ভাবনামুক্ত ভূমির জন্য কিছু কথা
ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকে জীবনাবসান পর্যন্ত মানবজীবনের প্রতিটি ধাপে ভূমির ভূমিকা অনস্বীকার্য। সংবিধানে বাসস্থান হিসেবে ভূমিকে মৌলিক অধিকাররূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে আত্মপরিচয়, সামাজিক মর্যাদা ও জীবনের অবলম্বন হিসেবেও ভূমির মালিকানা ব্যক্তিজীবনের আরাধ্য বিষয়। তারপরও মূল্যবান সম্পদ এ ভূমি নিয়ে ভাবনার বলিরেখায় ভাঁজ পড়েনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের পরও ব্যক্তিপর্যায়ে ভূমি নিয়ে ভোগান্তি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। বরং সংকট সরকারি স্মার্ট ব্যবস্থাপনার গণ্ডি পেরিয়ে ভিন্ন রূপে ভিন্ন মাত্রায় বহমান রয়েছে। ফলশ্রুতিতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ধরা দিচ্ছে না সহসা। বরং সব দেওয়ানি এবং অর্ধেকের বেশি ফৌজদারি মামলার পরোক্ষ কারণ হিসেবে ভূমি নিরন্তর তার অবদান রেখে চলেছে। মামলাজটে জর্জরিত জনগণ অর্থ আর শান্তি হারিয়ে হচ্ছে দিশাহারা। চলমান নিবন্ধে মাঠপর্যায়ে ভূমি নিয়ে ভোগান্তির স্বরূপ বিশ্লেষণ এবং তা উত্তরণে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
কারও দখল আছে তো দলিল নেই, কারও দলিল আছে তো খতিয়ান নেই, কারও খতিয়ান আছে. তো দাখিলা নেই। আবার কারও সব আছে কিন্তু ভূমির ব্যবহার করে না। কিন্তু কেন? কারণ, ভূমিমালিকরা যথেষ্ট পরিমাণে এ ব্যাপারে সচেতন নন। সচেতন নন এ জন্য বলছি যে ভূমি যেমন সম্পদ, টাকাপয়সাও তেমন সম্পদ। কিন্তু টাকাপয়সা যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় মানুষ যে রকম সিরিয়াস, ভূমির ক্ষেত্রে সে রকম নয়।
উদাহরণস্বরূপ যদি বলি, একজন মানুষ তার নগদ টাকা হয় বাড়িতে সুরক্ষিত লকারে রাখে, না হয় ব্যাংকে রাখে। নিয়মিত ব্যালান্স চেক করে, ডেবিট ক্রেডিট যা–ই হোক তাৎক্ষণিক খোঁজখবর রাখে। কোথাও কোনো গরমিল পরিলক্ষিত হলে তা সংশোধনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। মোটকথা, অর্থসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় মানুষ যথেষ্ট পরিমাণ সচেতন। অথচ জমির ক্ষেত্রে আমরা কী দেখতে পাই? একজন উত্তরাধিকারসূত্রে জমি পেলেন, কিন্তু তার নামজারি করলেন না, নামজারি করলেন তো নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর দিলেন না। আবার টাকা দিয়ে জমি কিনে দলিল সম্পাদন করলেন, কিন্তু নামজারি করলেন না। ফলে ভূমি জরিপের সময় জমিটি তাঁর নামে রেকর্ড বা খতিয়ান হলো না। শুরু হলো ভূমি নিয়ে ভাবনা। এখানেই শেষ নয়! যেহেতু তিনি জরিপকালে তাঁর জমি রেকর্ড করালেন না, অর্থাৎ তাঁর জমিটি পূর্ববর্তী মালিকের নামে খতিয়ান হয়ে গেল স্বাভাবিকভাবেই। এখন পূর্ববর্তী মালিকের ওয়ারিশরা বিষয়টি জানা সত্ত্বেও প্রতারণামূলকভাবে সেই জমি অন্য একজনের নামে বিক্রি করলেন। এবার সর্বশেষ ক্রেতা সেই জমি দখলে নিতে গিয়ে জানতে পারলেন, জমিতে অন্য কেউ দখলে। সাড়ে সর্বনাশ! আরও আছে, জমির দলিল করার সময় দাতার হস্তান্তরিত জমির দাগের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত দাগ সংযুক্ত করে দলিল করা, যা পরে দলিলদাতার ওয়ারিশ বা অন্য ক্রেতার সঙ্গে বিবাদের সৃষ্টি করে। এ ছাড়া দলিলে সুনির্দিষ্টভাবে জমির চৌহদ্দি চিহ্নিত না করাও বিবাদের অন্যতম কারণ। এরপর সময়ের ব্যবধানে কোনো দাগের জমির মূল্য বেড়ে গেলে সবাই তখন মূল্যবান দাগের জমিটি দাবি করে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। শুরু হলো এবার মারামারি আর মামলার খেলা! একজন টাকা দিয়ে জমি কিনে দখল পাচ্ছেন না, আরেকজনের দখলে আছে কিন্তু নিজ নামে খতিয়ান নেই। অবশেষে দেওয়ানি আদালতে মামলাই শেষ ভরসা। এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলছে ভূমি নিয়ে ভোগান্তি। ওদিকে জালিয়াতি আর স্বার্থের দ্বন্দ্বে মামলার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে মামলার নথি আদালতের রেকর্ড রুমের ছাদ ছুঁই ছুঁই। যথাযথ কাগজপত্র সঠিক সময়ে আদালতে উপস্থাপন না করায়, শুনানিতে হাজির না হওয়ায় আদালত ন্যায়সংগত আদেশ দিয়ে নিষ্পত্তিও করতে পারছেন না। এ ছাড়া স্বার্থান্বেষী পক্ষের গাফিলতিতে মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি তো রয়েছেই। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে হয়তো কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তী প্রজন্মকে তার ঘানি টানতে হয়।
এখানেই শেষ নয়। পিতার ভূমিসংক্রান্ত অবহেলার পরিণতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ভোগ করে যাচ্ছে সন্তানেরা। বেঁচে থাকতে পিতা তাঁর স্ত্রী, পুত্র আর কন্যাদের সঠিক হিস্যা অনুসারে জমিজমা বণ্টন না করে দেওয়ার ফলে স্বভাবতই পুত্ররা মা-বোনদের জমির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে। পরে ভাই–বোন মারা যাওয়ার পর তাদের সন্তানেরা ন্যায্য সম্পত্তির হিস্যা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। ক্ষেত্রবিশেষে এই বিবাদ গিয়ে গড়ায় ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সহিংসতায়। আমাদের দেশে ভূমি নিয়ে তাই হাতাহাতি বা হত্যার ঘটনাও কম নয়। আবার দখল নিয়েও চলে হাঙ্গামা। একজনের জমি অন্যজন জেনে বা না জেনে দখল করে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আদালতের শরণাপন্ন হয়। আদালত দখল তদন্ত করার জন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসি ল্যান্ডকে দায়িত্ব দেন। তিনি তদন্তে গিয়ে পড়ে যান আরেক ফ্যাসাদে। স্থানীয় লোকজন প্রভাবশালী দখলদারের ভয়ে কেউ সাক্ষী দেয় না জমিটি কার দখলে? বিভিন্ন অনুমাপক দিয়ে পর্যালোচনা করে এসি ল্যান্ড একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন আদালতে। কিন্তু এক পক্ষ প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দেয়। এভাবে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে শুরু করে। এভাবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে সম্পদটি একজন মানুষের জন্য অপরিহার্য, সেটি নিয়ে ভোগান্তি জন্ম থেকে মৃত্যুর পর পর্যন্ত চলতে থাকে।
তাহলে এ থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নেই? অবশ্যই আছে। আর তা আমাদের হাতেই। সময় এসেছে ভূমি নিয়ে মৌলিক জ্ঞান অর্জন করার, ভূমি নিয়ে সচেতন হওয়ার। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ছোট্ট এ দেশে ভূমির সঠিক ব্যবস্থাপনার মূল শর্তই হচ্ছে ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা। সাধারণত একজন ব্যক্তি তিনভাবে জমির মালিকানা অর্জন করেন, যথা ক্রয়ের মাধ্যমে, উত্তরাধিকারসূত্রে এবং আদালতের আদেশমূলে।
এ ক্ষেত্রে ভূমির মালিকদের যা করণীয়
জমি ক্রয়ের পূর্বে বিক্রেতার দখল যাচাই করা, জমিতে বিক্রেতার ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা পরিশোধের দাখিলা যাচাই করা, জমিসংক্রান্ত কোনো মামলা চলমান আছে কি না, সংশ্লিষ্ট অধিক্ষেত্রের দেওয়ানি আদালত বা ভূমি অফিসের রেকর্ডরুম থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা, জমি ক্রয়ের সময় সম্পূর্ণ দলিল ভালোভাবে পড়ে ও বুঝে স্বাক্ষর করা, ক্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে দলিল সম্পাদন করে সাবরেজিস্ট্রার অফিসে দলিল রেজিস্ট্রেশন করা, সাক্ষী বা স্থানীয় লোকজনের উপস্থিতিতে জমির মালিকের কাছ থেকে সরেজমিনে দখল গ্রহণ করা, দলিল রেজিস্ট্রেশনের পর অনতিবিলম্বে উপজেলা ভূমি অফিস থেকে নামজারি করা এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি অফিসে হাল সন পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে রসিদ বা দাখিলা সংগ্রহ করা। উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিকানা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে অংশীদার বা ভাইবোনদের মধ্যে প্রাপ্য হিস্যা ও শান্তিপূর্ণ দখল অনুযায়ী অংশনামা বা বণ্টননামা দলিল সম্পাদন করে তা রেজিস্ট্রেশন করা, রেজিস্ট্রেশনের পর দ্রুত নামজারি করা এবং হাল সন পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে দাখিলা সংগ্রহ করা।
এ ছাড়া আদালতের আদেশে কোনো জমির মালিকানা অর্জিত হলেও যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে নামজারি ও ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে দাখিলা সংগ্রহ করা উচিত। সব ক্ষেত্রেই জমির দখল সুষ্ঠুভাবে বজায় রাখার জন্য জমি ব্যবহার বা চাষাবাদ এবং নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা উচিত। বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নামজারি ও ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ সম্পূর্ণরূপে অনলাইন এবং নগদ অর্থ লেনদেনমুক্ত করা হয়েছে, যা প্রচলিত সব অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার করে পরিশোধ করা যায়। অনলাইনে www.land.gov.bd ঠিকানায় প্রবেশ করে খুব সহজে নামজারি করা যায়। নামজারির নির্ধারিত সময় সর্বোচ্চ ২৮ দিন এবং ফি সর্বমোট ১ হাজার ১৭০ টাকা। নামজারির প্রতিটি ধাপে আবেদনকারীকে মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে নোটিফিকেশন দেওয়া হয়। ফলে আবেদনটি কোন পর্যায়ে কার কাছে কার্যক্রম চলমান আছে, তা নাগরিক তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারেন। এ ছাড়া নামজারি সেবা গ্রহণ করে নাগরিক সন্তুষ্ট কি না, তা–ও ফিডব্যাক জানানো সম্ভব হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের হটলাইন নম্বর ১৬১২২ ডায়াল করে নাগরিকেরা ভূমিসংক্রান্ত যেকোনো তথ্য জানতে পারেন, সেবা গ্রহণ করতে পারেন এবং মতামত জানাতে পারেন। দেশের প্রথম স্মার্ট মন্ত্রণালয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনগণের ভূমি নিয়ে ভোগান্তি অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
তবে শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ভূমি নিয়ে আরও কিছু গুণগত কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতার জন্য শিক্ষাজীবনের মাধ্যমিক পর্যায়ের সিলেবাসে ভূমির মৌলিক জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ডিজিটাল জরিপ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে ভূমির মালিকানা পরিবর্তনের তথ্য হালনাগাদ এবং মালিকদের মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে অবহিত করতে হবে। দলিল রেজিস্ট্রেশনের সময় দলিলের বর্ণনা ও ভূমির দখল যাচাই নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত বিশ্বের মতো ভূমিসংক্রান্ত জালিয়াতি ও অপরাধ কার্যকরভাবে প্রতিকারে প্রয়োজনে আলাদা বাহিনী গঠনের বিষয়েও ভাবা যেতে পারে। সরকার ইতিমধ্যে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ আইন, ২০২৩ প্রণয়নের মাধ্যমে ভূমিসংক্রান্ত অপরাধ তাৎক্ষণিক ও কার্যকরভাবে দমনে একটি মাইলফলক স্পর্শ করেছে বলে সাধারণ জনগণ মনে করছে। আইনের ন্যায়সংগত প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে ভূমিসংক্রান্ত আইনগুলোকে যুগোপযোগী করে সংশোধন করাও সময়ের দাবি। আমরা চাই একটি স্বচ্ছ, স্মার্ট ও ভাবনামুক্ত ভূমি ব্যবস্থাপনা। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ আর ২১০০ সালের নিরাপদ বদ্বীপ গড়তে ভূমি নিয়ে ভোগান্তির রাশ তাই এখন থেকেই টেনে ধরতে হবে। একটি সেবা ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে জনগণের ভূমিকে ভাবনামুক্ত রাখতে সহজ ভূমিসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: সহকারী কমিশনার (ভূমি), সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম