চাকরিতে আবেদনের ফি বাড়ল, বাংলাদেশ ব্যাংককে কি অনুসরণ করবই না
আমাদের দেশে বয়সভেদে নানা শ্রেণির মানুষ রয়েছে। প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে মানুষের কাছে মূল্যায়িত হয়। তবে একশ্রেণির মানুষ আছেন আমাদের দেশে, যাঁদের কেউ মূল্যায়ন করেন না। তাঁরা অনেকটা ফুটবলের মতো। যে যেভাবে, যে অবস্থায় পান, সেভাবেই লাথি মারেন! আর ফুটবলের মতো দিগ্বিদিক ছুটে যায় মানুষগুলো। আমার মনে হয় কাদের কথা বলছি, এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন। আমি বলছি, আমার দেশের হতভাগা বেকারদের কথা। এ সমাজ এই রাষ্ট্র বেকারদের কথা কখনোই ভাবে না। তাঁদের দুঃখের, কষ্টের কথা শোনার মতো কেউ নেই! আমাদের দেশের বেকারেরা অনেকটা মাঝিবিহীন নৌকার মতো, নদীর মাঝখানে গিয়ে শুধুই ভাসতে থাকেন, তবে কূলকিনারা পান না খুব সহজে। আর এভাবেই ভাসতে ভাসতে হাজারো বেকার যুবক হারিয়ে যান নদীর অতল গহ্বরে।
সংবাদপত্র খুললেই আমরা দেখি হাজারো হতাশার গল্প। কারণ, এ সমাজে শুধু সফল যুবকদেরই মূল্যায়ন করে। ছুড়ে ফেলা হয় ব্যর্থ যুবকদের। এমনিতেই চাকরি না পাওয়াই হতাশায় থাকেন প্রায় বেশির ভাগ যুবক। এর মধ্যে অধিকাংশ তরুণের থাকে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, যার ফলে সে ঠিকমতো চাকরির প্রস্তুতি নিতে পারেন না। কারণ, চাকরিতে আবেদন করতে এ দেশে প্রচুর টাকা খরচ হয়। তা ছাড়া মেসে থাকা, খাওয়া, যাতায়াত ও বইখাতা কেনার জন্য খরচ তো রয়েছেই। এত খরচ থাকা সত্ত্বেও টিউশনি ছাড়া বেকারদের আর কোনো ভরসাস্থল নেই বললেই চলে!
ঠিক এ রকম অবস্থায় বেকারদের সঙ্গে বড় ধরনের তামাশা শুরু হয়েছে আবার। সাম্প্রতিক সময়ে চাকরিতে আবেদন ফি বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেখানে নবম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব চাকরিতে আবেদনের জন্য ৬০০ টাকা ধার্য করা হয়েছে, যেটি আগে ছিল ৫০০ টাকা। দশম গ্রেডের চাকরিতে আবেদনের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা, যেখানে পূর্বে ৩০০ অথবা ৪০০ টাকাতে আবেদন করা যেত। ১১তম ও ১২তম গ্রেডে আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা যেখানে আগে আবেদন করা যেত ২০০ টাকা দিয়ে। ১৩ থেকে ১৬তম গ্রেডে আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা যেখানে সাধারণত ১৫০ বা ১২০ টাকায় আবেদন করা যেত। আর সর্বশেষ ১৭ থেকে ২০তম গ্রেডের আবেদন ফি নির্ধারিত হয়েছে ১০০ টাকা। এই গ্রেডগুলোতে পূর্বে আবেদন করা যেত মাত্র ৫৬ টাকা বা ১১২ টাকা দিয়ে।
আগের তুলনায় এভাবে আবেদন ফি বাড়ানোর ফলে বেকারদের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়ে হতাশার পরিমাণ বাড়বে। যেখানে কর্তৃপক্ষের আবেদন ফি কমিয়ে একদম সীমিত করে ফেলা দরকার, সেখানে এভাবে চাল–ডালের মূল্য নির্ধারণের মতো আবেদনের ফি নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা বেকারদের সঙ্গে একধরনের তামাশা।
এটা তো গেল সরকারনির্ধারিত চাকরির ফি। দেশে বহু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে একটি আবেদন করতে কমপক্ষে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা গুনতে হয়। শুধু কি আবেদন করলেই খরচের পর্ব শেষ হয় বেকারদের? না, শুধু আবেদন করেই খরচের পর্ব শেষ হয়ে যায় না। পরীক্ষা দিতে যেতে হয় রাজধানী ঢাকাতে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত তথ্যমতে বছরে প্রায় দুই কোটি চাকরিপ্রত্যাশী চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে মাত্র ৫০ লাখ ঢাকায় থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। আর বাকিরা উপজেলা কিংবা জেলা শহর থেকে এসে পরীক্ষা দেন। যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া বাবদ আরও অন্ততপক্ষে ২০০০ টাকা খরচ হয়।
এ ছাড়া চাকরির পরীক্ষা গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা তো আছেই। দেখা যায়, আবেদন করার তিন বছর পর পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়, যেটা বেকারদের জীবনে একধরনের অভিশাপস্বরূপ। সাম্প্রতিককালে এমনও ঘটনা দেখা গেছে যে আট বছর পর চাকরির পরীক্ষা গ্রহণের জন্য প্রার্থীদের প্রবেশপত্র পাঠানো হয়েছে। এটি যেমন নিন্দনীয় কাজ তেমনি বেকারদের সঙ্গে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর বেকারদের টাকাগুলোকে নষ্ট করারও একধরনের ফন্দি বটে।
বেকারদের পকেট থেকে যত বেশি খরচ হবে, তত বেশি মানসিক চাপ বাড়বে বেকারদের ওপর। ফলে খুব সহজেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে আমাদের তরুণ সমাজ। আর আমরা হারিয়ে ফেলব জাতির সবচেয়ে মূল্যবান মানবসম্পদকে।
চাকরিতে আবেদনের ফি কমানো গেলে লাখো বেকার যুবক-যুবতী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে! তাদের দেহে প্রাণ ফিরবে। তাই চাকরিতে আবেদনের ফি না বাড়িয়ে বরং কমিয়ে দেওয়ার জন্য যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, সেগুলো খুব দ্রুত গ্রহণ করা। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশের ব্যাংকে নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে। ব্যাংকে আবেদন ফি যেমন কম তেমনিভাবে গুচ্ছ পরীক্ষার জন্য খরচে অনেকাংশে কমে যায়। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে কোনো টাকাই লাগে না। আমাদের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলেই বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুসরণ করে চাকরিতে আবেদন ফি নির্ধারণ করতে পারে। চাকরিতে আবেদন ফি নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক হোক মূল আদর্শ, বেকাররা হাঁফ ছেড়ে বাঁচুক। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সবাই এগিয়ে যাক দুর্দান্ত গতিতে স্বপ্নের ঠিকানায়।
লেখক: ফ্রিল্যান্স ফিচার লেখক