আমাদের শৈশবে আমরা বিটিভির কল্যাণে কিছু নাটক দেখেছিলাম, ‘এখানে নোঙর’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘হাজার বছর ধরে’। সাইফুদ্দীনের নকল করে আমরা শিশু বয়সে হাহাকার করে সংলাপ বলতাম, ‘আমার জলমহাল কই!’ এই নাটকগুলো আমাদের প্রান্তিক মানুষদের বিশেষত চরাঞ্চলের মানুষের জীবনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, নাটকগুলোই ছিল সেই বর্তনী, যা আমাদের আর্থিং করে রেখেছিল বাংলাদেশের মাটিতে আর মাটিসংলগ্ন মানুষে। সাদাকালো নাটকের যুগ ফুরাল, হুমায়ূন আহমেদ সিরিজ নাটক লিখলেন, ‘এই সব দিনরাত্রি’, তাতে সুখী নীলগঞ্জ প্রকল্পের কথা ছিল। প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারিতে যেতে যেতে আমাদের মানসকল্পনায়ও বারবার জেগে উঠছিল আদর্শ গ্রাম এবং সেই গ্রামের আদর্শ বিদ্যালয় সৃষ্টির বাসনা। চিন্তক ড. লুৎফর রহমান কোথাও লিখেছিলেন—নীতির কথা সম্প্রচার করার সুবিধা হচ্ছে সমাজে নীতি জাগ্রত হয়। তাই নীতি-দুর্নীতির সংঘাতময় নাটক দেখে আমরা মানুষের জীবনবদলের স্বপ্ন দেখতাম, সেই স্বপ্নের স্থানে পরে নতুন স্বপ্ন এল। কিন্তু আমাদের ভেতর কারও কারও স্বপ্ন প্রতিস্থাপনীয় ছিল না, কেউ কেউ সেই সব স্বপ্নকে লালন করে বাস্তব পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। সেই সব বিস্ময়কর মানুষের একজনের কথা বলব আজ। তার নাম শাহেদ কায়েস।
পাঠ্যবইয়ে আহসান হাবীবের কবিতার লাইনের মতো সে-ও ‘মেঘনা নদীর নেয়ে আমি মেঘনা পাড়ে বাড়ি’। কবি মানুষ। শরৎকালের একটি দিনে মেঘনার নুনেরটেকের পাশের এক নতুন চরে গিয়ে সে সেই চরটির প্রেমে পড়ে গেল। একদিকে রঘুনার চরের কিছু ছিন্নমূল মানুষের পত্তন, মাঝখানে এরশাদের ভেস্তে যাওয়া গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প, আরেক দিকে সবুজবাগে আরও কিছু উন্মূল মানুষ। চরভরা কাশবনে বাতাসের দোলা, ওপরে নীল আকাশ, চারদিকে বিপুল মেঘনার বাঁকা জলের খেলা—শাহেদকে এমন মায়ায় বাঁধল, সে এই চরের নাম নিয়ে কবিতা লিখল ‘মায়াদ্বীপের পাঠশালা’, কবিতায় চরের নাম রাখল মায়াদ্বীপ। তার বন্ধুরাও ডাকল এই চরকে সেই মায়া নামে।
তখন বিদ্যুৎ নেই, স্বাস্থ্যসেবা নেই, নাগরিক সুযোগ–সুবিধা নেই, চর ভরা সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। পাশের নুনেরটেক চরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মায়াদ্বীপের ছেলেমেয়েরা এত অবহেলিত হয় যে সইতে না পেরে ফিরে আসে। শাহেদ সিদ্ধান্ত নেয় এই মায়াদ্বীপে শিশুদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার, ‘মায়াদ্বীপ জেলেশিশু পাঠশালা’ গড়ে ওঠে ২০০৭ সালে। জেলেশিশুরা ভর্তি হয় সেই পাঠশালায়। শুরু হয় সুবর্ণগ্রাম কার্যক্রম। উৎসুক বন্ধুবান্ধব-পরিবেশবিদ ও শিল্পী-সাহিত্যিকরা এগিয়ে আসেন, কভারস্টোরি এবং প্রতিবেদনে দ্বীপটির নাম মুখে মুখে হয়ে যায় মায়াদ্বীপ। কেউ আসেন স্বেচ্ছাসেবক হতে। ওই যে বললাম, শুভ উদ্যোগ আর নীতিকথা সম্প্রচারিত হলে মানুষকে তা স্পর্শ করে।
২০১০ সালের জুন মাসে মায়াদ্বীপ ঘেঁষে মেঘনা নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন শুরু হয়। দ্বীপের অলৌকিক সৌন্দর্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং দ্বীপবাসী বঞ্চিত মানুষদের জীবন-জীবিকা রক্ষা করতে মায়াদ্বীপের মানুষদের সংঘবদ্ধ করে শাহেদ ‘মায়াদ্বীপ রক্ষা আন্দোলন’ শুরু করে। আন্দোলনের সঙ্গে তখন সংহতি প্রকাশ করেন স্থানীয় জনগণ ছাড়াও সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ, মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন। এখানে বলে রাখা ভালো, মেঘনা নদীতে সুলতান নগর চর এখন পুরোটাই নদী, এ ছাড়া আরও কয়েকটি চর যেমন নলচর, রাম প্রসাদের চর ও মহিষার চর—এই তিনটি চরের অর্ধেক জেগে আছে আর বাকি অর্ধেক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অবৈধ বালু উত্তোলনের জন্য। মায়াদ্বীপের তিন ভাগের এক ভাগ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় এই বালুসন্ত্রাসীদের কারণে। প্রশাসনকে বারবার জানানো হয়। একপর্যায়ে জাতিসংঘকেও দিনের পর দিন চিঠি লিখতে বাধ্য হয় শাহেদ। ফলে ২০১২ সালে জাতিসংঘ এই চরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে, বাংলাদেশ সরকারকে ৮ পৃষ্ঠার একটি চিঠি দেয়। জাতিসংঘের চিঠি আসার পর বাংলাদেশ সরকার বিষয়টাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয় এবং ২০১২ সালেই জাতীয় সংসদ নতুন একটি আইন পাস করে, যার নাম জাতীয় বালুনীতি আইন।
বাকি গল্প লিখতে গিয়ে মনে পড়ল, কবি আবুল হাসান লিখে গেছেন, ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না।’ শাহেদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি এই অবৈধ বালুসন্ত্রাসীরা, ২০১৩ সালের জুলাই মাসে তারা শাহেদকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে মেঘনার মাঝখানে, মেরে লাশ ফেলে দেবে বলে। সাংবাদিক বন্ধুদের তাৎক্ষণিক তৎপরতায় প্রাণে বেঁচে গেলেও দেশছাড়া হতে বাধ্য হয় সে।
কিন্তু রক্তে যার গড়বার শুভ ইচ্ছা, সে কি পালিয়ে বাঁচতে পারে! আবার ফিরে আসে শাহেদ। একদিকে চলতে থাকে ক্ষুব্ধ বালুসন্ত্রাসীদের ক্রমাগত হয়রানি, আরেক দিকে চলতে থাকে অবৈতনিক মায়াদ্বীপ জেলেশিশু পাঠশালা। মামলা আর পাঠশালা— উভয় কারণেই শাহেদ বিঘার পর বিঘা পৈতৃক সম্পত্তি বেচে দিতে বাধ্য হয়। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি পাঠশালাটি বন্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে একদল দুষ্কৃতকারী হামলা করে। প্রধান শিক্ষক মরিয়ম আক্তার পাখির মা থেকে শুরু করে দেড় বছরের ছোট্ট বাচ্চাটিও তাদের হামলার নৃশংসতা থেকে রেহাই পায়নি। যাওয়ার সময় হামলাকারীরা বলে যায় ভবিষ্যতে স্কুলে পড়াতে গেলে পরিবারের সবাইকে তারা জবাই করে মেরে ফেলবে। আহতরা যাতে নদী পার হয়ে হাসপাতালে যেতে না পারে, সে জন্য সব নৌকার মাঝিদের হুমকি দিয়ে নিষেধ করে যায়।
শাহেদরা মামলা দায়ের করে, সেই মামলা তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়, ১১ জনের মধ্যে একজনমাত্র আসামি গ্রেপ্তার হয়, সেসহ বাকিরা খুব সহজেই জামিনে ছাড়া পেয়ে চলে যায়। কিন্তু পাখিরা এখনো গ্রামছাড়া। এখনো আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। গ্রামে তাদের গবাদিপশুগুলো অনাহারে কাটাচ্ছে, তাদের আয়ের প্রধান উৎস মুদিদোকানটিতে চুরি করে সর্বস্ব লুটে নেওয়া হয়েছে, ঘরে সিঁদ কেটে পুনরায় চুরি করেছে, মাছ ধরতে যেতে পারছেন না পাখির বাবা। অর্থাৎ পুরো পরিবারটিকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। সুবর্ণগ্রাম ফাউন্ডেশনের স্কুলটি অতঃপর বন্ধ রয়েছে, যে স্কুলটিতে গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার সুযোগ পায়। পাঠশালাটি কেন বালু ব্যবসায়ীদের শত্রু? কারণ, প্রথমত বালু উত্তোলন নিয়ে বাধা পাওয়ায় তাদের ক্ষোভ। দ্বিতীয়ত, এখন তারা মাদক-হুন্ডি ব্যবসায়-মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। চরে স্কুল মানেই জনসমাগম, মানুষের কোলাহল। সেখানে মাদক ব্যবসায় চলবার মতো সুনসান অবস্থা থাকবে না।
এই হামলার মাত্র কদিন আগেই শাহেদের সঙ্গে ফোনে হিসাব করছিলাম, ঋষিপাড়ার যে স্কুলটি সে চালায়—ষাটটি সুবিধাবঞ্চিত শিশু যেখানে পড়তে আসে, তাদের মিড-ডে মিল (ভাত, ডাল আর একটি সেদ্ধ ডিম) খাওয়াতে কত খরচ হতে পারে? মাসিক খরচ দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ! হ্যাঁ, ১০০ জন প্রবাসী যদি মাসে মাত্র সাত পাউন্ড করে দেন, তবে হতে পারে; অথবা ৭০০ জন প্রবাসী যদি মাসে এক পাউন্ড দেন! কিন্তু কে আছে কালো কালো শিশুদের আলো আলো হাসি সারাটি বছর জাগিয়ে রাখবার জন্য সামনে এগিয়ে আসবে এবং এগিয়েই থাকবে? কতজন? প্রসঙ্গক্রমে অর্থনীতিবিদ আতিউর রহমান স্যারের কথা উঠেছিল (বিতার্কিক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বড় স্নেহ পেয়েছি ওঁর), সুবিধাবঞ্চিত শিশু চারাগাছ কত বড় মহীরুহে পরিণত হতে পারে, তার অসামান্য নমুনা স্যারের জীবন। এই সব অবহেলিত শিশুর কেউ কেউ ও রকম সাংঘাতিক কেউ হবে, সেই স্বপ্নই শাহেদের চালিকা শক্তি।
শাহেদ আমার বন্ধু, শাহেদরা আমাদের গর্ব। সে যখন কান্না গোপন করে বলে—‘১০টা বছর ধরে এই হয়রানির মোকাবিলাই করে যাচ্ছি’, তখন মনের ভেতর জলতরঙ্গের মতন একটি বিষয় আলোড়িত হয়—আমরা কি এমন নিশ্চেষ্টভাবেই শুভবুদ্ধির পরাজয় ঘটতে দেখে যাব? এই সব মানুষের শুভ প্রচেষ্টাগুলো বানচাল হয়ে গেলে কি বাংলাদেশ পরাজিত হবে না? আমাদের দেশের দরিদ্র-নিপীড়িত মানুষ কবে নাগরিক হিসেবে মর্যাদাময় জীবন পাবে? বালুখোর, নদীখোর, বনখোর, টিলাখোর এত সব খোরের খোরপোশ চালাতে চালাতে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে অফেরতযোগ্যভাবে এগিয়ে চলেছে। চারদিকে শুধু ‘মুনাফাহি কেবলম’ নীতি চলছে। মাদক ব্যবসায়ী বালু ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা খেয়ে দেশের শীর্ষ পত্রিকাগুলোর থানা প্রতিনিধিরাও উল্টো নিউজ করছে। ফলে আপনি জানবেন কী করে, আসলে কাদের শুভ উদ্দেশ্য মার খেয়ে যাচ্ছে বারবার? সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে কেউ নেই, সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে যে এসে দাঁড়ায়, তার পাশেও কেউ নেই। সত্যিই কি কেউ নেই? আমরা কি এককাট্টা হয়ে এই সব ভয়ানক পরিবেশ–দস্যুদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অবহেলিত শিশুদের একটি স্থায়ী ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি না? অশুভ চক্রের আক্রমণ যতটা ক্রমাগত যত ধারাবাহিক, ততটা নিরবচ্ছিন্নভাবে আমরা এই সব প্রচেষ্টার পাশে কেন দাঁড়াই না?
লেখক: কথাসাহিত্যিক