মজনু মিয়া কলাগাছ

টাকা
প্রতীকী ছবি

কয়েক দিন ধরে মজনু মিয়া বেশ প্রশংসায় ভাসছে। যে তাকে দেখছে, সেই সালাম দিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং মজনুর পরিচিতিও বেশ বেড়েছে। এতে মজনুও খুশি। মজনু একজন মাঝারি ব্যবসায়ী ছিল। বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য করে এখন সে এলাকার বড় ব্যবসায়ীদের একজন হয়েছে। মজনু থেকে হয়েছে মজনু মিয়া! বিশেষ কারণবশতঃ পেপারে ছবিসহ নাম আসার পর তার খুশি আর ধরে না। মজনুর পরিচিতি বেড়েছে, সে চিন্তা করে ফেলেছে, চেয়ারম্যান হবে।

বাজারে মজনু মিয়ার বড় সিমেন্টের দোকান, গ্রামে আছে কিছু জমিজমা। আরও কিছু ব্যবসা আর সামাজিক কর্মকাণ্ড করে ইতিমধ্যে সে তার পরিচিতির পরিধি বাড়িয়ে নিয়েছে। মানহা নামের একটি মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলেও টাকার অভাবে ভর্তি হতে পারছে না শিরোনামে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে এগিয়ে আসে মজনু। সে মেয়েটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দায়িত্ব নিয়ে ফেলে। তারপর থেকেই মজনু বাহ্বা পেতে শুরু করে। আজকাল তো প্রায়ই এ শিরোনামে পত্রিকাগুলো সংবাদ প্রকাশ করে থাকে আর তার ফলে দেশবাসীও জেনে যায়। তা না হলে কি মজনু মিয়ার মতো মানুষ দায়িত্ব নিত? মানহা আসহায় মায়ের একমাত্র সন্তান। মানহার বাবা বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। কেন আসেনি, কেউ জানে না। বিদেশ থেকে টাকা তেমন পাঠাতে পারেনি, তবে কিছু ঋণ রেখে গেছে! মানহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছে, সে ছোট থেকেই মেধাবী ছাত্রী ছিল। মানহার নানার বাড়ি আর মজনুর নানার বাড়ি একই গ্রামে।

গত সপ্তাহ থেকে মজনু মিয়া প্রায়ই বিব্রত হয়ে যাচ্ছে। একই ইউনিয়নের আরও দুই ছেলে—একজন মেডিকেল কলেজে, আরেকজন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। তাদের সমস্যাও মানহার মতোই। কী আর করা! মজনু মিয়ার দয়ার শরীর; সেখানেই তো সাধারণ মানুষ আসবে। তা ছাড়া মজনু চেয়ারম্যান নির্বাচন করবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছেলে দুটোর অভিভাবক প্রায়ই আসছে মজনুর কাছে। মজনু মিয়া আজ-কাল, বিভিন্ন সমস্যা বলে সময়ক্ষেপণ করে দিচ্ছে। কিন্তু, এভাবে কত দিন? কী যে করে মজনু!

একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় মজনুর এক ঘনিষ্ঠ চামচা হাজির। এই চামচা সেই মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাওয়া ছেলেটার আত্মীয়। মজনু এমনিতেই কয়েক দিন ধরে ব্যবসা আর পারিবারিক বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে টেনশনে আছে। তারপর দুপুরে খাওয়ার সময় ভর্তির ব্যাপারে টাকা দিয়ে সাহায্য করার কথা তুলতেই মজনু স্বরূপে! ‘এই ভোদাই, তুই জানিস ন্যা, আমি কী জন্যি মানহাক টাকা দিছি? কোতা তো কতে চাই ন্যা, না কওয়ালে ছাড়িসনে! আরে বেটা, আমার ছবি পত্রিকাত দিনু আর গেরামের সব লোক দেকলো। এয়াত কি আমার নাম ছড়াইল না কি? একজনেক দিছি, সগলে জানছে, আর দেয়া লাগবি নানি। আমার দেয়া হইয়ে গেছ; পাবলিক আখুন আমাক দাতা মজনু কয়! জানিস তুই? এই জোন্য আমার ইলেকশনে সুবিধা হইছে। ছবি তুলার আগে কত সুন্দর পোজ দিনু, সগ লোক তালি দিল! অই শালা, আর আমি কি দাতা হাতেম তাই!! সরকারি–বেসরকারি অফিসার আছে না এলাকাত? ঘুষখোর, সুদখোর, কালোবাজারি আছে না? তারে সগলের দায়িত্ব নাই? তারে কাছ লিয়ে যা হে! আর মানহার মাক আমি ছোট থেইকা চিনি, আমার সাত ওর বিয়ে ঠিক হতেই, বিদেশি ছাওয়াল পায়া ওর বাপ ওক বিয়্যা দিয়্যা দিল!!’

এ সময় মজনুর বউ রাগ চোখ নিয়ে তাকাতেই মজনু বলল, ‘এই তুই রাগিস কেন? ভাত-কাপড় কি কুনু দিন কম দিছি? আগে গরিব আছিনু, তখনো খামতি আছিল? মুসলমান চারখান বিয়া করতে পারে।’ এরপর মজনু মিয়া কথা না বলে খেতে আরম্ভ করল আর চামচাকে বলল, ‘তুই গিয়া ক, মজনু ভাইর বুকে ব্যথা, শুয়ে আছে; দিন সাতের আগে কতা হবিনানি।’

মজনুর চামচা সুরুজ মিয়া হতভম্ব হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, এর মনে এত রাজনীতি! আবার ভোটে দাঁড়াতে চায়। আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে এমনই হয়! এ ধরনের লোক ভোটে জিতলে জনগণের কী হবে?

বাইরে বসা গরিব পরিবারটিকে কী বলবে সুরুজ? সে কিছুই বলতে পারবে না। বড় মুখ করে মজনুর কাছে নিয়ে এসেছিল ওদের; ব্যবস্থা একটা হবেই বলে। কিন্তু, ভেতরে মজনুর মতো মানুষদের অন্য রূপ! সে চুপিসারে মজনুর বাড়ির পেছন দিক দিয়ে মাঠের মধ্যে চলে গেল; কেউ জানল না। মজনু মিয়া ঘরের ভেতর বিশ্রামে আর অসহায় মেধাবী ছেলেটার পরিবার বাইরে অপেক্ষায় রত।

**নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারবেন [email protected]