স্মৃতির অ্যালবামে অমলিন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরুদের ছবি
শিক্ষকতায় আমি প্রায় ৩১ বছর পার করে দিয়েছি। কিন্তু আমি যখন পেছন ফিরে তাকাই আর প্রিয় সব শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কথা স্মরণ করি, তখন নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। কোথায় আমার শিক্ষকদের নিবেদিতপ্রাণ মনোভাব আর কোথায় আমার। আহারে! তাঁদের ধারেকাছেও যদি যেতে পারতাম, কতই না গর্ব হতো!
সব শিক্ষকের কথাই আমার খুব মনে পড়ে, তবে কেউ কেউ আমার মনে একটু বেশিই দাগ কেটে গেছেন। প্রাইমারি স্কুলের আমাদের গ্রামের সেই আবদুল খালেক স্যার, নোয়াগাঁও গ্রামের আবদুল লতিফ স্যার, মাখনা গ্রামের মতিউর রহমান স্যারসহ সব স্যারের ক্লাসগুলো এখনো চোখের সামনে ভাসে। বিশেষ করে আবদুল লতিফ স্যারের পড়ানোর ধরন আমার কাছে অসাধারণ মনে হতো। স্যারের ক্লাসগুলো একেবারে তন্ময় হয়ে শুনতাম। আমার জীবনে স্যারের প্রভাব খুব অনুভব করি। শিক্ষকতার বাইরেও স্যারের অনেক গুণ ছিল। স্যার খুব ভালো একজন রেফারি ছিলেন।
অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ফুটবল খেলা পরিচালনা করতেন। আমাদের এলাকার সব টুর্নামেন্টে স্যার রেফারির দায়িত্ব পালন করতেন। এ ক্ষেত্রে স্যার অত্যন্ত সফল। এ ছাড়া গ্রাম্য দরবারে বিভিন্ন বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।
প্রাথমিকের শিক্ষা শেষে তৎকালীন নোয়াগাঁও জুনিয়র হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। কী দরদ দিয়ে পড়াতেন স্যাররা! এ স্কুলে সে সময় প্রধান শিক্ষক ছিলেন সুখরঞ্জন কর স্যার। স্যারের বাসা ছিল নেত্রকোনায়। কিন্তু নোয়াগাঁও থাকতেন। চাকরিজীবনটা সেখানেই কাটিয়েছেন। তিনি আমাদের গণিতের ক্লাস নিতেন।
কী সুন্দর করে কথা বলতেন! মনে মনে বলতাম, ‘স্যারের মতো যদি হতে পারতাম, তবে জীবনটা সার্থক হতো।’ আজ আমার মনে হয়, স্যারের মতো হতে পারিনি। এ স্কুলেই শিক্ষকতা করতেন আমার চাচাতো ভাই মো. মতিউর রহমান। চাচাতো ভাই হলেও বেশ ভয় পেতাম ওনাকে। খুব গম্ভীর মানুষ। এখনো ভাই না বলে স্যারই সম্বোধন করি। উনিও আমাকে ছাত্রই মনে করেন। অন্য স্যাররাও খুব ভালো পড়াতেন।
সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়েছি কেন্দুয়া থানার (বর্তমানে উপজেলা) সাজিউড়া জুনিয়র হাইস্কুলে। প্রধান শিক্ষক আবদুল কাদির স্যার। অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন রুপ্তন উদ্দিন স্যার, আবু সাদেক স্যার, আবদুস সাত্তার স্যার, হাদিস উদ্দিন স্যার, মাওলানা স্যার (মাওলানা স্যারের নাম জানতাম না। মৌলভি স্যার বলেই ডাকতাম। স্যার জোর করে আমাদের সবাইকে নিয়ে মাঠেই নামাজ পড়তেন)। কী চমৎকার করে পড়াতেন তাঁরা! কী অসাধারণ ছিল দিনগুলো!
