খালেদা জিয়া: ঠিকানা যার বাংলাদেশ!

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াছবি: এএফপি

পুরো বাংলাদেশটাই যার বাড়ি—ইট–পাথরের নির্দিষ্ট বাড়ি তাঁর লাগে না। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর সেনানিবাসের মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে কেঁদেছিলেন খালেদা জিয়া। বলেছিলেন, ‘আমি পরিবারের কারও মুখে খাবার তুলে দিতে পারিনি। ওরা আমাকে টেনেহিঁচড়ে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসেছে। যতবার খালেদার জিয়ার মুখ মনে করি, ততবার ওই কান্নার দৃশ্য আমাদের চোখে ভাসে। যাঁকে ঘরছাড়া করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীনেরা—তারা এখন সদলবলে দেশছাড়া। আর খালেদা জিয়া প্রায় প্রতিটি ঘরে তাঁর প্রেরণার বাতি জ্বালিয়ে যাচ্ছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর পাশে তাঁর কবর হচ্ছে।

অকালবৈধব্যে যিনি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিলেন, নিজের কর্মগুণে সেই তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের অভিভাবক। রাজনীতিতে যার অনীহা ছিল, সেই তিনিই ভাগ্যচক্র ও বিচক্ষণতা দিয়ে হয়ে ওঠেন দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে নিজে হয়ে ওঠেন গণতন্ত্রের ‘মানসকন্যা’।

খালেদা জিয়ার মুখটা যেন এক আবহমান বাংলার সুন্দর ও পবিত্র আদল। বাঙালিয়ানার অনন্য স্মারক শাড়ি ছিল তাঁর পছন্দের পরিধেয়। কখনোই মুখ ঢেকে রাখার কথা কল্পনাও করেননি। রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ধর্ম লাগবে—এমনটাও চিন্তা করেননি। অনন্য সংস্কৃতি আর রুচিবোধের শ্রেষ্ঠত্ব তিনি পেয়েছিলেন নিজ পরিবার থেকে। খালেদা জিয়ার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার তাঁর মেয়েদের সুশিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শৈশবে তিনি বাসায় গান ও নাচের শিক্ষক রেখেছিলেন এবং আরবি শেখার জন্যও গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা ছিল। খালেদা খানম পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুলে নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কারও জিততেন।

খালেদা খানমের বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থে বলা হয়েছে, শৈশব থেকেই তিনি পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। ফুলের প্রতি নিবিড় অনুরাগ ছিল তাঁর। নিজের ঘর পরিচ্ছন্ন করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখতেন। পরবর্তী জীবনে তিনি ফুলের প্রতি এই অনুরাগ, পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাটি থাকার অভ্যাস বজায় রেখেছিলেন। তাঁর রাজনীতিও তাঁর নিজের মতো সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল বলে অনেকে মনে করেন।

জীবনীকারের বরাতে প্রথম আলো লিখেছে, সেনাবাহিনীর তরুণ ও চৌকস কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট দিনাজপুরের বালুবাড়িতে পৈতৃক বাড়িতে খালেদা খানমের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের প্রসঙ্গে তাঁর এক জীবনীকার লিখেছেন, ঘটক জিয়াউর রহমানকে বলেছিলেন, ‘আপনি যদি তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হন, তাহলে আপনার বাড়িতে বিজলিবাতির দরকার হবে না। পাত্রী এত রূপসী যে তাঁর রূপের ছটায় সব অন্ধকার দূর হয়ে যাবে।’ ঘটকের এমন কথা শুনে জিয়াউর রহমান হেসেছিলেন এবং বিয়ে করতে সম্মত হন। বিয়ের পর থেকে খালেদা খানম ‘খালেদা জিয়া’ নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন।

খালেদা জিয়া
ছবি: এএফপি

গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ‘খালেদা’গ্রন্থে লিখেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কঠিন এক পরিস্থিতিতে পড়েন তিনি। দেশ স্বাধীন করার প্রাণপণ লড়াইয়ে যুক্ত হয়ে পড়েন স্বামী জিয়াউর রহমান। দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে সংকটে পড়েন খালেদা জিয়া। এর-ওর সাহায্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ঠিকানা বদলে বদলে আত্মগোপন করে থাকেন। ১৯৭১ সালের ২ জুলাই সিদ্ধেশ্বরীর এক বাসা থেকে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে সেনানিবাসে যুদ্ধবন্দী করে রাখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। যুদ্ধের সেই ভয়াবহ দুর্বিষহ দিনগুলো অতিক্রম করতে হয়েছে একাকী।

জীবনযোদ্ধা খালেদা জিয়া ক্ষমতার চোখে আঙুল রেখে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পেরেছিলেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। দেশই হলো আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি মানুষই আমার সবকিছু।’ দেশের মাটিতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করে তিনি তাঁর কথার প্রমাণ রেখেছেন। যিনি টানা ৪১ বছর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রধান ছিলেন। জীবদ্দশায় এই নারী নেত্রীকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য কেউই ছিলেন না।

২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলা কার্যকর করার চেষ্টা চলছিল, তখন সপরিবার দেশ ছাড়ার জন্য তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। তখনও তৎকালীন এই বিরোধীদলীয় নেত্রী দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই। মরলে এ দেশের মাটিতেই মরব।’

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছ থেকে কটাক্ষ, তীর্যক বাক্যবাণ—সবই সয়েছেন আপন ধৈর্য ও সহনশীলতা দিয়ে। খালেদা জিয়া কাউকে কখনোই ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি, অন্যদের মতো অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ শব্দচয়নও তাঁর ধাতে ছিল না। হাসিমুখে জেলে যেতে তাঁর এতটুকু বুক কাঁপেনি।

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন প্রথম দফায় নারীশিক্ষার প্রসারে খালেদা সরকারের ভূমিকার কথা স্বীকার করে থাকেন সবাই। সেই সময় শিক্ষা খাতে আগের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছিল। এরপর শিক্ষা বাজেট অমনভাবে আর কেউ বাড়ায়নি। এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান হালহকিকত কমবেশি সবাই জানি।

প্রাইমারি স্কুলে বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিজের স্বাক্ষরিত পত্র পাঠাতেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। বিনা মূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাস করে তাঁর সরকার। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিও তাঁর সরকারের অবদান।

১৯৯১-৯৬ শাসনামলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার নারী শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ক্রমান্বয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং পরে ডিগ্রি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করে দেওয়া হয়। মেয়ে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধ করতে শিক্ষা উপবৃত্তিও চালু করা হয়। দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার জন্য তাঁর সরকার ‘শিক্ষার জন্য খাদ্য’ নামে এক বৃহৎ কর্মসূচিও চালু করেন।

আমাদের জীবদ্দশায় এমন নারী নেত্রী আর দেখব না; ইস্পাতদৃঢ় যিনি পুরুষের চোখরাঙানি কিংবা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আপন শক্তিতে দেদীপ্যমান থাকতে পেরেছিলেন।

খালেদা জিয়া ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মোট ২৩টি সংসদীয় আসনে নির্বাচন করেছেন। কোনোটিতেই তিনি পরাজিত হননি। একজন মহীয়সী নারীর প্রতি মানুষের ভালোবাসা কতটা নিরঙ্কুশ হতে পারে, এটি তার বড় প্রমাণ।

খালেদা জিয়া (১৯৪৫–২০২৫)
তারেক রহমানের ফেসবুক পেজ থেকে

আজ কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই ফেসবুক ফিড ভরে উঠেছে খালেদা জিয়ার শোক বিহ্বলতায়। টেলিভিশনের স্ক্রিন ও পত্রিকার পাতা আজ বিপুলভাবে খালেদাময়। স্মরণকালে আমরা কার বেলায় একটা ঐক্যবদ্ধ একটা জাতিকে এমন শোকাভিভূত হতে দেখেছি আর? খালেদা জিয়া তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। তারেক রহমান, জুবাইদা ও জাইমা রহমানরাই জাতীয়তাবাদী চেতনার নেতৃত্ব দেবেন।

যিনি কাজ করেন, তাঁর ভুল হয়। সুশাসনের ঘাটতির ভুলগুলো গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর দৃঢ়চেতা অঙ্গীকারে ঢাকা পড়ে গেছে। মহাকালে খালেদা জিয়ার চিরায়ত যাত্রা সুশান্তির হোক। পুরুষের বাংলাদেশে নারীপ্রেরণা, নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়নের আইকন হয়ে থাকুন তিনি। বিদায় বলব না খালেদা জিয়া। বাংলাদেশের ইতিহাস ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে আপনাকে মনে রাখবে। সালাম।

লেখক: সাংবাদিক

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]