডাক্তারমামা জানালেন, ‘এটা আমার বাবা মেডিকেল কলেজের ফোর্থ ইয়ারে থাকতে কিনে দিয়েছিলেন। মাঝখানে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে পোস্টিং থাকার সময় এই হোন্ডা নিয়ে ঢাকা থেকে ক্লাস নিতে গেছি।’

২.

আজিমপুর লেডিস ক্লাব শিশু বিদ্যালয়ে পলাশ-সোহাগসহ ডাক্তারমামার পাঁচ ছেলে-মেয়ে আম্মার ছাত্র। সেই সময় থেকেই উনাদের সঙ্গে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক। তখন উনারা দায়রা শরীফের পাশে একটি বাসায় থাকতেন। মানুষের যেকোন বিপদ-আপদে উনি দৌড়ে চলে আসতেন। ভোরে ফজর নামাজের পর প্রতিদিনই উনার কোরআন শরীফ তিলাওয়াতের শব্দ শুনতে পাই। হাসপাতালে যাওয়ার আগে এবং সন্ধ্যায় বাসার পাশের বাগানে মাটি নিড়ানি দেন আর সবজির যত্ন নিন। আব্বাকে বলেন, ‘বাগানে কাজ করা আর দাবা খেলা, এই দুইটা কাজের মধ্যে মনটা শান্ত থাকে।’ মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় থেকে উনার সামনে না পড়ার চেষ্টা করি। প্রায়ই ডেকে পড়া ধরেন। আগে পালাতাম দাবা খেলার ভয়ে!

৩.

পত্রিকায় একটানা আনাতলি কারপভ-গ্যারি কাসপারভের দাবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বৈরথ, যেকোনো খেলাপাগল মানুষের নজর কারবেই। দিনের পর দিন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই দাবাড়ুর লড়াইয়ে পত্রিকার খেলার পাতাগুলো জমজমাট। একটানা চার মাস ধরে আটচল্লিশটি গেম দুই দাবারুর উপর মারাত্মক মানসিক চাপ তৈরি করেছে। এদিকে বাংলাদেশে নিয়াজ মোরশেদের জয় জয়কার, সঙ্গে ফিদে মাস্টার তাহমিদুর-জামিলুর, উদীয়মান শিশু দাবারু জিয়া-রিফাত এবং মহিলা চ্যাম্পিয়ন রাণী হামিদের খবর প্রতিদিনই মনে সুড়সুড়ি দেয় দাবা খেলা শিক্ষার! একদিন চাচাতো বোনজামাই দুলাল দুলাভাইয়ের দেওয়া ৫০ টাকা দিয়ে একসেট দাবার বোর্ড কিনে ফেলি। হুজুগে বোর্ড কিনলেও কার কাছ থেকে দাবা খেলা শিখব? আমাদের এখানে তো ‘মিখাইল বটভিন্নিক দাবা স্কুলে’র মতো কোন প্রতিষ্ঠান নেই।
তিনতলার স্বপন ভাইয়ের কাছে বোর্ড নিয়ে গেলে আনন্দের সঙ্গে দাবা খেলা শিখিয়ে দেন। আমাদের অনেক মুশকিলের আসান লিপু ভাই কীভাবে ক্যাসলিং করতে হয়, বুঝিয়ে দেন। বলেন, ‘দাবা খেলার ওপর অনেক বই আছে। নিউ মার্কেটে পাবে।’ একদিন ছোট্ট একটি পুস্তিকা নিয়ে আসেন, ‘দাবা ধৈর্যের খেলা। প্রথম থেকে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মে খেললে পুরো খেলাটায় নিয়ন্ত্রণ থাকে।’ বই পড়ে পড়ে দেখিয়ে দেন সিসিলিয়ান ডিফেন্স, রুই-লোপেজ ওপেনিং, নিমজো-ইন্ডিয়ান ডিফেন্স। বিশ্ব দাবায় সোভিয়েত এক তরফা সাম্রাজ্যের ধ্বস নামান দাবার বিস্ময় ববি ফিশার। ছোট পুস্তিকা দেখে ফিদে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ববি ফিশার-বরিস স্পাসকির উত্তেজনাকর অনেকগুলো ম্যাচ আয়ত্ব করার চেষ্টা করি। ববি ফিশারের অভূতপূর্ব সব চাল সত্যিই অবিশ্বাস্য! এই পুস্তিকায় বারবার সুলতান-কাপাব্লাংকা, সুলতান-আলেখিন ম্যাচগুলো দেখে মনে হলো, কে এই সুলতান?

অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের পাঞ্জাবের দরিদ্র কৃষক মীর সুলতান খান শিল্প-খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষক হতে উন্মুখ মহারাজা মালিক উমর হায়াত খানের আর্থিক সহায়তায় বিভিন্ন টুর্নামেন্টের দাবার বোর্ডে ঝড় তোলেন। ১৯২৮ সনে অল ইন্ডিয়ান চেস চ্যাম্পিয়ন হয়ে ভারতবর্ষে দাবার জাদুকর হিসেবে নাম কুড়ান। অভিজাত শ্রেণির দাবারুরা বড় বড় টুর্নামেন্টে অত্যধিক ফি নির্ধারণ করায় সাধারণ মানুষদের ওখানে অংশ নেয়াটা কঠিন। উমর খানের সহযোগিতায় ১৯২৯ সনে ইংল্যান্ডে গিয়ে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন দাবারুদের মাথার কালঘাম ছুটিয়ে দেন সুলতান খান। কারও গলগ্রহ হয়ে থাকতে না চেয়ে চাকচিক্যময় দাবার রাজ্য ছেড়ে আবার গ্রামের কৃষিজমিতে ফেরত যান নির্লোভ সুলতান খান।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

৪.

হোস্টেল থেকে ছুটির সময় বাসায় এলে ইমনকে প্রায়ই খুব ব্যস্ত দেখি। আম্মার উদ্বেগের সীমা নাই। ইমনের লকারভর্তি সন্ধানী-বাঁধন-রেড ক্রিসেন্টের ক্রেস্ট, কোটপিন, সনদপত্র। নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন বিপদগ্রস্থ মানুষকে রক্ত দান করে। মাঝে পরপর দুই রাত বাসার বাইরে থাকায় আম্মার কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘বাল্যবন্ধু টিপুর মায়ের ক্যানস্যার ধরা পড়েছে। অবস্থা ভালো না, রাতে হাসপাতালে টিপুর সঙ্গে পাহারা দেয়।’ আব্বার কাছে পারমিশন চাইলে অনার্স শিক্ষার্থী ইমনের মাথায় হাত বুলিয়ে আব্বা বলেন, ‘তোমার মনটা খুব নরম, সরল। কিন্তু, দুনিয়াটা জটিল মানুষে ভর্তি। সাবধানে থাকবে, মানুষকে সাহায্য করার এই গুণটা সবার নেই।’ মধ্যে আব্বার এক খালাতো বোন এসে একদিন ইমনের অনেক প্রশংসা করে যান। নিয়মিত বিরতিতে দূরবর্তী যাত্রাবাড়ীতে গিয়ে উনার খোঁজ-খবর করাসহ আর্থিক সহযোগিতা করে। আমি কোনো কিছু জানতে চাইলে ইমন মিয়া মুচকি মুচকি হাসে।

৫.

ড্যাব-ড্যাব-গুড়ুম-হঠাৎ দুরাগত আওয়াজটা কানে যেতেই মনে হলো, এটাতো ডাক্তার মামার অ্যান্টিক পিস হোন্ডাটার আওয়াজ! ৪২ নম্বর মাঠের মাঝখান থেকে ব্যাট ফেলে বাসার দিকে দৌড় দিলাম। আমাকে দেখলে দাবা খেলতে ধরে নিয়ে যাবেন! শুক্রবারের স্কুল ছুটির দিনটা সুন্দরভাবে শুরু হয়েছিল। কিন্ত শেষ পর্যন্ত তীরে এসে তরি ডুবল। ঠিক আমাদের বাসার নিচে এসে উনার হোন্ডার আওয়াজটা বন্ধ হলো। দরজা খুলতেই আব্বার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেই আমাকে ডাকলেন মামা, ‘চলো তোমাকে এক দান হারিয়ে যাই।’ এক দান এক দান করতে করতে শেষ পর্যন্ত দুই ঘণটা হয়ে যায়। উনার চেম্বার থেকে বারবার কল আসে। শেষ পর্যন্ত মামি রিকশা নিয়ে উনাকে মনে করিয়ে দিতে আসেন, চেম্বারে রোগীরা সব বসে আছে। আম্মাকে অনুযোগ করে বলেন, ‘দেখেন তো আপা, এই মানুষটা দাবা খেলতে বসলে দুনিয়ার কথা সব ভুলে যায়। দু-এক দান দাবা খেলে অনেক রোগী ভিজিট না দিয়েই চলে যায়, কিছু বলতেও পারে না। ‘কারও কাছ থেকে ভিজিট নিতে আমার অস্বস্তি লাগে’, ডাক্তার মামা। চেম্বারে উনার টেবিলের সামনে সব সময় একটা দাবার বোর্ড প্রস্তুত থাকে। পরিচিত কাউকে পেলেই দাবা খেলার অফার দেন। চেম্বারের পিছনের বাসা থেকে সমানে নাশতা, চা আসতেই থাকে।

মামি আমাকে আলাদা ডেকে অনুরোধ করেন, ‘বাবা, তুমি একটা খেলা হেরে যাও; না হলে সন্ধ্যার আগে উনি উঠবেন না।’ শেষ পর্যন্ত ডাক্তার মামা বিজয়ীর বেশে আমার দিকে চাল দিয়ে বলেন, ‘কিস্তিমাত! এবার তোমার রাজা সামলাও!’

  • লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর

নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]