উচ্চশিক্ষায় বেকারত্ব, নারী নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড
সমাজ ঘটনা:১
ঢাকার মিরপুর অঞ্চলে মেসে থেকে চাকরির প্রস্তুতি নিতেন সাদিক (ছদ্মনাম)। বাসা উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রামে। চুপচাপ থাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে অফিস-সহকারী পোস্ট মিলিয়ে ১৭টির অধিক ভাইভা দিয়েছেন, কিন্তু চাকরি পাননি। ছাত্রজীবনে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। এককালের প্রেমিকা বুকভরা আশায় স্বপ্ন বেঁধেছিলেন। বাসায় কেউ জানত না। হঠাৎ বছর না ঘুরতেই সর্বদা সংসারে অশান্তি, কথা বলার সময় সাবেক প্রেমিকা যিনি বউ তাঁকে গালি দেওয়া ছাড়া কথা বলেন না। কী হলো! সবশেষে স্ত্রীকে বেধড়ক নির্যাতনে ঘটে মৃত্যু। শেষ বয়সে কোম্পানিতে ঢুকে এ পর্বের ইস্তফা টানলেন। জীবন এখন তাঁর হতাশাগ্রস্ত।
ঘটনা: ২
লতা (ছদ্মনাম)। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর পছন্দের পুরুষ অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে বয়সের শেষ দিকে প্রায় ১১টি ভাইভা শেষে সরকারি চাকরি জোগাড় করলেন। বিধিবাম; যাঁর জন্য সমাজ, পরিবারের কাছ থেকে লতা নিগৃহীত হলেন, তিনিই (পুরুষ) চাকরি পেয়ে দীর্ঘ সাত বছরের মধুর সম্পর্কের ইতি টানলেন এক মিনিটে। অধিক যৌতুক ও সৌন্দর্যের লোভে বিয়ে করলেন অন্যত্র। মেয়েটির কী হবে! রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সমাজ পাঠের সেই পুরোনো বক্তব্য: ‘পুরুষের এক চাকরি আর সার্টিফিকেটের বাজারদর এক রাজার রাজত্বের সমান।’
সমাজ ঘটনা: ৩
ধানমন্ডির মধুবাজারে থাকতেন আহমদ উল্লাহ রনি (ছদ্মনাম)। এককালে মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করে দ্বিতীয়বারে দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। পড়াশোনা শেষে এখন তিনিও বেকার। পাপ হবে বিধায় সরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ে প্রেমিকাকে বিয়েও করে নিলেন। কিন্তু সমাজ তো বুঁদের রাম। এখন বিয়ে করেছ বাপু মেয়ের দায়িত্ব নাও। জেনারেল মিডিয়ামে চাকরির বাজারের পরীক্ষায় তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। যদিও তার মুখস্থ বিদ্যা ভালো। একদিকে বেকারত্ব অন্যদিকে তীব্র সমাজ আকাঙ্ক্ষা শেষে শোনা গেল তিনি নাকি আত্মহত্যা করতে গেলেন। আর পারছেন না। বৃদ্ধ বাবা, পরিবারের অবস্থা তথৈবচ। সংসারে মনোমালিন্য, অশান্তি। পুরোনো প্রতিজ্ঞা দুজনের কেউ রক্ষা করতে পারলেন না। হলো বিচ্ছেদ। এ হলো নগর সমাজপাঠ। ইতালির মার্ক্সবাদী দার্শনিক অ্যান্থোনিও গ্রামসি বলতেন, সমাজ বিকাশ ও বিবর্তনের সঙ্গে নগরায়ণ, শিল্পায়নের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। সেই সঙ্গে মানুষের সামাজিক সমস্যা, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সম্পর্কও করুণ। মানুষ এখানে অর্থনৈতিক কারণে একে অপরের থেকে শারীরিক, মানসিক যন্ত্রণা ও ভয়ংকর রকমের প্রতারণার শিকার হন। জাগতিক বাস্তবতার নগরায়ণে অর্থনৈতিক সেতুবন্ধ মজবুত না হওয়ার কারণে প্রেম, পারিবারিক দায়িত্ব, প্রেমিকা, প্রিয়তমা স্রোতের মতো হারিয়ে যায়। ফলে একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতাই নগর মানুষের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। যা আধুনিক, উত্তর-আধুনিক শিল্প-সাহিত্য ও সমাজের চেহারাও বটে।
১.
