চুপিচুপি বিদায়

প্রতীকী ছবি

এ আমার শেষ পত্র কি না, জানি না। হয়তো শেষ, হয়তোবা নয়। দোয়াতের কালি শুকিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, দুঃসময়ের দিনলিপি আটকে যাচ্ছে। রোগ-কষ্ট-হতাশাকে সঙ্গে নিয়ে যে লড়াই, তাকে বারবার দেখি—অকালবৈকল্যের বেদনাময় উপস্থিতি যেন সরোবর।
না, ডাকব না আর তোমাকে।

বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। থামার কোনো নাম নেই। শোবার ঘরে, জানালার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখি, কান পেতে শুনি, টিনের চালে বৃষ্টির অনবরত শব্দ-কাওয়ালি আওয়াজ নেই। বাতাসে ভাসছে দুঃখজাগানিয়া জলের সৌরভ।

কোনো কোনো রাতে আমি কাওয়ালি শুনতাম, বুকের ভেতরে আনন্দনৃত্য হতো। কোনো এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তুমি এলে। এ এক অন্য কাওয়ালি, জীবনের মানে, জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছি এত দিনে। নতুন প্রাণে আমি তোমার নেশাতুর হলাম। তুমিও হয়েছিলে।

ভুলে গেলে তুমি সেসব দিনের কথা? মনে পড়ে সেদিনের কথা, মেঘমাতাল এক বিকেল ছিল। আমি অপেক্ষায় কাঁটাবনের ঢালে পাঠক সমাবেশে বই নাড়ছি। তুমি এলে খানিকটা বিলম্বে, লাল পাড়ের শাড়িতে, স্মিত হেসে, খোঁপায় বেলিফুলের মালা। আমার হাতে একটি বই তুলে দিলে ‘চলতে চলতে’। তারপর! তারপর তুমি-আমি আশ্রয় নিলাম শিল্পকলা একাডেমির গাছের ছাউনিতে। গাছটি ছিল কৃষ্ণচূড়া। কোকিল ডাকছে। প্রকৃতিও যেন সেজেছে নতুন আবেগে, নতুন উন্মাদনায়। আর আমি ‘বিজয়ফুল’ হাতে নিয়ে হাঁটুমুড়ে তোমার বশ্যতা স্বীকার করলাম।

তুমি আমার শাসনভার নিলে, আমার হাতটা ধরলে। এটা নিছক হাত ছিল না, ছিল একটা আশ্রয়। একটা নতুন ঘর দিলে আমাকে, ভালোবাসার কুসুম ঘর। আমি তোমাকে বলেছিলাম, এক সলতে জ্যোৎস্না ফোটাব ওই ঘরে। বেহেশতসমান একটা ছোট্ট সংসার হবে। একদিন আমাদের হবে, সব হবে। শূন্য মাঠ ভরে উঠবে সবুজ উৎসবে। তুমি বলেছিলে, ‘কিছু বৃষ্টি দাও অনিমেষ, তোমার চোখে স্বপ্ন ফিরিয়ে দেব, চলো হারিয়ে যাই।’ একদিন ভোরের আলো ফোটার আগে তুমিই সে ঘর ভেঙে দিলে।

আমার ভেতর ক্রন্দন-অবিরাম আঁখিজল। অনল বাতাসে উড়ে যাওয়া নতুন ধূপ।

স্বপ্ন বুনে স্বপ্ন কেড়ে নিলে। একটা ঘর ভেঙে দিলে। কী সহজ, তা–ই না! যদি জানতে আমার পেরিয়ে আসা দিনগুলো কত কঠিন ছিল! আগুনের ছরা কুহকের বুক পুড়ে গেছে, রাতের অন্ধকারে অন্তরিণ হয়েছিল তীক্ষ্ণ চোখ, আর পশ্চাতে বয়ে বেরিয়েছি কত দুমুখো ছবি। গুলতির কাঠি বারবার বিঁধেছে, আঘাত আর আঘাতে। আমার অন্ধ চোখ বেড়িয়েছিল, দিকনিশানা আর নির্দয় হয়ে দূর থেকে তুমি হেসেছ বারবার, যন্ত্রণাদায়িনী হয়ে এ কেমন সুখ তোমার!

একদিন বিশ্বাস মানে বুঝেছিলাম ভরসা, আস্থা। আর এখন! বুঝি না এসব।

এখন আর কাওয়ালি হয় না। গজল হয় না। বিরহগীত বেজে ওঠে, চোখের ভেতরে বৃষ্টি পড়ে, পাতা আর নড়ে না। নিস্প্রভ সেই দৃষ্টি চেয়ে থাকে বিদীর্ণ আকাশের দিকে। এ কেমন তোমার আলোড়ন! কতটা মিনতি রেখে গেলে তোমাকে পাওয়া যায়! কতটা কঠিন হলে হৃদয় ছিঁড়ে যায়। সুগন্ধি ফুরিয়ে গেলে বিষণ্ন সকাল যেন ট্রেসিং পেপার, আমি তার নিচে ছবি হয়ে আছি। যেন বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে নেওয়া নিহত গোলাপ।

অন্তহীন অমাবস্যা, মানুষের তৈরি ননস্টপ বর্বরতা, ধনধান্যে পুষ্পেভরা বঙ্গভূমে আজ শ্মশানকালীর উলঙ্গ নাচ। অথচ নোনাজলে ভাসে আমার খাঁচাবন্দী শহর। একটা ক্ষয়ে যাওয়া ক্রিসেনথিমাম। কী আকুল সেই শহরে, যে শহর এখন আর জাদু দেখায় না। মননে চিন্তা খেলে না, দুর্বোধ্য, কেবল ছন্দহীন সুরের আবেশ। মরে বেঁচে ওঠা আমার সেই শহর এখন প্রতি রাতে, প্রতি ভোরে অকূলে কেঁদে যায়। সেই কান্নাভরা বৃষ্টি কেবল লাল জলের দিকে ছোটে, স্নান করে। শবের মিছিলে যাত্রার ধ্বনি কি শুনতে পাও প্রিয়তমা! দূরে কোথাও জাগছে আমার এপিটাফ।

যদি জানতে কত গোপন রাত্রি নাগাল না পাওয়ার আক্ষেপ আমাকে কবি করে তুলেছে। কিন্তু আমি কবি হতে চাইনি। আমি মানুষ হতে চেয়েছিলাম, আর হতে চেয়েছিলাম একজন প্রবল প্রেমিক।

সুখ–দুঃখ সাফল্য-ব্যর্থতা মান-অভিমান—সবকিছু নতমস্তকে বিসর্জন দিয়ে যা একমাত্র বলা যায়, তা হলো ‘চুপিচুপি বিদায়’। দেখো, বিচ্ছেদের দাগ আমার আঙুল স্পর্শ করছে।