বুটেক্স: জরুরি মুহূর্তে রক্ত দেয় বাঁধন: তাদের দিন নেই, রাত নেই

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাঁধন

‘একজন কল দিয়ে জানালেন, তাঁর এক নিকট আত্মীয়ের জন্য রক্ত লাগবে। রক্ত দিতে আমি রক্তদাতা সংগ্রহ করে তাঁকে হাসপাতালে পাঠাই। তিনি গিয়ে শোনেন, রক্ত দেওয়া লাগবে না। রক্তদাতা এত দূরে গিয়ে ফিরে আসার পর তাঁকে আবার জানানো হলো, সন্ধ্যার পর রক্ত দিতে যেতে।’

রক্ত দিতে গিয়ে দিতে না পেরে বাসায় ফিরে আসেন আসিফ। তাঁকে যখন জানানো হলো, সন্ধ্যার পর রক্ত দিতে যেতে হবে, তখন তিনি আবার যাবেন কি না, এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। আসিফ বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর হয়রানির গল্প শোনাচ্ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাঁধন-এর বুটেক্স ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আফিফ ইসলাম সাজিদ।

রক্তদাতার সঙ্গে যোগাযোগ, রক্ত দিতে পারবেন কি না, শারীরিক অবস্থা যাচাই, রক্তদানের জন্য তাঁদের প্রস্তুত করা; যেখানে গিয়ে রক্ত দিতে হবে, তা চিনিয়ে দেওয়া; রক্ত দিলেন কি না, তা জানাসহ আনুষঙ্গিক অনেক কাজ করতে হয় সাজিদ ও তাঁর পুরো সংগঠনের সদস্যদের। সময়মতো রক্তদাতা ব্যবস্থা করে দেওয়ার চ্যালেঞ্জের কাজটি প্রতিদিন করতে হয়। তাঁদের এ কাজে ‘দিন নেই, রাত নেই’। যখন কেউ রক্তের জন্য সাহায্য চান, তখন তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেওয়ায় ব্যক্তিগত সময় ও বিশ্রামের ওপর প্রভাব পড়ে বলে জানান সাজিদ।

ভালো লাগার বিষয়ে উল্লেখ করতে গিয়ে সাজিদ বলেন, ‘যখন সফলভাবে রক্ত ব্যবস্থা করা যায় এবং জীবন বাঁচাতে বা স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করতে পারি, তখন যে অনুভূতি হয়, তা সত্যিই অতুলনীয়।

এতে মনে হয়, যেন সব পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। করোনাকালীন সময়ে যখন নরসিংদীতে ছিলাম, তখন ঢাকা থেকে একজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ঢাকায় গিয়ে রক্ত দিতে হবে। সেখানে কোনো রক্তদাতা পাননি তিনি। আমি ঢাকায় আছেন, এমন কাউকে খোঁজা শুরু করি, যিনি রক্ত দিতে পারবেন।’

অনলাইন মাধ্যমে ঢাকায় রক্তদাতা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন বুটেক্সের টেক্সটাইল মেশিনারি ডিজাইন ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম। কিন্তু তিনি কাউকে পাননি। তিনি বলেন, ‘কেউ কিছুদিন আগে রক্ত দিয়েছেন, আবার করোনাকালীন সময় বিধায় কেউ ভয় পাচ্ছেন বাইরে যেতে। কাউকে না পেয়ে রক্ত দিতে আমাকেই ঢাকায় যাওয়া লাগে। এ ঘটনায় আমি খুশি, এই মহৎ কাজের জন্য আল্লাহ আমাকে বাছাই করেছিলেন।’

তৌহিদ ২০১৯ সালে রক্ত দেওয়া শুরু করেন। প্রতি তিন-চার মাস পরপর রক্ত দিতে দিতে এ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ১৯ বার। এ নিয়ে তৌহিদ বলেন, ‘ব্লাড দিতে ভালো লাগে, আলহামদুলিল্লাহ। এতে মানুষের একটু তো উপকার হচ্ছে।’

এতবার রক্ত দেওয়ার সময়ে কোনো বিপত্তি বা হয়রানির ঘটনা ঘটেনি তাঁর সঙ্গে। তবে রক্ত যাঁদের প্রয়োজন, তাঁদের বেশ কিছু বার্তা দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, শিক্ষার্থী যাঁরা রক্ত দিতে যান, তাঁদের যেন গাড়িভাড়াটা দেওয়া হয়।

হাসপাতালে যিনি রক্ত নিচ্ছেন, তিনি রক্ত নেওয়ায় যথেষ্ট প্রশিক্ষিত বা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কি না, তা জেনে নেওয়ার বিষয় উল্লেখ করে তৌহিদ বলেন, কখনো কখনো ব্লাড সংগ্রহ করার সময় হাতের শিরা বা রগ খুঁজতে গিয়ে কয়েকবার সুচ দিয়ে খোঁচা দেন। এতে হাতের মধ্যে অনেক ধরনের সমস্যা হয় এবং হাতের ব্লাড পয়েন্টের আশপাশ কালো হয়ে যায়। বাঁধনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকে রক্তদানের সঙ্গে জড়িত। এখন পর্যন্ত বুটেক্স বাঁধন ইউনিটের মাধ্যমে যতবার রক্ত দিয়েছি, প্রতিবার তারা খোঁজখবর নিয়েছে। তা ছাড়া রক্তদাতার ব্যাপারে তারা ভালোই যত্নশীল।’

একের রক্ত অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন—স্লোগানে ২০০৬ সালের ২৪ মে বুটেক্সে বাঁধনের কার্যক্রম শুরু হয়। দীর্ঘ ১৮ বছরে অনেক মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কেবল রক্ত ব্যবস্থা করাই বাঁধনের কাজ নয়। শীত ও ঈদে অসহায় মানুষের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ, ক্যাম্পাসের সব শিক্ষার্থী-বাঁধনকর্মী-উপদেষ্টাদের নিয়ে ইফতার আয়োজন, বার্ষিক ভ্রমণ, নবীন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ব্লাড গ্রুপিং, রক্তদাতাদের সংবর্ধনা ও নবীন বরণ আয়োজন করে সংগঠনটি।

বছরজুড়ে বাঁধনের নানা আয়োজন থাকলেও তাদের প্রধান আয়োজন হলো দাতা সংবর্ধনা ও নবীন বরণ। এ আয়োজন নিয়ে সংগঠনটির সভাপতি ইমন কুমার সাহা বলেন, ‘রক্তদাতাদের মধ্যে যাঁরা বিদায়ী ব্যাচ, তাঁদের দাতা সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং নবীন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আমরা বরণ করে নিই।’ পুরো আয়োজনের জন্য প্রয়োজন হয় আর্থিক সহায়তা। এ নিয়ে তিনি বলেন, এ আয়োজনকে সফলভাবে সম্পন্ন করতে সার্বিকভাবে সহায়তা করে উপদেষ্টামণ্ডলী, বুটেক্স কর্তৃপক্ষ, বাঁধন ইউনিটের সঙ্গে জড়িত সব শিক্ষার্থী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]