এরপর নবম-দশম শ্রেণি পড়লাম কেন্দুয়া জয়হরি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে, যার বর্তমান নাম কেন্দুয়া জয়হরি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষক আমার কাছে কিংবদন্তি। কী অসাধারণ সব ক্লাস! আমরা ক্লাসেই সব পড়া বুঝতাম। গৃহশিক্ষকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হতো না বললেই চলে। যত দূর মনে পড়ে পুরো নবম-দশম শ্রেণিতে গণিত ও উচ্চতর গণিত মাস দুয়েক, ইংরেজি মাস দুয়েক আর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান মিলিয়ে মাসখানেক। এর কারণ একটাই। স্যাররা খুব সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে পাঠ উপস্থাপন করতেন।
ইংরেজি পড়াতেন আসাদুল হক স্যার, গোপাল স্যার, শামসুদ্দিন স্যার। গণিত পড়াতেন দুর্গা দাস স্যার, পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেন ননী গোপাল স্যার, রসায়ন পড়াতেন গোলাম মোস্তফা স্যার, আর জীববিজ্ঞান পড়াতেন নুরুল আমিন স্যার। সবাই ছিলেন যার যার বিষয়ের ওপর অসাধারণ পারদর্শী। স্যারদের ক্লাসের জন্য আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম। এসব ক্লাস করার পর আর গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন পড়ত না। মূলত স্কুলই ছিল আমাদের শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র।
আমাদের সময় স্যারদের খুব সমীহ করতাম, আবার ভয়ও পেতাম। ক্লাস ছাড়া স্যারদের সামনে খুব একটা পড়তাম না। আজ আমার অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম আসাদুল হক স্যারকে নিয়ে আমার স্মৃতির পাতা থেকে এ-সম্পর্কিত একটা গল্প বলি। যত দূর মনে পড়ে আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। তখন শীতকাল। আমার সর্দি লাগল। সঙ্গে জ্বরও। আমি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার জন্য কেন্দুয়ায় গেলাম। তখন কেন্দুয়া থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মতিয়র রহমান নামের একজন চিকিৎসক কর্মরত। বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। আমি স্কুলের পর তাঁর চেম্বারে গেলাম। যে-ই চিকিৎসকের চেম্বারে ঢুকতে যাব, দেখি আসাদুল হক স্যার (তখন তিনি আমাদের স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক) তাঁর সঙ্গে বসে কথা বলছেন।
আমি আর ঢুকতে সাহস পেলাম না। স্যারের সামনে গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। স্যার বের হয়ে গেলে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলব। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু স্যারের বের হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। কি আর করা। ডাক্তার তো দেখাতেই হবে। আমি তখন কেন্দুয়া থেকে আড়াই মাইল দূরে সাজিউড়া গ্রামে মামার বাড়িতে থাকি। বেশ দূরের পথ। আর অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। মহান আল্লাহ তাআলার নাম নিয়ে সাহস করে চেম্বারে ঢুকে গেলাম। স্যার আর ডাক্তার দুজনকেই সালাম দিলাম। ডাক্তারের কাছে আমার সমস্যা বললাম। তিনি ওষুধ লিখে দিলেন।
টেট্রাসাইক্লিন ক্যাপসুল। সাত দিন খেতে হবে। আমি বেরিয়ে আসছি, তখনই স্যার আমাকে ডাকলেন। বললেন, ‘মোতাহার, তুমি আমার সঙ্গে দেখা কোরো।’ সর্বনাশ! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। যা হোক, আমি বললাম, ‘ঠিক আছে স্যার।’ এরপর সালাম দিয়ে বের হয়ে এলাম। বের হয়ে তো এলাম। কিন্তু পড়লাম মহাচিন্তায়। স্যারের সঙ্গে আবার দেখা করতে হবে কেন! স্যার আবার কী বলেন কে জানে। এমন আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলাম। যা হোক স্যার যেহেতু বলেছেন, দেখা তো করতেই হবে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম দেখা করবই।
পরে যা হয় হবে। স্যারের বাড়ি ব্রাহ্মণজাত গ্রামে। স্যার আমার বন্ধু এনায়েত উল্লাহর (এনায়েত উল্লাহ এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক) ফুফাতো ভাই। পাশাপাশি বাড়ি। স্কুলে দেখা করার সাহস পেলাম না। পরদিন এনায়েত উল্লাহর সঙ্গে স্যারের বাড়ি গেলাম। কিন্তু এনায়েত উল্লাহর সামনে কি-না-কি বলে বসেন, তাই স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম একা। আমি স্যারের বৈঠক ঘরে গিয়ে বসলাম। তখন স্যার কী একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আমি অপেক্ষা করছিলাম। বেশ টেনশনে যাচ্ছিল সময়টা। কিছুক্ষণ পর স্যার এলেন।
স্যার এসে শান্তভাবে আমার কাছে বসলেন। বললেন, ‘দেখো মোতাহার, শুধু ওষুধে শরীর ভালো হবে না। ব্যায়াম করতে হবে। তুমি কি ব্যায়াম করো?’ আমি বললাম, ‘না স্যার, ব্যায়াম করি না।’ স্যার বললেন, ‘তোমার ব্যায়াম করা জরুরি।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যায়াম করব স্যার?’ স্যার বললেন, ‘বিশেষ কিছু না। সকালে উঠে শীতের কাপড়গুলো খুলে কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। দেখবে শরীর থেকে ঘাম বের হতে শুরু করবে। এরপর শরীরটা মুছে হাত ও পা ভালো করে ধুয়ে নাশতা খেয়ে পড়তে বসবে। দেখবে কয়েক দিনের মধ্যেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে স্যার। কাল থেকেই আমি ব্যায়াম করব। তাহলে এখন আসি স্যার?’ স্যার বললেন, ‘আচ্ছা এসো।’ আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে ভাবলাম, স্যার এ সাধারণ কথাটা বলার জন্য আমাকে আসতে বলেছিলেন! যা হোক, আমি খুব খুশি মনে স্যারের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম।
আমি তখন মামার বাড়ি থাকতাম। বাড়িটি সাজিউড়া গ্রামের একদম পূর্বপাড়ায় (পাড়ার নাম বানিয়াগাতি), স্কুল থেকে আড়াই মাইল দূরে। স্কুলে যাওয়া-আসা মানে দৈনিক পাঁচ মাইল হাঁটা। এ ছাড়া বিভিন্ন খেলাধুলা তো করতামই। ব্যায়াম এমনিতেই কম হতো না। কিন্তু স্যার যেহেতু বলেছেন, সকালের ব্যায়ামটা করতেই হবে। কিন্তু মুশকিল হলো তখন গ্রামে কেউ ব্যায়াম করত না। আমি একা একা ব্যায়াম করলে সবাই হাসাহাসি করবে না তো? বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমি কাউকে কিছু বললাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম সকালে কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগেই সবার অগোচরে ব্যায়াম করে ফেলব। ব্যায়ামের চিন্তায় আমার রাতে ভালো ঘুম হলো না। কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগেই একদম ভোরেই আমি ব্যায়াম করতে বেরিয়ে গেলাম।
তখনো কিছুটা অন্ধকার। বেশ কুয়াশাও পড়েছে। আমি একেবারে পুকুরের পূর্বপাশে (মামাদের বাড়িটা পুকুরের পশ্চিম পাশে) গিয়ে স্যারের কথামতো শীতের সব কাপড় আমগাছে রেখে পাশের খেতে দৌড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু ওই যে বললাম, ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়।’ আমার বেলায়ও তা-ই হলো। আমার দূরসম্পর্কের এক মামি ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুতে পুকুরঘাটে এলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল আমার দিকে। আমি তখন কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে শীতের কাপড় রেখে একা একা দৌড়াচ্ছি। উনি ভাবলেন আমি বোধ হয় একেবারেই পাগল হয়ে গেছি। উনি আমাকে কিছু না বলে তাড়াতাড়ি মামাকে (আমার আপন মামা) ঘুম থেকে তুলে নিয়ে এলেন। মামাকে বললেন, আমি পাগল হয়ে গেছি।
মামা তাড়াতাড়ি আমাকে ডেকে বললেন, ‘এই ছেলে, তোমার কি হয়েছে, এভাবে দৌড়াচ্ছ কেন?’ আমি তো পড়লাম লজ্জায়। দৌড় থামিয়ে বললাম, ‘মামা, আমি একটু ব্যায়াম করছি। স্যার ব্যায়াম করতে বলেছেন।’ মামা ততক্ষণে বিষয়টা বুঝে গেছেন। আমাকে আর কিছু না বলে মামিকে কয়েকটা ধমক দিয়ে চলে গেলেন। আমিও তখন ব্যায়াম বাদ দিয়ে শীতের কাপড় পরে চুপচাপ পড়তে বসি। সে-ই যে ব্যায়াম করা ছাড়লাম আর কোনো দিনই ব্যায়ামের ধারেকাছেও যাইনি। ভাগ্যিস স্যার আমাকে এ বিষয়ে কোনো দিন আর কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। আর আমিও স্যারের কাছ থেকে বেশ কিছুদিন নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেছি। এরপর হয়তো স্যার বিষয়টি ভুলে গেছেন। আমারও আর সমস্যায় পড়তে হয়নি। স্যারদের নিয়ে এ রকম গল্প অনেক বলা যাবে। কিন্তু লেখার কলেবরটা অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই এ রকম গল্প বলা থেকে আপাতত বিরত থাকলাম।
যা হোক, স্যারের ক্লাসটা আমি খুব উপভোগ করতাম। এমন আকর্ষণীয়ভাবে ক্লাস করাতেন যে মনযোগ না দেওয়ার কোনো সুযোগই থাকত না। মন্ত্রমুগ্ধে হয়ে স্যারের কথাগুলো শুনতাম। স্যারের ক্লাস মিস করার চিন্তাও করতাম না।
স্যার খুব সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। পোশাক-আশাকেও ছিলেন খুব মার্জিত। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরতেন। কেন্দুয়ার কাছেই ব্রাহ্মণজাত গ্রাম থেকে স্কুলে আসতেন। সারা বছরই স্যারের হাতে একটা ছাতা থাকত। শীতকালে স্যারের এক হাতে একটা ভাঁজ করা চাদর থাকত। অনেক দূর থেকে দেখেই আমরা বুঝতাম, স্যার আসছেন।
শুধু শিক্ষক হিসেবে নন, একজন মানুষ হিসেবেও স্যার ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। কেন্দুয়ার সর্বমহলেই স্যারের গ্রহণযোগ্যতা ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। তবে স্যারের এই গ্রহণযোগ্যতার কারণ মূলত শিক্ষকতাই। একজন শিক্ষক যখন সত্যিকারের আদর্শ মানে পৌঁছাতে পারেন, তখন তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আসতে বাধ্য।
শুধু আসাদুল হক স্যার নন, আমার সব স্যারই ছিলেন অসাধারণ শিক্ষক আর অসাধারণ মানুষ। শামসুদ্দিন স্যার পুরো ক্লাসেই ইংরেজিতে কথা বলতেন। গোপাল স্যারের ইংরেজি ক্লাসও দারুণ উপভোগ্য ছিল। স্যার গ্রামে থাকলেও খুব শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে কথা বলতেন। গোলাম মোস্তফা স্যারের রসায়ন ক্লাস অসাধারণ হতো। রসায়ন রসকষহীন বিষয় হলেও স্যারের ক্লাসটা উপভোগ্যই হতো। আরেক রসকষহীন বিষয় পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেন দুলাল নন্দী স্যার। কিন্তু স্যারের পড়ানোর কল্যাণে এ বিষয়ও সহজই মনে হতো। জীববিজ্ঞান পড়াতেন নুরুল আমিন স্যার। কী সুন্দর করে পড়াতেন স্যার! জীববিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যখন স্যার আলোচনা করতেন, বিজ্ঞানের ক্লাসটাকে সাহিত্যের ক্লাস বানিয়ে ফেলতেন।
অসাধারণ মনে হতো আমার কাছে। উচ্চতর গণিত পড়াতেন দুর্গাদাস স্যার। স্যার খুব গুরুগম্ভীর ছিলেন। পড়াতেন অসাধারণ। মনে হতো উচ্চতর গণিতের সব অঙ্কের সমাধান দেওয়া তাঁর কাছে ডাল-ভাতের চেয়ে বেশি কিছু নয়। এককথায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কোনো ক্লাসেই বিরক্তি বোধ করতাম না। বরং বেশির ভাগ ক্লাসেই খুব আনন্দ পেতাম।
আমাদের সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মরহুম সৈয়দ আবু সাদেক স্যার। স্যার কেতাদুরস্ত তো ছিলেনই, খুব ভাবগম্ভীর একজন মানুষ ছিলেন। স্যারের হাতে সব সময় একটা বেত থাকত। অসম্ভব একটা মুড নিয়ে চলতেন। স্যারের চালচলন দেখে আমরা তো ভয় পেতামই, শিক্ষকেরাও ভয় পেতেন। পুরো স্কুলই বেশ ভালো একটা শৃঙ্খলার মধ্যে চলত। স্যার শ্রেণি-পাঠদানেও ছিলেন অসাধারণ। স্যারের ক্লাসে খুব আনন্দ পেতাম।
দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন আমার ছাত্রজীবনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন শুধু আমাদের শিক্ষকদেরই নয়, বরং তখনকার দিনের শিক্ষার সার্বিক পরিবেশটাকেও বর্তমান সময়ের থেকে এগিয়ে রাখতেই ইচ্ছে করে। স্কুলে পড়ার সময় ‘স্কুল পালানো’ টার্মটার সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম না বললেই চলে। স্কুলে অনুপস্থিতির হারটাও ছিল একেবারেই নগণ্য। ক্লাসে অমনোযোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ছিল কম। আর বর্তমান সময়ের চিত্রটা একেবারে ভিন্ন। স্কুল পালানো, স্কুলে অনুপস্থিতি আর ক্লাসে অমনোযোগিতা এখন অতি নগণ্য বিষয়। অবশ্য এসব সমস্যার সঙ্গে বহুমাত্রিক বিষয় সম্পর্কিত।
তবু এসব বিষয়ে আমাদের অনেক কিছু কাজ করার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি। যা হোক, এ বিষয়গুলো নিয়ে সময় সুযোগ মতো অন্য কোনো দিন আলোচনা করার আশা রইল। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে, শিক্ষকতার স্বর্ণযুগ কি আমরা পেরিয়ে এসেছি? এর উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়ে থাকে, তাহলে তো ভয়াবহ অবস্থা। আমাদের তো সবকিছুতেই উন্নতি করা উচিত। তা না হলে দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষকতায় যদি আমাদের শিক্ষাগুরুদের হারাতে না পারি, তাহলে আমরা যোগ্য শিষ্য হতে পেরেছি, এটা বলব কী করে? আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সম্মান রক্ষার জন্যই তো তাঁদের হারানো উচিত।
শিক্ষকজীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে আমি যতই আমার শিক্ষাগুরুদের স্মরণ করছি, তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ততই বেড়ে যাচ্ছে। তখনকার দিনে অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কীভাবে যে শিক্ষার আলো ছড়াতে এত মানসিক শক্তি পেতেন, তা ভেবে আমি কোনো কূলকিনারা পাই না। তাঁদের কর্মকাণ্ড থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার অনেক সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি।
এ লেখায় আমার সব শিক্ষকের নাম উল্লেখ করতে পারিনি বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু সবাই যে আমাদের প্রতি আন্তরিক ছিলেন, এ বিষয় আমার কোনো সন্দেহ নেই।
আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের প্রায় সবাই পরপারে চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন অসংখ্য স্মৃতি, যেগুলো এখনো আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে আলোকবর্তিকার কাজ করতে পারে। আজ আমার সব শিক্ষকের প্রতি পরম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। মহান আল্লাহ তাআলা তাঁদের সবার ওপর সীমাহীন রহমত বর্ষণ করুন। আমিন।
লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত), মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা।