পেনশন সমর্পণকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে রাষ্ট্রের ক্ষতি কী?

ফাইল ছবি

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি একটি মানবিক আবেদন জানাতে চাই।

আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রে একটি বিষয় নিশ্চিতরূপে ধরে নেওয়া হয়, জনগণের জন্য হচ্ছে দেশ। সে হিসেবে জনগণের সরকার, জনগণের জন্য বিভিন্নমুখী কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। আমাদের সরকারও জনগণের কল্যাণে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর জনগণের কল্যাণে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে বয়স্কদের (৬০ পেরুনো) জন্য বয়স্কভাতা, বিধবাদের জন্য বিধবাভাতা, প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিবন্ধীভাতা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা ভাতা (বৃদ্ধি) প্রবর্তন করেই সবার প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি সব ধরনের কর্মজীবীদের ৬০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাঁদের পেনশন সুবিধার আওতায় আনার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ। সরকারের বিভিন্নমুখী উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক সব ধরনের কর্মকাণ্ডের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকাও অগ্রগণ্য। কেননা, সরকারের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই প্রত্যক্ষ অংশীজন।

একসময় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন–ভাতা খুবই কম ছিল। তবে সরকারি চাকরির একটি বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে, চাকরিজীবন শেষে পেনশনের সুবিধা। এ কারণে দেখা গেছে, জনগণ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, কম বেতন-ভাতা সত্ত্বেও সরকারি চাকরিকে প্রাধান্য দিয়ে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করতেন। অপর দিকে অনেক মেধাবী সরকারি চাকরিতে বেতন-ভাতা কম হওয়ার কারণে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে অনেক বেশি বেতনে বেসরকারি চাকরিতে যোগ দিতেন।

বাংলাদেশ সরকারের লোগো

সরকারি বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুঃখ-দুর্দশার কথা বিবেচনা করে বর্তমান সরকার ২০১৫ সালে যুগোপযোগী জাতীয় বেতন স্কেল প্রদান করে সরকারি বেতনভুক্ত ব্যক্তিদের ধন্য করেছেন। উল্লেখ্য, এ বেতন স্কেলে ভবিষ্যতে সরকারি বেতনভোগীদের শতভাগ পেনশন সমর্পণের বিধান বাতিল করা হয়েছে। এটাও বর্তমান সরকারি বেতনভোগীর জন্য সরকারের আরেকটি ভালো উদ্যোগ বলে মনে করি।

২০১৫ সালের বেতন স্কেলের আগে সরকারি বেতনভুক্ত কর্মকর্তা/কর্মচারী, যাঁরা শতভাগ পেনশন বিক্রি করেছেন, সরকার তাঁদের কথা বিবেচনায় নিয়ে (যাঁরা ইতিমধ্যে ১৫ বছর অতিক্রম করেছেন) তাঁদের পেনশনের আওতায় এনে পেনশন প্রদানের নির্দেশ প্রদান করে সরকার। এটা ২০১৭ সালের জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। এটিও সরকারের মানবিক সিদ্ধান্ত।

কিন্তু সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ফলে উপকারভোগীর সংখ্যা ন্যূনতর থেকে ন্যূনতম হওয়ায়, সরকার প্রধান বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে ২০১৯ সালের পুলিশ সপ্তাহ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে ১৫ বছরের স্থলে তা ১০ বছর করার ঘোষণা প্রদান করে। এটা প্রজ্ঞাপন জারির অপেক্ষায় আছে।

১০ বছর করা হলে উপকারভোগীর সংখ্যা কেমন হতে পারে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। যেমন ২০০৫ সালে বা তার আগে যাঁরা অবসর নিয়েছেন, তাঁদের এখন ৬০ + ১৭ = ৭৭ বছর; যাঁরা ২০০৯ সালে বা তার আগে অবসর নিয়েছেন, তাঁদের বয়স ৬০ + ১৩ = ৭৩ বছর; যাঁরা ২০১৫ সালে বা তার আগে অবসর নিয়েছেন, তাঁদের ৬০ + ০৭ = ৬৭ বছর।

সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরজীবনের পর পারিবারিক ও সামাজিক জরুরি সমস্যা মেটাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আবার অনেকে এর মধ্য দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। এ অবস্থায় সরকার ঘোষিত শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীরা ১৫ অথবা ১০ বছর পর এ সুবিধা পেতে হলে, ২০২২ সালের উপকারভোগীদের বয়স ৭৭, ৭৩ এবং ৬৭ বছর হতে হবে। মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছরে উন্নীত হয়েছে। এ হিসাবেও শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীরা সরকারের এই গৃহীত ও ঘোষিত সিদ্ধান্তের আওতায় আসার আগেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন।

মানবতাবাদী এ সরকার যেহেতু শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী সরকারি বেতনভুক্ত কর্মজীবীদের শেষ জীবনের চরম আর্থিক সংকট ও দুঃখ-কষ্ট লাঘবের চিন্তায় ১৫ অথবা ১০ বছর পর পেনশনের প্রথা চালুর নির্দেশ জারি করেছে, সে নিরিখে সরকারের গৃহীত এ কল্যাণমুখী মহৎ উদ্যোগ তখনই যথার্থ ও কল্যাণকর হবে, যদি সরকার ১৫ অথবা ১০ বছরের স্থলে ৭ অথবা ৫ বছর পর এ পেনশন প্রথা চালুর নির্দেশ দেন।

৭ অথবা ৫ বছরের পর এ পেনশন প্রথা চালুর পক্ষে আরেকটি যুক্তি হলো, ২০১৫ সালের বেতন স্কেল বিধিতে পেনশনপ্রাপ্তির ন্যূনতম চাকরিকাল ১০ বছরের স্থলে ৫ বছর করা হয়েছে। এর ফলে বর্তমান সরকারি বেতনভোগীরা ন্যূনতম ৫ বছর চাকরি সম্পন্ন করে, আজীবন পেনশনের সুবিধা পাবেন।

এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অবদান রাখা ইতিপূর্বে যেসব সরকারি বেতনভোগীরা দুর্ভাগ্যবশত শতভাগ পেনশন বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে বর্তমানে জীবন সায়াহ্নে নিদারুণ অর্থসংকট ও অভাব-অনটনে দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করছেন; তাঁদের ব্যাপারেও সরকার ঘোষিত ১৫ অথবা ১০ বছরের স্থলে ৭ অথবা ৫ বছর পর পেনশনের প্রথা চালুর বিষয়টি পুনর্বিবেচনার যৌক্তিক দাবি রাখে। এতে সরকারের বদান্যতায় যৎসামান্যসংখ্যক অবসরভোগী হলেও সরকারের ঘোষিত পেনশন আদেশের আওতায় এসে আর্থিক সচ্ছলতায় জীবনের শেষ সময়টুকু অতিক্রম করতে পারবেন।

উল্লেখিত পেনশন প্রথা চালুর সদয় আদেশের জন্য আমরা সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জরুরি ও মানবিক হস্তক্ষেপ কামনা করি। সরকারের পক্ষ থেকে এরূপ মানবিক সহানুভূতির কারণে রাষ্ট্রকে তেমন একটা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে না। বিষয়টি অত্যন্ত যৌক্তিক ও মানবিক বিধায় প্রধানমন্ত্রীর অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মতো এটিও আর একটি যুগান্তকারী আদেশ বা সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হবে।

লেখক: এম এ মাবুদ মল্ল, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়