উপরোক্ত সমাজ ঘটনার মূল কথায় আসি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ (আসক) ২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুলাই মাসে দেশের নারী নির্যাতনের তাদের প্রদত্ত তথ্যে জানিয়েছে, ১১৩ জন নারী স্বামী কর্তৃক সরাসরি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে গত ৭ মাসে, যা অত্যন্ত উদ্বেগ ও ভয়ানক। বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোটের ওপর সব হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রেম–সম্পর্কিত বিয়ে এবং এর পরবর্তী দাবি করা যৌতুক অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সামাজিকভাবে সামন্তীয় মূল্যবোধের শিকড় প্রোথিত দরিদ্র দেশে বেকার উচ্চশিক্ষিত পুরুষদের হাতে এ ঘটনা বেশি ঘটছে। সমাজপাঠে এখানে প্রধানতম দুটি বিষয় অবলোকন করা যায়, এক. বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন প্রেমিকযুগলদের তাড়িত স্বপ্ন। দুই. বিবাহপরবর্তী সময়ে বেকারত্ব, কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়া ও জীবন-জীবিকার ব্যয় নির্বাহ পূরণ না হওয়ার কারণে সৃষ্ট সমস্যা। ফলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কর্তৃত্ব, দেখভাল পুরুষের হাতে থাকার দরুন নারী সে-রকমভাবে আর সংসারে প্রভাব ও মূল্যায়িত হতে পারেন না। বিপরীতক্রমে নেমে আসে অত্যাচার। পরিণতি নির্যাতনের পরিমাণ বৃদ্ধি ও মৃত্যু। কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ সবচেয়ে বেশি সংঘটিত হয়, যা শতাংশে ৮৬–এর অধিক। দায়ভার আসলে কেউ নিতে চায় না। কে নেবে! সমাধান কী! সংকট উত্তরণের উপায়–বা কী! সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্ক্সের ভাষায়, ‘মূল সমস্যা হলো অর্থনৈতিক দৈন্যতা। যার সঙ্গে নারী-পুরুষের অন্যান্য সম্পর্কের ভিত মজবুত হয়।’ ফলে মূল সমস্যা ও রোগের ওষুধ না দিয়ে যত রকম চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বা হয় তার কার্যকরী আশানুরূপ ফল নেই। সাময়িক বন্ধ হলেও স্থায়ী সমাধান নেই। সমস্যা, বিচ্ছিন্ন, বিচ্ছেদ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটে চলেছে। এককালের স্বপ্ন মৃত্যু হচ্ছে। নগরনাট্য হাসছে।
২.
মানুষের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা এক সেকেন্ডও নেই। কিন্তু বিশ্বাস করুন, তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষে তার চাকরি, কর্মসংস্থানের নিশ্চিত গ্যারান্টি চায়ই চায়। আজকের শতাব্দীতে কোনো সাবজেক্ট যদি ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেজ স্নাতক, উৎপাদনে বাজারমুখী, বাজার অর্থনীতিভিত্তিক গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা না হয়, তা ক্রমেই মারাত্মক গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চোখ বুজে নিষেধের বিড়ম্বনায় অতীতের মোহে আবেগতাড়িত হতে পারেন, কিন্তু ভাবুন আপনি উর্দু, ফারসি, পালি ও বুদ্ধ স্টাডিজ, সংস্কৃত, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি, ইসলামের ইতিহাস, ফোকলোর, বাংলা, ইতিহাস, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ, চারুকলা, মনোবিজ্ঞান, নাট্যতত্ত্ব, দর্শন, বাংলাদেশ স্টাডিজ সাবজেক্ট ইত্যাদির উচ্চশিক্ষা শেষে কেবলমাত্র শিক্ষকতা পেশাবিহীন বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মক্ষেত্র বা চাকরি নেই। তাদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট করারও কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেই।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ফলে এসব সাবজেক্টে অধ্যয়নরত বাংলাদেশের যত শতাংশ নারী-পুরুষ উচ্চশিক্ষিত, ঠিক তত শতাংশই হতাশ। ফলে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব রাষ্ট্রের জন্য একধরনের বড় রকমের থ্রেট। আবার প্রযুক্তির বিকাশ অনেক চাকরি ও সাবজেক্ট ইতিমধ্যে খেয়ে দিয়েছে। আরও দিচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, ফলিতবিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য বিভাগের জন্যই সুনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক কর্মসংস্থান বা চাকরি বাকরির ক্ষেত্র যদিও আছে; সেগুলোও তাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে ওইসব সাবজেক্ট থেকে লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট প্রতিবছর পাস করে বের হওয়ার পর তাঁরা আসলে কোথায় যাচ্ছেন বা কী হচ্ছে তার পরিপূর্ণ হদিস নেই। সমাজ, পরিবার কিংবা প্রেমিক বা প্রেমিকা সবাই এলিট চাকরি প্রত্যাশা করেন। আসলে এলিট চাকরিই–বা আছে কয়টি। ফলে একদা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাস্যোজ্জ্বল নিমজ্জিত মানুষটি হতাশ হয়ে পড়েন, নিজেকে লুকিয়ে রাখেন কিংবা আত্মসম্মানের ভয়ে নিজেকে সংকুচিত করে গুটিয়ে ফেলেন। রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই বলেছিলেন, ‘আমাদের উচ্চশিক্ষার ইমারতের সিঁড়ি আমরা নিজেরা গড়ে তুলিনি। গড়ে তুলেছে অন্যরা তাদের ধাঁচে ফেলে। আর বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার পা ভূতের পায়ের মতো; যতই সামনে আগাতে চায়, ততই পিছনে চলিয়া যায় (শিক্ষা প্রবন্ধ)।’
অর্থাৎ নগর–সমাজে লক্ষ্যহীন এসব উচ্চশিক্ষার পর বেঁচে থাকার দায় কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদাভাবে, যা এ শতাব্দীতে আমাদের জানান দিয়েছে। ফলে আসক পরিসংখ্যানভিত্তিক উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যে নারী নির্যাতন, হত্যা—এ পাঠের বাইরে ভিন্ন কিছু নয়। এগুলো সমাজ সম্পূরক ও পরিপূরক।
৩.
বর্তমানে সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ক্যাপিটালিস্ট ও মুক্ত বাজার অর্থনীতিভিত্তিক। অর্থাৎ সমাজে উৎপাদিত কোনো কিছুর অর্থনৈতিক মূল্যে পরিগণিত না হলে তার বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন নেই। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাজার মিলিয়ে পুরো অর্থনীতি ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মাত্র। ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব স্বাভাবিক পরিবেশে একটি দেশে বছরে সর্বোচ্চ ৩ লাখ স্নাতকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব। অথচ ইউজিসি তথ্যমতে দেশে প্রতিবছর প্রবেশ করছেন ৭ লাখ শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট। বেসরকারি গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সংখ্যা আরও বেশি। ভয়াবহ। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই। সমস্যা আরও বেড়েছে। একদিকে শিক্ষায় ব্যবসায়িক সম্প্রসারণ, সেই তুলনায় চাকরিসংখ্যা বৃদ্ধি হয়নি। করোনার পর এ অবস্থা আরও খারাপ। সম্প্রতি বেসরকারি খাতে ‘কোম্পানিগুলো শুধু চাকরি ছেড়ে দেওয়া বা মারা যাওয়া কর্মীদের শূন্যস্থান পূরণ করেছে।’ বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক উত্থান-পতনে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ওলট-পালট হচ্ছে। দখল, বিতাড়ন, লুটপাটের প্রতিযোগিতা চলে দেদার। অর্থনীতিবিদেরাও এই উদ্বেগের সঙ্গে একমত। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, ‘চাকরি বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির চালিকাশক্তি হলো দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। কিন্তু বাংলাদেশের ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকের ধারণ করার জন্য যথেষ্ট বড় নয়।’ ফলে মূল সমস্যা হলো বেকারত্ব। যার মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি।
আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব সবচেয়ে তীব্র জনসমাজের সংকট। ফলস্বরূপ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সংস্কার আবশ্যক। নতুন করে ভাবতে হবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে দেশীয় সমস্যা সমাধানের দিকে লক্ষ রেখে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘উচ্চশিক্ষা বিষয়ে পরিকল্পনা’ নেওয়া উচিত। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পেটের খাদ্যনালির কাছে আবেগের কোনো স্থান নেই। বিজ্ঞান, বাণিজ্য, প্রযুক্তি এ-শতক ও শতাব্দীর উন্নতির সোপান। কলা সেখানে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে ছায়াশক্তিরূপে। উচ্চশিক্ষা, নারী নির্যাতন, হত্যা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন সমস্যাগুলো বিদ্যমান বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে বাইরের কোনো বিষয়বস্তু মোটেই নয়।
*লেখক: মনির হোসেন, প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর