পরিবেশ দিবস: রোধ করতে হবে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও আবাসন
প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) এবং কোট ডি আইভরি ঘোষণায় বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২৩-এর প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ এড়ানো’। এবার বাংলাদেশে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের স্লোগান হচ্ছে, ‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ’।
একই সঙ্গে ‘জাতীয় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি-২০২৩’-এর প্রতিপাদ্য ‘গাছ লাগিয়ে যত্ন করি, সুস্থ প্রজন্মের দেশ গড়ি’। আমাদের নিত্যব্যবহারের ফলে সৃষ্ট প্লাস্টিক বর্জ্য তাপমাত্রা, অণুজীব, অতিবেগুনি রশ্মি ও অন্যান্য কারণে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ন্যানো ও মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়।
মাইক্রোপ্লাস্টিক মাটি, পানি এবং বাতাসে সহজে মিশে যায়। এতে পরিবেশের বাস্তুসংস্থান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীর স্রোত, বৃষ্টি, বন্যা ও বিভিন্ন উপায়ে পুকুর, নদী ও সমুদ্রে গিয়ে জমা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক। বর্জ্য বা পোড়ানো প্লাস্টিক মানুষের স্বাস্থ্য এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্রের তল পর্যন্ত প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রকে দূষিত করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক সহজেই প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়তে পারে, যা মানবদেহের জন্য হয়ে উঠছে ভয়াবহ হুমকি।
নিত্যব্যবহার্য প্লাস্টিকের ভাঙা অংশ থেকে বিসফিনলে নামক রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত হয়, যা মানুষের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণায় চট্টগ্রামে বাঁকখালী নদীর মোহনায় পানির উপরিভাগে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২০ হাজারের বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অণুজীবের পেটে ক্ষুদ্র আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। মহেশখালী, টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপ থেকে অপরিশোধিত লবণে কেজিতে প্রায় ১ হাজারটি এবং পরিশোধিত লবণে ৭০০ থেকে ৯০০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে।
মাটিতে মিশ্রিত প্লাস্টিক বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের মাধ্যমে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়, যার ফলে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। ময়লা–আবর্জনা ফেলার ভাগাড় বা জৈববর্জ্য থেকেও মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। মিথেন গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কার্বন ডাই–অক্সাইডের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর। ২০২১ সালের ২১ মে মাসে প্রকাশিত বিবিসির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে। ওই বছর এপ্রিল মাসে ব্লুমবার্গ মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে।
বাংলাদেশে ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বছর দুয়েক একটু নিয়ন্ত্রিত থাকলেও পরবর্তীকালে নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে অবাধে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দেওয়া তথ্য অনুসারে, বিশ্বের ৮৭টি দেশে একবার ব্যবহারের উপযোগী পলিথিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। উপাদানভেদে প্লাস্টিক পলিথিন পচে মাটির সঙ্গে মিশতে অনেক ক্ষেত্রে ৪০০ বছরেরও বেশি সময়ে লাগে। ফলে এই প্লাস্টিক মাটির ওপরে স্তর তৈরি করে কৃষি ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আমরা প্রতিবছর ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ উপলক্ষে সভা-সেমিনার, আলোচনা সভা, র্যালি করলেও পরে সময়ে তেমন কোনো উদ্যোগ থাকে না। আমাদের প্লাস্টিক দূষণ এড়ানোর পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ বা বনায়ন জরুরি। বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহকারী অকৃত্রিম বন্ধু এ সবুজ বৃক্ষরাজি। প্রাণ বাঁচানোর অক্সিজেন ছাড়া অকৃপণভাবে ফল, ফুল, ছায়া, ঋতুবৈচিত্র্যে ও জীববৈচিত্র্যের উৎস এই বৃক্ষরাজি। বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১০ কোটি ৮০ লাখ মানুষ বনের সম্পদ ব্যবহার করে থাকেন। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনতা আনতে না পারলে আমাদের পরিবেশ কখনো জীবনবান্ধব বা জীবনোপযোগী করা সহজ হবে না।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা বাঞ্ছনীয়। জাতিসংঘের ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফরেস্ট-২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বনভূমির পরিমাণ এখন মোট ভূমির ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ঘাটতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
লোভ আর প্রলোভনে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। আপনার বাড়ির পাশে কারখানা, আবাসিক এলাকা, বহুতল ভবন হলে আপনার জায়গার দাম বাড়বে। আপনার এলাকার লোক চাকরি করে আর্থিক উন্নয়ন ঘটাতে পারবে, যা সহজেই নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তকে প্রলোভিত হয়। ফলে সবুজ গ্রাম, ফসলের জমি সরকার–নির্ধারিত মূল্যের অনেক বেশি গুণ পাওয়ার আশায় বিক্রয় বা হস্তান্তরিত হয় উচ্চবিত্তের কাছে। শুরু হয় ইটপাথরের স্থাপনা, জমির মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় পাকা বা পিচঢালা রাস্তা।
গ্রামীণ পরিবেশে চালু হয় শিল্পকারখানা, গড়ে উঠে শ্রমিকদের আবাসস্থল, দোকানপাট, রাস্তাঘাট, যা সবই পর্যায়ক্রমে গ্রাস করে চলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। ধাপে ধাপে হ্রাস পায় বিশুদ্ধ অক্সিজেনের সরবরাহ।
অবাধ শিল্পায়ন ধ্বংস করে দেয় অক্সিজেন সরবরাহকারী সবুজ লতা, গুল্ম ও বৃক্ষরাজি। গ্রামও জমির মধ্যে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার গুলোর পরিকল্পিত ড্রেনেজ ও বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা শিল্পনীতিমালা অনুযায়ী খুবই অপ্রতুল। শহরের বাইরের শিল্পকারখানাগুলোয় পরিবেশ অধিদপ্তরের তদারকি একেবারে নেই বললেই চলে।
উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিপরীত কোনো বিষয় নয়। শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো গত উন্নয়ন ছাড়া দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের তোয়াক্কা না করে শিল্পকারখানা স্থাপন ও অবকাঠামো নির্মাণ গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে এখন পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সরকার–নির্ধারিত এলাকায় শিল্পায়ন বাধ্যতামূলক। গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্ধারিত এলাকায় স্থানান্তর।
নিষিদ্ধ পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী উৎপাদনও বাজারজাতকরণ আইনের কঠোর প্রয়োগ। প্লাস্টিক বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার বা রিসাইক্লিং খাতকে গুরুত্ব দেওয়া। ভাগাড় বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন। গ্রামকে শহরে নয়, উন্নত গ্রামে রূপান্তরের প্রকল্প গ্রহণ। যত্রতত্র আবাসিক প্লট বা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে বিধিনিষেধ আরোপ ও নীতিমালা তৈরি।
পাহাড় কাটা, পুকুর ভরাট, সবুজ প্রকৃতি ও বন-পাহাড় দখল করা বা লিজ দেওয়া বন্ধ ঘোষণা করা। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে জনপ্রতিনিধি, ছাত্র, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মের যাজকদের সমন্বয়ে নীতিমালা ও কমিটি করে কার্যক্রম মনিটরিং করতে হবে। কারণ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা মানে হচ্ছে আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে রক্ষা ও আগত প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়া।
লেখক: তপন ভট্টাচার্য, অর্থ সম্পাদক, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ, চট্টগ্রাম
**নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা: [email protected]