কিশোর কেন অপরাধী

কিশোর গ্যাংপ্রতীকী ছবি

‘কিশোর’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মাথায় আসে প্রাণোচ্ছল, উদ্যমী, উৎসুক, অনুসন্ধানী ও অল্প বয়সী মানুষের প্রতিচ্ছবি। অনেক গাছে যেমন শীতে পাতা ঝরে যায়, আবার বসন্তে নতুন পাতা আসে, মানুষের জীবনের এই সময়টাও তেমন; কিছু পাতা ঝরে যাওয়ার এবং নতুন করে আবার কিছু পাতা গজানোর সময়। লোকে পাতাশূন্য গাছকে সাধারণত কুৎসিত মনে করে থাকে। কিন্তু তার এই শূন্যতার মাঝে যে নতুন করে জেগে ওঠার হাহাকার, সুগন্ধি কিশলয়ের পৃথিবীর আলো দেখার নীরব বাসনা, তা কজনই বা মনে রাখে? কৈশোর যেন পাতাশূন্য গাছ, যা আপাত শ্রীহীন; কিন্তু সৌন্দর্য আর সম্ভাবনার বিস্ফোরণ ঘটাতে অপেক্ষমাণ। মানবজীবনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জটিল এ সময়টিকে শৈশব আর যৌবনের সংযোজক বলা যায়। এ সময় শরীর আর মনে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন আসে, যাকে আমরা ‘বয়ঃসন্ধি’ বলে জানি। মানুষ প্রথম প্রেমে পড়ে কৈশোরেই, যৌবনে নয়। মানুষ বড় স্বপ্ন দেখে কৈশোরেই, যৌবনে হয়তো বাস্তবতার কথা ভেবে স্বপ্নটাকে বড় করতে ভয় পায়। তাই শৈশব বা যৌবনের চেয়ে কৈশোরের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়।

‘অপরাধ’ শব্দটিকে ‘কিশোর’ শব্দের সঙ্গে বড় বেমানান লাগে। কিন্তু তেতো হলেও সত্যি, বর্তমানে খুব প্রচলিত শব্দজোড় ‘কিশোর অপরাধ’। বলা যায়, বর্তমান বাংলাদেশের এক আতঙ্কের নাম কিশোর অপরাধ। অপার সম্ভাবনাময় কিশোরেরা কেন অপরাধী হয়, এ থেকে উত্তরণের পথই বা কী? পণ্ডিতেরা মোটাদাগে কিশোর অপরাধের অনেক কারণই বলে থাকেন। যেমন শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য, পারিবারিক কলহ, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, অসৎ সঙ্গ, মাদকাসক্তি, রোমাঞ্চকর অথচ অন্ধকার জীবনের প্রতি প্রবল আগ্রহ, রাজনীতির মন্দ প্রভাব ইত্যাদি। এগুলো সবই কিশোর অপরাধের অত্যন্ত যৌক্তিক কারণ। উপর্যুক্ত কারণ বা নিয়ামকগুলো কোনো না কোনোভাবে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। অনেকটা ফাঁদের মতো কাজ করে এগুলো। কোনো কিশোর এসবের কোনো একটিতে পা দিলেই সে অবচেতনভাবেই অন্য নিয়ামকগুলোতেও আপনা-আপনি জড়িয়ে যায়। আর এভাবেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় কিশোর অপরাধী থেকে বড় কোনো দাগি অপরাধী বা মাফিয়া।

কিশোর অপরাধ ঠেকাতে আপনার বা আমার কি কোনো ভূমিকা আছে? অবশ্যই আছে। কারণ, যেসব কিশোর অপরাধে জড়াচ্ছে তারাও মানুষ এবং তারা কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। পথশিশুরা এ ক্ষেত্রে খানিক ব্যতিক্রম হতে পারে। কারণ, অনেক পথশিশুরই ঠিক পরিবার বলতে আমরা যেটা বুঝি তেমনটা থাকে না বা তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় জীবন যাপন করে অনেক ক্ষেত্রে। তবু তারা আমাদের সমাজের সদস্য। অনেক পরিবারে মা–বাবা সন্তানদের ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। তারা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে এসব নিয়ে মোটেও তাঁরা চিন্তিত নন। এমনকি অনেক অভিভাবক এই বলেও প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন, এ বয়সে এমন এক-আধটু করবেই! অনেক একক পরিবারে মা-বাবা দুজনই কর্মজীবী, ফলে সন্তানকে সেভাবে সময় দিতে পারেন না। সন্তান গৃহকর্মীর কাছে বড় হয়; মা-বাবার আদর–স্নেহ থেকে যেমন বঞ্চিত হয় তেমনি সামাজিক মূল্যবোধেরও ঘাটতি দেখা দেয় তাদের মধ্যে। অনেক অভিভাবককে দেখেছি সন্তান খারাপ কাজ করলে লজ্জিত হওয়ার পরিবর্তে গর্বিত হন! এমন বহু উদাহরণ রয়েছে অপরাধী সন্তানের ভরসায় মা-বাবাও অপরাধ করেন। সমাজে দম্ভ করে বেড়ান, আমার সন্তান অমুক–তমুক, অমুক দলের তমুক, অমুক ভাইয়ের তমুক। অর্থাৎ তাঁরা যখন দেখেন যে তাঁদের সন্তান অপরাধ করুক আর যা–ই করুক, সে একটা শক্ত অবস্থানে (নেতিবাচক) চলে গেছে; সমাজে তার একটা প্রভাববলয় তৈরি হচ্ছে; মানুষ তাকে ভয় পাচ্ছে, তখন মা-বাবা আর সন্তানকে বাধা দিতে চান না। বরং সন্তানের অপরাধমূলক প্রভাবকে খাটিয়ে তাঁরাও সমাজে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেন।

কিশোর অপরাধের যতগুলো জ্ঞাত কারণ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক কারণ হচ্ছে রাজনীতির মন্দ প্রভাব এবং এ কারণটি বাকি অন্য কারণগুলোর মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ একজন কিশোর যেভাবেই অপরাধে জড়াক না কেন, আজ বা কাল সে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হবেই হবে। এর কারণ, এদের সহজে ব্যবহার করা যায়, অল্প টাকায় যেকোনো হিংস্র কাজ করানো যায়, কিশোর অপরাধের শাস্তি নিয়ে আইনের ফাঁকফোকর আছে, এদের পেলে–পুষে ভবিষ্যতে বিশ্বস্ত ‘ক্যাডার’ বানানো যায় ইত্যাদি। কোনো একজন রাজনৈতিক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় এভাবে গড়ে ওঠে ভয়ংকর কিশোর গ্যাং, যাদের অপরাধের মাত্রা দিন দিন মারাত্মক হিংস্র রূপ নিচ্ছে। এমন কোনো অপরাধ নেই, যা এই বিপথগামী কিশোরেরা করছে না। মাদক সেবন থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, নারী উত্ত্যক্তকরণ, তুচ্ছ কারণে মারামারি, ধর্ষণ, এমনকি খুন পর্যন্ত; সবই তারা করছে সদর্পে। সাধারণ মানুষ তাদের ভয় পায়, পারতপক্ষে তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করে না, এড়িয়ে যায়।

আমাদের দেশের আইনে কিশোর অপরাধীদের অনেক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ফলে গুরুদণ্ড করেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে; যা মোটেও কাম্য নয়। কারণ, শিশু আর কিশোর মোটেই এক নয়। যে কিশোর, তার যথেষ্ট বোধক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু আমাদের আইন তাদের ২০ বছর পর্যন্ত অবুঝ শিশু বানিয়ে রাখতে চায়! অনেকেই এ বিষয়ে একমত হবেন না, আমার প্রতি বিষোদ্‌গার করবেন। কিন্তু সত্যিটা আমাদের সবারই স্বীকার করা উচিত। কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড না হোক, অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তি অবশ্যই যাবজ্জীবন করা উচিত। খরগোশের মতো চোখ বন্ধ করে নিজেদের নিরাপদ ভেবে আমরা আর কত নিজেদের ধোঁকা দেব?