২+২=৫, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে অঙ্কের সুর ও সিনার্জি
যখন স্কুলে পড়ি, তখন বিজ্ঞানের নতুন শিক্ষক যোগ দেন। উনি আমাদের গণিত ও বিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন। উনি গণিত একটু বিস্তারিতভাবে করাতেন এবং ওনার বোঝানোর দক্ষতা ও নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগের কারণে উনি ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। উনি বলতেন, গণিতে এমন কিছু সমীকরণ আছে, যেটি একমাত্র উদাহরণ। যেমন 3²+4²=5²। এ ধরনের সমীকরণ বীজগণিতে একটাই আছে। কেননা, 3, 4, 5 সংখ্যার ক্রম ও সমানের দুই পাশে ফলাফল 25। উনি আরেকটি সমীকরণ দেখালেন, যেখানে দুটি সংখ্যায় যোগফল ও গুণফল সমান 2+2= 4 ও 2 X 2= 4। আর কোনো সংখ্যার গুণফল ও যোগফল সমান হয় না। যদি আপনারা দেখাতে পারেন, তাহলে আপনাদের সোনারগাঁও ফাইভ স্টার (প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে) হোটেলে খাওয়ানো হবে। আমরা মেনে নিলাম ওকে। এরপর যেটি বললেন, আর মানা গেল না। উনি বললেন 2+2= 5 ও হয়। আমরা বললাম, অসম্ভব। এবার এটি প্রমাণসহকারে করে দেখালেন। আমি তো থ বনে আছি।
যখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন জানতে পারলাম এটাকে Synergy বলে। যেখানে দলগত কাজের ফল এককভাবে কাজের ফলের চেয়ে বেশি হয়। ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ থেকে Synergy অর্থাৎ 2+2=5 সম্ভব। গাণিতিকভাবেও প্রমাণ করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের এ বাংলাদেশে Synergyকে কীভাবে প্রয়োগ করা যায় বা সম্ভব করে তোলা যায়। নতুন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সরকার যখন মানুষের প্রত্যাশাকে অতিক্রম করে, তা সিনার্জিরূপে আবর্তিত হয়।
এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সিনার্জি দরকার এবং এই সিনার্জিকে ধারণ করতে পারে প্রয়োজন দক্ষ শাসকের। টেকসই অর্থনীতি, যেটি সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়বে না। এই সরকার সংস্কারের মাধ্যমে একটি সিস্টেম তৈরি করে দিতে পারে। জবাবদিহিতা, সুশাসন ও নতুন নতুন শিল্পোদোক্তা যেন গড়ে ওঠে, সেভাবে একটি সিস্টেম প্রণয়ন করা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন একটি জরুরি উপাদান। যেহেতু বর্তমান সরকারের কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, সেহেতু তাদের কাছে আমরা কামনা করতে পারি এমন একটি অর্থনৈতিক সংস্কার, যেখানে ফল আসবে সিনার্জির আকারে অর্থাৎ 2+2=5 হবে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও অর্থনৈতিক অবস্থা বিশৃঙ্খল, শেয়ারবাজার অস্থিতিশীল (লুটপাট), ব্যাংকের ঋণখেলাপী বৃদ্ধি, তারল্যসংকট, শ্রমিক বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এগুলো আমাদের দেশে স্বাভাবিক ঘটনা। আরও বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। সব ক্ষেত্রে সমস্যা বিরাজমান।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই ও সমন্বিত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের প্রয়োজন। এসব সংস্কারের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী অর্থনীতি গঠন করা সম্ভব হবে, যা মানব উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন
অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পরিবহনব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য উৎস, যেমন সোলার, বায়ু ও জলবিদ্যুৎকে উৎসাহিত করা উচিত
জৈব কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা
শিল্প ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম (উদ্ভাবনী উদ্যোগের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে)
সামাজিক সুরক্ষা ও বৈষম্য হ্রাস।
অর্থনৈতিক সংস্কারে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্থানীয় জনগণের মতামত নিয়ে কাজ করলে প্রকল্পগুলোর সফলতা বাড়বে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন সহজ হবে। বিভিন্ন খাতের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে একটি সুসংহত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন সেক্টরের (মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি) মধ্যে সমন্বয়সাধন করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে, তা অধিক কার্যকর হবে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি উন্নয়নের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের সমন্বয় ঘটানো যেতে পারে, যাতে কৃষকের সন্তানেরা ভালো শিক্ষা পায় এবং স্বাস্থ্যবান থাকে।
বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ওপরের উল্লিখিত সংস্কারগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, জনগণের অংশগ্রহণ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হতে পারে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই উন্নয়নের নতুন মডেল হতে পারবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন অত্যাধুনিক ও বিশেষ পদক্ষেপ। এসব পদক্ষেপ দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত দিকগুলোকে সমন্বিতভাবে উন্নত করতে সাহায্য করবে। গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক পদক্ষেপগুলো টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন, ই-গভর্ন্যান্স, ব্লকচেইন প্রযুক্তি (সরকারি রেকর্ড, ভূমি নিবন্ধন ও পণ্য চাহিদার সঠিক তথ্য সংগ্রহ সম্ভব। এটি দুর্নীতি কমাতে ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে)
নবায়নযোগ্য শক্তি, জৈবশক্তি ও জৈব গ্যাস উৎপাদনে বিনিয়োগ করে কৃষি ও শিল্পে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস তৈরি করা যেতে পারে।
স্মার্ট কৃষি, আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস), ড্রোন প্রযুক্তি
বেসরকারি খাতে উদ্ভাবন, স্টার্টআপ উন্নয়ন, এনজিও ও সামাজিক উদ্যোগ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্প, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি
স্বাস্থ্যসেবা ডিজিটালাইজেশন, টেলিমেডিসিন, ডেটা অ্যানালিটিকস
সামাজিক সুরক্ষা ও অন্তর্ভুক্তি, টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন
সাসটেইনেবল শহর উন্নয়ন, স্মার্ট সিটি পরিকল্পনা, পার্ক ও সবুজ স্থানের সংখ্যা বাড়ানো।
বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নে অত্যাধুনিক ও বিশেষ পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে গ্রহণ করা হলে দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশ একযোগে উন্নত হবে। ডিজিটালাইজেশন, নবায়নযোগ্য শক্তি, স্মার্ট কৃষি, উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও সামাজিক সুরক্ষার মতো পদক্ষেপগুলো একত্র হয়ে দেশের উন্নয়নে Synergy সৃষ্টি করবে। এগুলোর বাস্তবায়নে সরকার, বেসরকারি খাত ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও টেকসই দেশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বিভিন্ন দেশের মডেল অনুসরণ করা যায়, যেমন সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াসহ আরও উন্নত দেশ চাইলে চায়না হতে পারে। সিঙ্গাপুর তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়নের জন্য অনেক সফল কৌশল অবলম্বন করেছে। বাংলাদেশ এসব কৌশল গ্রহণ করে অর্থনৈতিক সংস্কার, টেকসই উন্নয়ন ও জনগণের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতে পারে।
* প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও ডিজিটালাইজেশন
সিঙ্গাপুর প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে তার অর্থনীতি গঠন করেছে। তারা তথ্যপ্রযুক্তি, ফিনটেক ও ই-গভর্ন্যান্সের ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করেছে।
স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম তৈরি করা। বাংলাদেশে প্রযুক্তি উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোর জন্য ইনকিউবেটর ও অ্যাক্সিলারেটর তৈরি করা।
* শিক্ষার মান বৃদ্ধি
সিঙ্গাপুর শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, বিশেষ করে কারিগরি ও প্রফেশনাল শিক্ষার ক্ষেত্রে। তারা STEM (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়।
বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন করা। উচ্চশিক্ষায় গবেষণা ও উদ্ভাবনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া।
*অবকাঠামো উন্নয়ন
সিঙ্গাপুর তার অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে যোগাযোগব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে, যা অর্থনীতির বিকাশে সহায়ক হয়েছে।
বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও নৌপথ উন্নত করতে বিনিয়োগ করা। স্মার্ট সিটি গড়ে তোলা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে শহরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন করা।
সামাজিক সুরক্ষা
সিঙ্গাপুর সামাজিক সুরক্ষা নেট গঠন করেছে, যা জনগণের জীবনমান উন্নত করতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের গরিব ও অসহায় জনগণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পগুলো বৃদ্ধি করা। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও টেলিমেডিসিন সেবা চালু করা।
জনসাধারণের অংশগ্রহণ ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব
সিঙ্গাপুর সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশীদারত্বের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে।
বাংলাদেশের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP): অবকাঠামো ও সেবা উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতা বাড়ানো। স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের মতামত নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ।
সিঙ্গাপুরের কৌশলগুলো বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর হতে পারে। প্রযুক্তির উদ্ভাবন, শিক্ষার মান বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা ও জনসাধারণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি টেকসই অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে পারে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে জনগণের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব।
সেরূপ দক্ষিণ কোরিয়া ও একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ, যেখানকার সরকার বিভিন্ন আধুনিক কৌশল ও পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে। দেশটি ১৯৬০-এর দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী অবস্থান দখল করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার কৌশলগুলো বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা হিসেবে কাজ করতে পারে। শিক্ষার উন্নয়ন, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ, শিল্পায়ন (ভারী শিল্প), অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুললে বাংলাদেশও একটি শক্তিশালী অর্থনীতি তৈরি করতে সক্ষম হবে।
এই সরকারপ্রধান একজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি। উনি ওনার সময়কালে একটি সিস্টেম প্রণয়ন করে দিতে পারেন, যার সুফল বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবাই পাবেন। একটা দেশকে অনেক উপায়ে উন্নয়নের শিখরে নেওয়া যায়। অনেক মডেল, ওপরে উল্লিখিত পদক্ষেপ বা অন্য কোনো পদক্ষেপ নিয়েও উন্নয়ন করা যায়। কোনো একটি সিস্টেমকে একটা শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করাতে হবে। কিন্তু একটি সুষ্ঠু সিস্টেম প্রণয়ন করা না গেলে বা সেই সিস্টেম সুসংহত না হলে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারলে কোনো মডেল বা পদক্ষেপে কাজ করবে না। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগ, সিস্টেম প্রণয়ন ও সেটি চলমান রাখা। একটি সুষ্ঠু সিস্টেম পারে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক কাঠামো দিতে এবং জনগণের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি দিয়ে সিনার্জির মতো ফলাফল দিতে।
*লেখক: এম তারেক ইউ আহমেদ, সুগন্ধা আ/এ, বাসা নং–৩৯, পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম।