ভেজালপ্রবণতা: রমজান মাস, মানবতা ও নৈতিকতা
আমাদের কিছু খারাপ দিক আছে। এর একটি হচ্ছে কোনো কিছু সামনে রেখে কাজ করা এবং নিজের স্বার্থ বা মুনাফা ঠিক করে এগিয়ে যাওয়া। আর সংকটাপন্ন অবস্থা বা উপলক্ষ সামনে রেখে মুনাফা অর্জনের জন্য সারা বছর কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। এদিকটি মানবতাবিরোধী এবং নিষ্ঠুরও বটে। খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল এমনকি শিশুখাদ্যেও ভেজাল করতে পিছপা হই না আমরা। রোগীর চরম অবস্থায় আমরা ব্যবসা খোঁজার চেষ্টা করি। রিকশাচালকেরা পর্যন্ত দালালিতে জড়িত। অ্যান্টিবায়োটিক বা জীবাণুনাশক ওষুধেও সমানহারে ভেজাল। নিম্নমানের ওষুধে উন্নত মানের ওষুধের দাম বসিয়ে দিই। বলা যায়, যে যার অবস্থান থেকে মুনাফা লুটতে মুখিয়ে থাকি। এ প্রবণতা বা মনোভাব লজ্জাজনক, মানবতাবিরোধী, ধর্মীয় ও নৈতিকতাবিরোধী। কিন্তু আমাদের কে আটকাতে পারছে? নাÑধর্ম, না আইন, না দেশপ্রেম। কোনো কিছুই আমাদের নিজের স্বার্থ বা মুনাফাখোর মনোবৃত্তি থেকে নিবৃত্ত করতে পারছে না।
আমরা প্রয়োজনে মিষ্টি কথা বলি; নিজের স্বার্থের জন্য। চারিত্রিক ভেজালও একই অবস্থায়। নিজের স্বার্থেই ছুটছি। যেমন ধরা যেতে পারে, রমজান মাস। মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশ পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে নিত্যনৈমিত্তিক জিনিসপত্রের দাম কমায় বা সহনীয় পর্যায়ে রাখে। আর আমাদের দেশে হয় ঠিক উল্টা। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা এ মাস সামনে রেখে সারা বছর ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য পরিকল্পনা আঁটেন। ওয়াটার লুর যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর নেপোলিয়নকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দী রাখা হয়। কথিত আছে, প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে অল্প পরিমাণে আর্সেনিক মিশিয়ে নেপোলিয়নকে খেতে দেওয়া হতো। এভাবে স্লো পয়জনিংয়ের মাধ্যমে ফরাসি সেনাপতি নেপোলিয়নকে হত্যা করে তাদের চিরশত্রু ব্রিটিশরা। কিন্তু খাদ্যে ভেজাল করে আজ আমরা নিজেরা নিজেদের স্লো পয়জনিং করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। খাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম। খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। কিন্তু পচা, বাসি, ভেজাল বা বিষাক্ত দ্রব্য মানুষের খাদ্য হতে পারে না। এটা মানবদেহের জন্য বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শিশুদের। কারণ, তাদের পক্ষে ক্ষতিকর উপাদানের প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করার ক্ষমতা খুবই কম। অনেক সময় এ ধরনের দূষিত খাবার মানবদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যা মানুষের মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
দিন দিন আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজালের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। বাজার, দোকান, সুপারশপ কোথাও ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য মিলছে না। মাছেও ফরমালিন, দুধেও ফরমালিন। ফলফলাদিতে দেওয়া হচ্ছে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল। খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানোটা রীতিমতো অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ভেজালের বেপরোয়া দাপটের মধ্যে আসল পণ্য খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর। এ ছাড়া এমন জটিল ও সূক্ষ্ম প্রক্রিয়ায় খাদ্যে ভেজাল দেওয়া হয়, যা সাধারণ ক্রেতা বা খুচরা ব্যবসায়ীদের পক্ষে অনুমান বা শনাক্ত করাও কঠিন। খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যে বিষক্রিয়ার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি এর ব্যাপ্তি যে হারে বাড়ছে, তাতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। দেশি-আন্তর্জাতিক সব গবেষণায় দেশে খাবারের বিষক্রিয়ার বিষয়টি বারবার উঠে আসছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা নামীদামি ব্র্যান্ডের পণ্যও এখন ভেজালমুক্ত নয়। ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যে ভেজালের কারণে বর্তমানে মানবদেহে ক্যানসারের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, যা আগে দেখা যেত না। তাঁরা বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ক্যানসারের মূল কারণ খাদ্যে ভেজাল মেশানো, প্রিজারভেটিভ ও বিভিন্ন ধরনের রঙের ব্যবহার। দেশে দূষিত খাবারের ব্যাপ্তি কী পরিমাণে বাড়ছে, পরিসংখ্যানেই তার প্রমাণ মিলছে। এ ছাড়া একাধিক গবেষণায় বারবার খাবারে ভেজালের বিষয়টি উঠে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দূষিত খাবারের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর ৬০ কোটি মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মৃত্যু হচ্ছে ৪ লাখ ২০ হাজার জনের। ভারত-বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে প্রতিবছর দূষিত খাবার খেয়ে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ মারা যায়। আর অসুস্থ হয় ১৫ কোটি মানুষ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি ১০ শিশুর ৩ জনই ডায়রিয়ায় ভোগে। রোগটি এ অঞ্চলের শিশুমৃত্যুর জন্য দায়ী সবচেয়ে ভয়াবহ রোগগুলোর একটি। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবী, বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান ইত্যাদির মাধ্যমে খাবার দূষিত হয়। কম বয়সী শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও প্রবীণেরা খাবারে দূষণের শিকার হন সবচেয়ে বেশি। টাইফয়েড জ্বর এবং হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার অর্ধেকের বেশি ঘটনা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার।
বিভিন্ন সমীক্ষায় ভেজালের ভয়াবহতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিষাক্ত সাইক্লোমেট দিয়ে তৈরি হচ্ছে টোস্ট বিস্কুট, বিষাক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয় কলা, আনারস। রুটি, বিস্কুট, সেমাই তৈরি করা হচ্ছে বিষাক্ত উপকরণ দিয়ে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে। ফরমালিন দেওয়া হচ্ছে মাছ-সবজিতে, মবিল দিয়ে ভাজা হচ্ছে চানাচুর, হাইড্রোজ মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে মুড়ি ও জিলাপি। টেক্সটাইল রং মেশানো হচ্ছে বেকারি পণ্য, জুসসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে। এ ছাড়া ক্ষতিকর রং দেওয়া ডাল, ডালডা ও অপরিশোধিত পাম অয়েল মিশ্রিত সয়াবিন তেল, ভেজাল দেওয়া শর্ষের তেল, রং ও ভেজাল মিশ্রিত ঘি, পাম অয়েল মিশ্রিত কনডেন্সড মিল্ক, ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি প্যাকেটজাত জুস, মিনারেল ওয়াটার, মরা মুরগির গোশতও অবাধে বিক্রি হয়। ভেজালের এসব উপকরণসহ অভিযানে হাতেনাতে ধরা পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। এরপরও ভেজালের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ থেকে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ কার্যকর হয়েছে। ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’-এর অধীনে নিরাপদ খাদ্য, খাদ্যদ্রব্য জব্দকরণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ পদ্ধতি বিধিমালা ২০১৪ প্রণীত হয়েছে। এতে খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে। আইন বলছে,
(১) ‘কোনো ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য বা উহার উপাদান বা বস্তু (যেমন ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, সোডিয়াম সাইক্লামেট), কীটনাশক বা বালাইনাশক (যেমনÑডিডিটি, পিসিবি তৈল, ইত্যাদি), খাদ্যের রঞ্জক বা সুগন্ধি, আকর্ষণ সৃষ্টি করুক বা না-করুক বা অন্য কোনো বিষাক্ত সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়া সহায়ক কোনো খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্য উপকরণে ব্যবহার বা অন্তর্ভুক্ত করিতে পারিবেন না অথবা উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্য উপকরণ মজুত, বিপণন বা বিক্রয় করিতে পারিবেন না।’- (ধারা-২৩)
(২) ‘কোনো ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের আহার্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত মান অপেক্ষা নিম্নমানের কোনো খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্য উপকরণ বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে উৎপাদন অথবা আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুত, সরবরাহ বা বিক্রয় করিতে পারিবেন না।’-(ধারা-২৬)
(৩) ‘কোনো ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তি, খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্য উপকরণে কোনো ভেজাল দ্রব্য মিশ্রিত করিবার উদ্দেশ্যে, শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত তৈল, বর্জ্য বা কোনো ভেজালকারী দ্রব্য তাহার খাদ্য স্থাপনায় রাখিতে বা রাখিবার অনুমতি প্রদান করিতে পারিবেন না।’-(ধারা-২৮)
এসব আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন মেয়াদের আর্থিক ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে? সরকার বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত করে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিচ্ছেন। কিছুই যেন আমাদের দমাতে পারছে না। প্রথমে বলি, আইন কতটুকু মানছি? আমরা কী সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি? উভয় ক্ষেত্রে সিংহভাগ লোক মনে করেন, আমরা সিন্ডিকেটে বন্দী, আমরা বেশির ভাগ খাদ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি আইন মানছি না।
বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ। ধর্মপ্রাণ মুসলিম-বাঙালিদের ধর্মপালনকে পুঁজি করে মুনাফার দিকে লক্ষ্য বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর। রোজা-ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা নিয়ে বছরের শুরুতেই মুনাফার জন্য অনৈতিক বিভিন্ন পন্থা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। রমজানে ভেজাল বেশি হয়, দ্রব্যমূল্যের দাম হঠাৎ করেই মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধিবিধানও তাঁদের আটকাতে পারছে না। শুধু আইন করে এ অবক্ষয় রুখে দেওয়া কঠিন। সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বস্তরের বিবেক আগে জাগ্রত করতে হবে। আইন প্রয়োগকারীকেও নিরপেক্ষ ও অধিক দায়িত্বশীল হতে হবে। তা হলেই সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গতি পাবে।