ছাইয়ের মাঝে মিশে আছে এক নারীর স্বপ্ন
ভরদুপুর। শহরের চারপাশে তখন প্রখর রোদে আগুন ঝরছে। মানুষ রোদ এড়িয়ে দালানের ছায়ায় গা লুকায়। ঠিক এমন সময় নিচ থেকে কানে এলো চিৎকার, ‘ছাই লাগবে, ছাই!’
বারান্দায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে নিচে তাকাতেই দেখা মিলল এক নারীর। হাতে ছাইয়ের বস্তা, মুখে ধুলো আর ঘামে মাখা এক নারী। আজকাল তো আর শহরে তেমন একটা কেউ ছাই ব্যবহার করেন না, তাহলে কেন এই পেশা? কেন এই রোদে দাঁড়িয়ে বাঁচার ডাক? হাতের কাজ ফেলে নেমে গেলাম নিচে। এত কিছু থাকতে ছাই কেন? কেন এই কঠিন দুপুরে শহরের গলিতে গলিতে ছাই নিয়ে হাঁটছেন তিনি?
জানলাম, নাম তাঁর শেলীনা। বয়স প্রায় পঞ্চাশ। শাড়ির আঁচলে মুজে যাওয়া ছাই মুছতে মুছতে হাঁটেন শহরের অলিগলি ঘুরে। কেউ তাঁকে ডাকেন ‘ছাইওয়ালি’, কেউ আবার স্নেহে ‘শেলীনা আপা’। কিন্তু তাঁর পরিচয়টা এর চেয়েও বড়—তিনি একজন সংগ্রামী নারী। কারণ, এই ছাই-ই তাঁর অস্তিত্বের সঙ্গী, সন্তানদের বেঁচে থাকার ভরসা, তাঁর নিজস্ব পৃথিবীর সোনার খনি।
ভোরের আগে ঘুম ভাঙে শেলীনার। শাহবাগ থেকে পাইকারি দামে ছাই এনে সকাল সকাল গলিতে গলিতে বিক্রি করতে বের হন। ৫২০ টাকা দরে এক বস্তা ছাই কিনতে হয় তাঁকে। সেই ছাই ছোট ছোট ভাগে ৫০ বা ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। সারা দিনে বিক্রি কোনো দিন ৩০০, কোনো দিন ৩৫০ টাকা।
‘ছাই লাগবে, ছাই’
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। শহরের আনাচকানাচে ছাই নিয়ে হাঁটেন শেলীনা। ‘ছাই লাগবে, ছাই’—এই চিৎকারে মিশে থাকে তাঁর দিনের শেষ রুটি, মেয়ের ওষুধের খরচ, এক চিমটি লবণ, এক মুঠো চালের দানার স্বপ্ন।
শহরের বহুতল দালানের গৃহকর্মীরা তাঁর প্রধান ক্রেতা। কেউ বাসন মাজতে, কেউ গাছের গোড়ায় ছাই ব্যবহার করেন। কারও কাছে ছাই স্রেফ ময়লা, কারও কাছে অমূল্য সঙ্গী। শেলীনার কাছে সেটা বাঁচার অক্সিজেন।
‘এক বস্তা কিনি ৫২০ টাকায়, বিক্রি কইরা দিনে ৩০০-৩৫০ টেকা রোজগার হয়। এই টাকায় ভাড়া দিই, চাল, ডাল কিনি, মাইয়ার চিকিৎসা চলে,’ বলেন শেলীনা। কথায় কঠোরতা আছে, চোখে জলের রেখা। শেলীনা জানেন না এর বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, জানেন শুধু, ছাই মানে টাকা—এটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় সত্য।
কেন এই পেশা
প্রশ্ন করেছিলাম অন্য পেশা থাকতে কেন এই পেশা? জানালেন বাসাবাড়িতে কাজ না করে ছাই বিক্রিকে বেছে নিয়েছেন মূলত আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার কারণে। অন্যের বাড়িতে কাজ করলে সেখানকার শর্ত, সন্দেহ, বকাঝকা মেনে নিতে হয়, যা তার জন্য মানসিকভাবে খুবই কঠিন। শেলীনার ভাষায়, ‘মাইয়া প্রতিবন্ধী, স্বামীর অবস্থা ভালো না—কেউ ওসব বোঝে না। এই ছাই বিক্রি করি, নিজের মতো চলি। দিন শেষে নগদ টেকা হাতে পাই, ওই টেকা দিয়া চাউল-ডাল কিনি, মাইয়ার ওষুধ কিনি। বাসার কামে গেলে মাসের শেষে টেকা দেয়, তত দিনে চুলায় আগুনও জ্বলে না, মাইয়ারে ভাতও খাওয়াইতে পারি না। যত দিন বাঁচুম, কারও দরজায় দাঁড়ায়া কাজ চামু না। এইটুকু আত্মসম্মান তো মাইনষের থাকন লাগে, তাই না আপা?’
অদৃশ্য লড়াইয়ের গল্প
শেলীনার মেয়ে রুবিনা জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। তার চিকিৎসায় প্রতিদিনই লাগে টাকা। স্বামী আছেন, কিন্তু তিনিও কাজে অক্ষম। সংসারের পুরো ভার শেলীনার কাঁধে। থাকেন বস্তিতে, ভাড়া মাসে ৪ হাজার ৩০০ টাকা। একদিন কাজ বন্ধ মানেই চুলা নিভে যাওয়া। শেলীনার মনে একটাই স্বপ্ন—মেয়েটার যেন ঠিকমতো চিকিৎসা হয়।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সমাজের না দেখা সীমানা
শহরের যান্ত্রিক চাহিদার ভিড়ে শেলীনার মতো মানুষেরা অদৃশ্য। তাঁদের না আছে পত্রিকার হেডলাইন, না আছে কোনো ফেসবুক পোস্টে ‘নেত্রী’ হওয়ার গল্প। তারা বাঁচেন নিঃশব্দে, যুদ্ধ করেন নীরবে। তবু তাঁদের হাতেই টিকে আছে অগণিত সংসার, অগণিত স্বপ্ন।
নারীর শ্রমের স্বীকৃতি কোথায়? ছাই কুড়িয়ে বা বিক্রি করে বাঁচা শেলীনার শ্রমও শ্রম। কিন্তু সেই শ্রমের কোনো তালিকাভুক্ত বেতন নেই, নেই কোনো নিরাপত্তা। তবু তিনি থামেন না।
শেলীনা বলেন, ‘দুনিয়াতে বাঁচতে হইলে নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হয়। ছাই বিক্রি কইরা হোক বা অন্য কিছু কইরা, আমি কারও কাছে হাত পাতি না। এইটুকু ইজ্জতই আমার বড় সম্বল।’
শেলীনাকে এই শহর চেনে না। যারা চেনে, তারাও হয়তো করুণার চোখে দেখে। কিন্তু শেলীনা চান না করুণা, চান সম্মান। তার কাছে জীবনের মানে হলো টিকে থাকা, নিজের শক্তিতে দাঁড়ানো। ছাই বিক্রি করে হোক কিংবা অন্য কোনো পেশায়, নিজের মতো করে লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
অদৃশ্য নায়িকা—
শেলীনার মতো কত শত নারী আছেন, যাঁরা প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙার আগেই ঘর ছাড়েন। কেউ রাস্তায় ঝাঁট দেন, কেউ ইটভাঙা কারখানায় দিন কাটান, কেউবা শেলীনার মতো ছাই বিক্রি করে সংসার টানেন। সবারই লক্ষ্য এক—মুখে আহার আর সন্তানদের জন্য ভালো ভবিষ্যৎ।
তাঁদের গল্পগুলো শোনার মতো কান আমাদের খুব কমই আছে। অথচ এঁরা কোনো দিন হেরে যেতে শিখেননি।
ছাইয়ের ধুলোয় মাখা শেলীনার হাতের রেখায় লেখা আছে মেয়ের সুস্থ হওয়ার গল্প, লেখা আছে তাঁর নিজস্ব বিজয়ের ইতিহাস। এই গল্পগুলো হয়তো কোনো দিন পত্রিকার প্রথম পাতায় আসবে না, তবু এই গল্পগুলোই আসল গল্প—অন্তরের গল্প।
নারীর অর্থনৈতিক অবদান অনেক সময় সরকারি পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না। জাতীয় শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের অপ্রচলিত খাতে কাজ করা নারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। গৃহস্থালির আড়ালে কিংবা অলিগলির ছায়ায় তাঁরা অবিরাম শ্রম দিয়ে চলেছেন। কিন্তু এই গল্পগুলো কজন শুনছেন?
শেষ কথা
শেলীনা একা নন। বাংলাদেশের প্রতিটি শহর, প্রত্যন্ত গ্রাম কিংবা মফস্সলে অজস্র শেলীনা আছেন, তাঁদের গল্প শুনতে হলে শুধু চোখ নয়, দরকার মনের কান খুলে রাখা।
কোনো পদক নেই, কোনো পত্রিকার হেডলাইন নেই, তবু প্রতিটি দিনেই তাঁরা নতুনভাবে জীবন জয়ের গল্প লিখে চলেছেন। শেলীনাদের ছাইয়ের মতোই তাঁদের গল্পগুলোও হয়তো ধুলোয় ঢাকা, কিন্তু ঠিকই আলো ছড়ায়।